
বিপ্লব বেঁচে থাক, তাহের সাবাস কাজী সালমা সুলতানা : সাতই নভেম্বর ১৯১৭। যুদ্ধ জাহাজ অরোরা থেকে ছোড়া হয় কামানের গোলা। সাথে সাথে রেডগার্ড ও বিপ্লবীরা ঝটিকাবেগে দখল করে নেয় জারের উইন্টার প্রাসাদ। পেট্রোগ্রাডের উইন্টার প্রাসাদে আশ্রয় নিয়েছিলো সাময়িক সরকারের সদস্যরা। প্রাসাদের পাহারায় ছিলো ক্যাডেট ও শক-ব্যাটেলিয়ান। বিপ্লবী শ্রমিক, সৈনিক ও নাবিকেরা ক্যাডেট এবং শকদের পরাস্ত করে প্রাসাদ দখল করে, গ্রেফতার করে সরকারের সদস্যদের। সুচিত হয় সশস্ত্র বিপ্লবের সুচনা। এরপর রেডগার্ড ও বিপ্লবী সৈনিকেরা রেলস্টেশন, ডাকঘর, তার অফিস, মন্ত্রিসভা ও রাষ্ট্রীয় ব্যাংক দখল করে। ‘প্রাকপার্লামেন্ট’ ভেঙ্গে দেয়। পেট্রোগ্রাডের স্মোলনি হয় বিপ্লবীদের সদর দফতর। বিপ্লবের সকল আদেশ স্মোলনি হতে জারি হতে থাকে। অভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দিতে ৬নভেম্বর রাতে লেনিন স্মোলনিতে আসেন। অভ্যুত্থান পরিচালনার দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেন। বিপ্লবী সৈন্য সংস্থা ও রেডগার্ডের সদস্যরা স্মোলনিতে হাজির হয়। উইন্টার প্রাসাদ বলশেভিকরা অবরোধ করে রাখে। এভাবেই রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয় আসে। প্রতিষ্ঠা করা হয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সাতই নভেম্বর ১৯৭৫। সোভিয়েত বিপ্লবের বয়স ৫৮ বছর। এশিয়ার একটি ছোট দেশ বাংলাদেশ। রাত ১২টায় সেনানিবাসে গুলির শব্দ। শুরু হয় সশস্ত্র অভ্যুত্থান। ঝটিকা অভিযান চালিয়ে বন্দি থাকা সেনাবাহিনী প্রধান প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। সামরিক বাহিনীর একটি অংশ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৪ নভেম্বর সামরিক অভুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে। বিপ্লবী সৈনিকদের অভিযানকালে সামরিক অভ্যুত্থানকারীরা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু বিপ্লবী সৈনিকদের কাছে পরাস্ত হয়। তাদের অনেকেই নিহত হয়, অনেকই পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে।
বিপ্লবে প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দিতে ৬নভেম্বর কর্নেল তাহের ঢাকায় আসেন। অভ্যুত্থান পরিচালনার দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেন। তাঁর বিপ্লবী সৈনিকেরা প্রস্তুত ছিলো। সেই প্রস্তুতি অনুসারেই সেনানিবাসে অভিযান পরিচালিত হয়। কিন্তু বিপ্লব বা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণের দৃশ্যমান প্রচেষ্টা নেই। ফলে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়া না। রাশিয়ার মত একইভাবে বিপ্লব শুরু হলেও ফলাফল হয় ভিন্ন। আর এজন্য চরম মূল্য দিতে হয় কর্নেল তাহের ও জাসদকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃসংশভাবে হত্যার পর সেনাবাহিনীতে ক্ষমতার লড়াই চলে। এরই ধারাবাহিকতায় ৪ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাপ্রধান জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। দেশের ক্ষমতা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা মোশতাকের নেতৃত্বে বঙ্গভবনে; অপরদিকে অভ্যুত্থানের নায়কেরা সেনানিবাসে। খালেদ মোশাররফ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। বিনিময়ে গোটা কর্তৃত্ব দখলের চেষ্টা করেন। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে জেনারেল জিয়াউর রহমান হতে কর্নেল তাহেরের সাহায্য চান। কর্নেল তাহের তখন নারায়ণগঞ্জে থাকতেন। টেলিফোন করে জিয়া বলেন, তাহের সেভ মাই লাইফ। জিয়া জানতেন অকুতভয় তাহের সমারিক বাহিনীতে না থাকলেও তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। বন্দি জিয়ার জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে তাকে শুধু তাহেরই রক্ষা করতে পারে
সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতিতে সক্রিয় হন কর্নেল তাহের। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাথে যুক্ত হন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে চলা অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মাঝে রাষ্ট্রক্ষমতায় আঘাত করার উপযুক্ত সময় বিবেচনা করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পর জাসদ গোপন রাজনৈতিক তৎপরতা চালায়। গড়ে তোলে সশস্ত্র গণবাহিনী। এদিকে কর্নেল তাহের সেনানিবাসে সৈনিকদের মধ্যে গড়ে তোলেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। ৬নভেম্বর জাসদ অভ্যুত্থানের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন তাহের। সচেতন নয় বরং বলা ভালো যে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে বড় ভাই তাকে সিলেট এমসি কলেজে ভর্তি করেন। কঠোর নিয়মকানুনের এই কলেজে তিনবন্ধু মিলে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করেন। দেওয়াল পত্রিকায় পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলেন তাহের। ঘটনাটি পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তিনি লেখেন, ব্রিটিশরা ভারত ভেঙেছে, এবার আমাদের পাকিস্তান ভাঙতে হবে। তাহের স্বপ্ন দেখতেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মকালেও এ স্বপ্ন সযত্নে লালন করেছেন তিনি । সামরিক কর্মকর্তা হয়েও সমাজতান্ত্রিক সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য নানা গোপন তৎপরাতায় সম্পৃক্ত ছিলেন । মনের গভীরে লালন করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার । মেজর মঞ্জুর তার ‘হেল কমান্ডো’বইতে লিখেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটালিয়নে যোগ দিয়ে পরিচয় হয় কর্নেল তাহেরের সাথে। প্রথম পরিচয়েই তাহের তাকে বলেন, তুমি কমান্ডোতে যোগ দিয়েছো জেনে খুশি হয়েছি। মনে রেখো দেশ স্বাধীন করতে হবে। মঞ্জুর চমকে উঠেন। বলেন, আমরা তো স্বাধীন দেশের নাগরিক।
কোন দেশ স্বাধীনের কথা বলছেন স্যার ! ধমক দিয়ে তাহের বলেন, ভুলে যেও না তুমি বাঙালি । ঘটনাটি ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ের। তাহের এই স্বপ্ন পুরণেই পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ছাউনি কোয়েটা থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। অসীম সহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। দায়িত্ব পান ১১ নস্বর সেক্টর কমান্ডারের। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই সেক্টরে যত সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করেন, মুক্তিযুদ্ধকালে অন্যকোন সেক্টরে তেমনটি ঘটেনি। তাহের সম্মুখযুদ্ধেও অংশ নেন। এক সম্মুখ যুদ্ধেই তিনি একটি পা হারান। বিজয়ের পর সেনাবাহিনীতে ফিরে যান। চেষ্টা করে স্বাধীন দেশের উপযোগী গণসেনাবাহিনী গড়ে তোলার। সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে তাঁর চিন্তার প্রতিফলন না ঘটায় পদত্যাগ করেন। স্বাধীন দেশে পাকিস্তান ধাঁচের সেনাবাহিনী গঠনের তিনি বিরোধিতা করেন। গণবিচ্ছিন্ন এমন সেনাবাহিনীকে শ্বেতহস্তীর সাথে তুলনা করেন। পদত্যাগপত্রে সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তার প্রতিফলন ঘটে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে।
সাতই নভেম্বর দেশে বিপ্লবের পরিস্থিতি ছিলো কি না, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে । রাষ্ট্রক্ষমতায় এই আঘাত বিপ্লবের লক্ষ্যে করা হয়নি বলেও অভিমত রয়েছে। সনাতন সমাজতান্ত্রিক নেতাদের অনেকেই বলেন, সে সময় বাংলাদেশে বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক ছিলো না। বলা হয়, সাতই নভেম্বর জাসদ বা কর্নেল তাহেরের উদ্যোগ কোন বিপ্লবের ডাক ছিলো না। উদ্যোগটি ছিলো একটি সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর প্রকাশ্য রাজনীতি করতে না পেরে জাসদের গোপন রাজনৈতিক তৎপরতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। হয়তো তৎকালীন জাসদ নেতৃত্ব প্রকৃতপক্ষেই সাতই নভেম্বর গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। এ কারণে সেনানিবাসের পর রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা দৃশ্যমান নয়। আর এ সুবাদে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বিরোধী জেনারেল জিয়া তার অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হন। তিনি খুব ভালভাবেই জানতেন যে, তাহের সমাজতন্ত্রের সৈনিক। কর্নেল তাহের রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে জেনারেল জিয়ার জন্য বিপদের কারণ হবে। তাকে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হবে। এ কারণে জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করে বিশ্বাসঘাতকতার চরম পরিচয় দেন। গ্রেফতার করেন কর্নেল তাহেরসহ জাসদ নেতৃবৃন্দকে। গ্রেফতার করেন ৭ই নভেম্বরের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদেরও। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে প্রহসনের বিচারের ব্যবস্থা করেন। বিচারে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। তাহেরের বড়ভাই আবু ইউসুফ খান ও মেজর জলিলের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ড. আনোয়ার হোসেন, হাসানুল হক ইনু, আ স ম আব্দুর রব ও মেজর জিয়ার ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সালেহা খাতুন, রবিউলের ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারান্ড দেওয়া হয়।
প্রহসনের বিচার করেই জেনারেল জিয়া ক্ষান্ত হননি। রায় দ্রুত বাস্তবায়নেরও ব্যবস্থা করেন। ২১ জুলাই ১৯৭৬। ভোর চারটা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে ঘটে যায় এ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে পা হারানো একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম বীর সেনানায়ক কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তমকে তাঁরই রক্তে ঝড়া মুক্ত স্বদেশভূমিতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের মুক্তির সংগ্রামে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের ঘটনায় ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনের পাশে আরেকটি নাম যুক্ত হয়- কর্নেল আবু তাহের। এই বীর সেনানী ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমাকে কেউ হত্যা করতে পারে না, আমি সমগ্র জনতার মধ্যে প্রকাশিত। আমাকে হত্যা করতে হলে সমগ্র জাতিকে হত্যা করতে হবে- যা কেউ পারে না। তাই তো আজও মনের গভীরে অনুরণিত হয়, ‘তাহের তাহের বলে ডাক দেই/ ফিরে আসে মৃত্যুহীণ লাশ/ কার কণ্ঠে বলে উঠে আকাশ-বাতাস/ বিপ্লব বেঁচে থাক, তাহের সাবাস ।

কাজী সালমা সুলতানা , রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং গণমাধ্যম কর্মী ।