নিজেদের দুই মেয়ে শিশুসন্তান নিয়ে আইনজীবীদের মাধ্যমে আলোচনায় কোনো সমঝোতায় পৌঁছুতে পারেননি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান ও জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো দম্পতি। তবে এরিকো স্বামী-সন্তান নিয়ে টোকিওতে গিয়ে নতুন করে সংসার করতে চান বলে তার আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন করেছেন।

এমন একটি প্রস্তাব নাকানো এরিকোর পক্ষ থেকে আইনজীবীর মাধ্যমে স্বামী শরীফ ইমরানের আইনজীবী ও তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটি আজ আদালতে উপস্থাপন করা হবে।

নির্ধারিত দিন মঙ্গলবার (২৮ সেপ্টেম্বর) এ দম্পতি ও তাদের দুই মেয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

এ বিষয়ে জাপানি মা এরিকোর আইনজীবী বলেছেন, আদালতের নির্দেশনার আলোকে ইমরান শরীফের আইনজীবীদের সঙ্গে বসেছিলাম। দুই শিশুর মায়ের পক্ষ থেকে আমরা তাদের প্রস্তাব জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রস্তাবের বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। এরিকো চায় সব কিছু ভুলে স্বামী-সন্তান নিয়ে জাপানে গিয়ে আবারো নতুন জীবন শুরু করতে।

যদিও এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর দেশের উচ্চ আদালত এ দম্পতির দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ ও দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাবা ও জাপানি মায়ের আইনজীবীরা ‘সুন্দর সমাধানের চেষ্টা করবেন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।

হাইকোর্টের নির্দেশনায় গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে গুলশানের ভাড়া ফ্ল্যাটে দুই শিশুর সঙ্গে দিনে বাবা ও রাতে মা থাকছিলেন।

ওইদিন আদালত শিশুদের জন্য মঙ্গল হয় এবং দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য উভয়পক্ষের আইনজীবীকে একটি সুন্দর সমাধান খুঁজতে বলেছিলেন। একইসঙ্গে ২৮ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন ঠিক করেন আদালত।

ওইদিন আদালতে জাপানি মায়ের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। বাবার পক্ষে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও তার সঙ্গে ছিলেন মো. মোস্তাফিজুর রহমান।

গত ২৩ আগস্ট মায়ের সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে থাকা দুই শিশুকে উন্নত বাসায় রাখার প্রস্তাব করেছিলেন তাদের বাবা ইমরান শরীফ। ৩১ আগস্ট গুলশানের ভাড়া বাসায় থাকতে বাবা-মা সম্মতি দিলে তাদের আইনজীবীদের অনুমতি দিয়ে ১৫ দিন ভাড়া বাসায় থাকার আদেশ দেন আদালত।

দুই শিশুকন্যাকে ফিরে পেতে হাইকোর্টে শিশুদের হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে ঢাকায় এসে গত ১৯ আগস্ট রিট আবেদন করেন জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো, যিনি পেশায় চিকিৎসক। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওইদিনই হাইকোর্টের একই বেঞ্চ দুই শিশুকে ৩১ আগস্ট আদালতে হাজির করতে তাদের বাবা শরীফ ইমরান ও ফুফুকে নির্দেশ দেন।

শিশুদের আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে গুলশান ও আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশনা দিয়েছিলেন আদালত। একইসঙ্গে ১৯ আগস্ট দুই সন্তানকে নিয়ে তাদের বাবা যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন, সেজন্য ৩০ দিনের নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছিল।

এরপর গত ৮ সেপ্টেম্বর দুই মেয়েকে নিয়ে বাধাহীনভাবে উন্মুক্ত পরিবেশে চলাচল ও রাতে তাদের সঙ্গে ঘুমানোর অনুমতি পান জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো। আর বাবা দুই শিশুর সঙ্গে দিনের বেলায় থাকতে পারবেন বলে আদেশ দেন হাইকোর্ট।

আদেশে আদালত বলেন, বাবা-মা দুজনই তাদের শিশুদের নিয়ে বাইরে যেতে ও কেনাকাটা করতে পারবেন। এছাড়াও ফ্ল্যাটের ভেতরে স্থাপন করা সিসি ক্যামেরা অপসারণ করতে হবে। তবে বাসার বাইরে সিসি ক্যামেরা থাকতে পারে।

এর আগে ২৫ আগস্ট জাপানি দুই শিশুকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে সুবিধামতো রাজধানীর যেকোনো একটি উন্নতমানের হোটেলে রাখার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন তাদের বাবা। শিশুদের বাবার পক্ষে আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ এ আবেদন করেন।

গত ২২ আগস্ট ওই দুই শিশুকে হেফাজতে নেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তখন ওই দুই শিশুকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়।

২০০৮ সালে জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) জাপানি আইন অনুযায়ী বিয়ে করে টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। তাদের ১২ বছরের সংসারে তিন কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। তারা তিনজনই টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের শিক্ষার্থী ছিলেন।

চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি শরীফ ইমরানের এরিকোর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ২১ জানুয়ারি ইমরান আমেরিকান স্কুল ইন জাপান কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু এতে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ইমরানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এরপর একদিন জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা স্কুলবাসে বাড়ি ফেরার পথে বাসস্টপ থেকে ইমরান তাদের অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান।

গত ২৫ জানুয়ারি শরীফ ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছ থেকে মেয়েদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। কিন্তু এরিকো ওই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে মেয়েদের নিজ জিম্মায় পেতে আদেশ চেয়ে গত ২৮ জানুয়ারি টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি মেয়েদের সঙ্গে এরিকোর সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে আদেশ দেন।

কিন্তু ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়েকে সাক্ষাতের সুযোগ দেন। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ‘মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে’ ইমরান তার মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে নিয়ে তিনি দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।

এরপর গত ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে তাদের মা এরিকোর জিম্মায় হস্তান্তরের আদেশ দেন। তবে দুই মেয়ে বাংলাদেশে থাকায় বিষয়টি নিয়ে তিনি বাংলাদেশের একজন মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। গত ১৮ জুলাই তিনি শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে আসেন।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading