
আজ ১০ নভেম্বর। শহীদ নূর হোসেন দিবস। ১৯৮৭ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী নূর হোসেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক/গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান বুকে-পিঠে ধারণ করে শহীদ হয়েছিলেন।
কবি শামসুর রাহমান নূর হোসেনের আত্মত্যাগের বর্ণনা করেছিলেন তার ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতায় এভাবে—
উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে/রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য স্লোগান,/বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ/শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা/নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয়/ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ/বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার/বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।
নূর হোসেন। এক অমিত সাহসী আত্মোৎসর্গকারী প্রেরণাদায়ক যুবকের নাম। যার উদোম গায়ে লেখা ছিল— ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক/গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। স্বৈরাচারের বুলেট আলিঙ্গন করেছিল সে দ্বিধাহীন চিত্তে।
সময়টা তখন এমন ছিল, বাঙালি জাতি নিষ্পেষিত হচ্ছে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের যাত্রা হয়। অনেক নারকীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিসমূহ সামরিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল।
সেদিন ছিল আট দল, পাঁচ দল ও সাত দলের নৌপথ, রেলপথ ও রাজপথ অবরোধ কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি। কার্তিকের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে দলে দলে জনতা সমবেত হতে থাকে নিজ নিজ জোটের ব্যানারে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আটদলীয় জোটের অবস্থান ছিল এখন যেখানে নূর হোসেন স্কয়ার সেখানে। পাঁচদলীয় জোটের অবস্থান ছিল হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের সামনে ও সাত দলের অবস্থান ছিল দৈনিক বাংলা মোড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আটদলীয় জোটের অবস্থানে মিলিত হলো একদল সাহসী যুবকের খণ্ডমিছিল। মিছিলটি গুলিস্তান থেকে তোপখানা মোড় পর্যন্ত বার বার প্রদক্ষিণ করছিল এবং আন্দোলনকামী জনতাকে অনুপ্রাণিত করছিল। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন নূর হোসেন। খণ্ডমিছিলে অংশগ্রহণকারী যুবকদের উদোম গায়ে লেখা ছিল উপরোক্ত স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান।
আমরা যারা সেদিন পাঁচ দলের ছাত্রকর্মী ছিলাম, তারাও হাউস বিল্ডিং থেকে জিরো পয়েন্ট আবার কখনো দৈনিক বাংলা পর্যন্ত সমবেত আন্দোলনকারীদের স্লোগানে প্রকম্পিত করে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করছিলাম। ততক্ষণে জননেত্রী শেখ হাসিনাও আন্দোলনস্থলে উপস্থিত হয়েছেন। স্বৈরাচার এরশাদের পুলিশবাহিনী প্রথমে গুলি চালায় নূর হোসেনকে লক্ষ্য করে। পরবর্তী সময়ে শুরু হয় জননেত্রী শেখ হাসিনা যে অস্থায়ী মঞ্চে ছিলেন সেই মঞ্চকে টার্গেট করে গুলিবর্ষণ। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন জননেত্রী প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। পাঁচ দল ও সাত দলের অবস্থানের ওপরও পুলিশ জলকামান ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু জনতার রুদ্ররোষ ঠেকানোর ক্ষমতা স্বৈরাচারের ছিল না। সেদিন নূর হোসেনের জীবনদান ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক মাইলফলক, বিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরির এক জ্বলন্ত লেলিহান শিখা, সেদিন নূর হোসেন হয়ে উঠেছিলেন সমগ্র বাঙালির বাংলাদেশ। ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ শহীদ যে পথ দেখিয়ে গেছেন সেই পথেই নূর হোসেন যুক্ত হলেন আরেক স্বাধীনচেতা আত্মোৎসর্গকারী যুবক হিসেবে। নূর হোসেনের রক্তে রঞ্জিত, অর্জিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে চলছে জঙ্গি-মৌলবাদী গোষ্ঠীর উন্মত্ততা, অতিসম্প্রতি চিরায়ত বাংলা ও বাঙালির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন নষ্ট করার জন্য চলছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, মন্দিরে আগুন, কয়েক বছর আগে যা হয়েছিল রামুতে বৌদ্ধ বিহারে। আজ আমরা এই দিনটিকে স্মরণ করব বাংলা ও বাঙালির চিরায়ত বন্ধনকে কোনো অসুর শক্তি যেন ক্ষতবিক্ষত করতে না পারে এই প্রত্যাশায়। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের যে পতাকা দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতে উড্ডীন, তা যেন নিরাপদ থাকে। আদর্শবিচ্যুত, আশ্রিত কিছু পরগাছা এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি একের পর এক মিলেমিশে চেষ্টা করছে এই সম্প্রীতির বন্ধনকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে অকার্যকর করার। কিন্তু বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে বহুদূর, সব অসাম্প্রদায়িক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে তা এগিয়ে যাবে নিরন্তর। সাম্প্রদায়িক শক্তি কয়েকদিন আগে দুর্গাপুজা কে কেন্দ্র করে যে তাণ্ডব চালালো সনাতন ধর্মের মানুষদের উপর তা আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও তারা এই সাহস পায় কোথা থেকে , আজকে উচিৎ সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত উপড়ে ফেলে দোষীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দেয়া , অপরাধী যে দলেরই হোক অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা ।
বাংলাদেশ এই সময়ে এক বিশেষ জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় পার করছে , গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমুহ কার্যকর না থাকায় অনভিপ্রেত ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে , প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও ঘটনা থেমে থাকছে না, এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ প্রয়োজন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না , রাজপথে গনতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির অবস্থান দুর্বল, ধর্মের আশ্রয়ে ধর্মান্ধ শক্তি তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে, সরকারের ভিতরেও তাদের অবস্থান চোখে পড়ার মত, তাই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত রাস্ট্রের চিকিৎসা জরুরী, রাখঢাক করে লাভ নেই — বাংলাদেশকে ৭১এর ধারায় ফিরিয়ে নিতে হবে — মামুলী রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে তা হবে না –৯০এর গণ অভ্যুত্থানের শিক্ষা থেকেও আমরা বহু দূরে, চাই সকল ব্যক্তি, গণতান্ত্রিক দলের ঐক্য, চাই আইনের শাসনের কার্যকারিতা, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যতিত তা অর্জন সম্ভব নয় । সম্প্রতি বাস ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে সাধারণ জনগনের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ রয়েছে , আজ ১৪ দলের বৈঠকে সমন্বয়ক এবং আওয়ামীলীগের বর্ষীয়ান আমির হোসেন আমুও বলেছেন বাস ভারা বৃদ্ধি করা ঠিক হয় নি । যে সব বিষয়ে জনমনে অসন্তোষ রয়েছে তা নির্ণয় করে তার সমাধানের পথ খুজে বের করা ,তা হলেই নূর হোসেনের আত্মত্যাগ সার্থক হবে ।
নূর হোসেনের পথ ধরে আমরা আছি, ছিলাম এবং থাকব। গণতন্ত্র এগিয়ে যাবে শোষণমুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্যে। নূর হোসেন তুমি ঘুমাও শান্তির পতাকাতলে। লেখা রবে ইতিহাসে নূর হোসেনের রক্তে লেখা গান, নূর হোসেনের রক্তে লেখা আন্দোলনের নাম। যে অমিত তেজ নিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছন সেই বাংলাদেশ যেন প্রতি মুহূর্তে দৃশ্যমান হয়। অমরত্ব লাভ করুক তোমার আত্মত্যাগ।
শফী আহমেদ, ৯০ এর ছাত্রনেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ।