
অ্যাডভোকেট আনসার খান :সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে আজীবন রাজপথের সংগ্রামের ত্যাগী জননেতা-“ধর্ম-কর্ম-সমাজতন্ত্র”অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ওই মূলনীতির ভিত্তিতে বৈষম্যহীন একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণের অটল বিশ্বাসী সংগ্রামী,গণমানুষের নিকট আস্হাভাজন ও নির্ভরশীল বাম ঘরানার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আব্দুল হান্নান ইহজাগতিক সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন-না-ফেরার দেশে।মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
তিনি আর কখনো আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না সত্য।কিন্তু তিনি তাঁর জীবদ্দশায় দেশ-জাতি-সমাজ ও গণমানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি,সকল ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের অবাধ ও বৈষম্যহীন অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য জীবনভর ত্যাগের মহিমায় যেভাবে লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন,কোনো কিছু না পাওয়ার বেদনায় যিনি ভারাক্রান্ত না হয়ে উত্তরসূরীদের জন্য সংগ্রামী জীবনধারার যে উজ্জ্বল উদাহরণ রেখে গেছেন-সেই মহিমান্বিত কর্মধারার স্মৃতিময় ইতিহাস থেকে সৈয়দ আব্দুল হান্নানের নাম মুছে ফেলা যাবে না কখনো।তিনি অমর-অক্ষয় হয়ে থাকবেন সবসময়।
যখনই সমাজের রূপান্তর ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মানের বিষয়টি আমাদের চিন্তা-চেতনা ও মননে উত্থিত হবে,তখন হান্নান ভাইয়ের রেখে যাওয়া বিপ্লবী জীবনধারার স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো আমাদেরকে আলোড়িত করবে-আমরা স্মৃতিকাতর হবো তাঁকে স্মরণ করে।অর্থাৎ সশরীরে তাঁকে আমরা দেখতে পাবো না,কিন্তু আমাদের মন-মননে তিনি উদ্ভাসিত হবেন-আমাদের চিন্তা জগতে বিচরণ করবেন-এখানেই হান্নান ভাইয়ের ইহজাগতিক জীবনের সার্থকতা।
হান্নান ভাইয়ের সাথে কখন প্রথম পরিচয় হয়েছিলো সন-তারিখ দিয়ে বলা অসম্ভব হলেও এটি বেশ মনে আছে-যখন এমসি কলেজের(এখনকার সরকারি কলেজ)ছাত্র ছিলামএবং ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলাম তখন শাহী ঈদগাহের সৈয়দ পুর হাউসের বাসভবনে ক’বার গিয়েছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে সংগঠনের জন্য আর্থিক সহযোগিতা চাইতে।আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে-আমাদের লিডার রফিকুর রহমান লজু ভাই,আব্দুল মালেক ভাই প্রমূখ নেতৃবৃন্দ আমাদেরকে বলে রেখেছিলেন সংগঠনের কর্মসূচি পালনে অর্থকড়ির প্রয়োজন হলে ন্যাপ নেতা মরহুম জননেতা আব্দুল হামিদ,সৈয়দ আব্দুল হান্নান প্রমূখের সাথে দেখা করবে।মূলত এই কারণে হান্নান ভাইয়ের বাসভবনে একদিন ঢু মেরেছিলাম সংগঠনের একটি অনুষ্ঠান আয়োজনে কিছু আর্থিক অনুদান পাওয়ার প্রত্যাশায়।
১৯৭৫-সালের ২১-ফেব্রুয়ারীর সপ্তাহ দিন পূর্বে একদিন বেলা ১১-টার দিকে আমরা কয়েকজন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী গিয়েছিলাম হান্নান ভাইয়ের বাসভবনে।তাঁর বৈঠকখানায় বেশ ক’জন লোক বসে আছেন-তিনি ব্যস্তই মনে হলো।তাসত্ত্বেও আমরা বৈঠকখানায় ঢুকে পড়লাম এবং সালাম দিয়ে বললাম আমরা ছাত্র ইউনিয়ন থেকে এসেছি হান্নান ভাইয়ের সাথে দেখা করবো।দীর্ঘদেহী খদ্দরের পাঞ্জাবি পরিহিত ধোপদুরস্ত একজন বলে ওঠলেন-“আমিই হান্নান।” কী চাই আমার কাছে।তাঁর কথা বলার ধরণে মনে হলো কর্তৃত্ব প্রবণ মানুষ তিনি।আমরাও সোজা বলে ওঠলাম-একুশের ম্যাগাজিন করবো ছাত্র ইউনিয়ন থেকে,কাজেই আর্থিক অনুদান দরকার।তিনি উত্তরে বললেন কে পাঠিয়েছে।আমি সোজাসাপটা জবাব দিলাম মালেক ভাই পাঠিয়েছেন।একটু চিন্তা করে তিনি বলেছিলেন আমি এখন ব্যস্ত,তাই কাল আসবে ১১-টার পরে তালতলায় রহমানিয়া হোটেলে-এটি আমার হোটেল।এই হলো তাঁর সাথে প্রথম পরিচয়।
পরবর্তী বছরগুলোতে এবং তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হান্নান ভাইয়ের সাথে কতবার যে-দেখা হয়েছে,রাজনীতির তত্ত্ব,ধর্ম-কর্ম-সমাজতন্ত্রের আবশ্যকতা,খাঁটি মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্হা কেন-আমাদের দেশে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়-ইত্যাকার নানা বিষয়েই তাঁর সাথে মতবিনিময় করেছি। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তাঁর ভূমিকা,অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সাথে পরিচয় ও তাঁর রাজনৈতিক সহচর হয়ে ওঠার গল্প,খদ্দরের পাঞ্জাবি পরিধানের কারণ এবং এমনকি নিজের পারিবারিক জীবন,চেয়ারম্যানশীপের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি ব্যাপক বিষয়েই তিনি গল্প করতেন।বিশেষকরে-জীবনের শেষ দিনগুলোতে-যখন তিনি অসুস্থ হয়ে প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে গৃহবাসী ছিলেন-সেইদিনগুলোতে প্রায় সময়েই তিনি ফোন দিয়ে ডেকে নিতেন।আমি আমার বন্ধু প্রিন্সিপাল জাহিদুল ইসলামকে সাথে নিয়ে শাহী ঈদগাহর সৈয়দপুর হাউসে গিয়ে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছি-রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলেছি ঘন্টার-পর ঘন্টা।
হান্নান ভাই এতো বেশি রাজনীতিপ্রবণ ছিলেন কারণে রাজনৈতিক আলোচনায় তিনি গভীরভাবে উৎসাহী ছিলেন।এতো দিনের পরিচয়-আলাপচারিতার মধ্যে একটি বিষয় আমি লক্ষ করলাম-তিনি তাঁর নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করেননি,তাঁর সম্পর্কে কোনো সমালোচনা করেননি।অর্থাৎ নেতা হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের প্রতি তাঁর গভীর আনুগত্য ও অন্ধ বিশ্বাস ছিলো আজীবন।তিনি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করতেন যে-মোজাফফর আহমদের মতবাদ-“ধর্ম-কর্ম-সমাজতন্ত্র”-এই নীতির ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্হায় পরিবর্তন ও রূপান্তর ব্যতীত গরীব-মেহনতি মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব নয় এবং এটিও বিশ্বাস করতেন এর কোনো বিকল্প নেই।তাই আমৃত্যু তিনি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের-“ধর্ম-কর্ম-সমাজতন্ত্র”-নীতির প্রতি একনিষ্ঠ অনুগত ছিলেন এবং আমাদের অনেককেই ওই মতে বিশ্বস্ত হওয়ার জন্য উদ্ভুদ্ধ করার চেষ্টা করে গেছেন।
হান্নান ভাই ধনাঢ্য এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক ছিলেন এবং তাঁর সম্পদের কোনো অভাব ছিলো না।তাঁর সন্তানেরা দেশ-বিদেশে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।কাজেই তাঁর পরিবার অভিজাত-এটি বলার অপেক্ষা রাখে না।কিন্তু তাঁর ব্যক্তি জীবনের চলনে-বলনে আভিজাত্যের অহমিকা কখনো চোখে পড়েনি।
দীর্ঘদেহী আকর্ষণীয় লোকটিকে আমি প্রায় চার দশক ধরে জানতাম,ঘনিষ্টভাবে চিনতাম-জানতাম।দীর্ঘ ওই সময়কালে মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবী, সাদামাটা পায়জামা,মাথায় সাধারণ মানের একটি ফেজটুপি এবং পায়ে অতি সাধারণ চপ্পল ব্যতীত দামী পোশাক-আশাক ব্যবহার করতে তাঁকে দেখিনি কখনো।অর্থাৎ আভিজাত্যের কোনো বালাই ছিলোনা তাঁর মধ্যে।প্রিন্সিপাল জাহিদ এবং আমি হান্নান ভাইয়ের বৈঠকখানায় নানা রাজনৈতিক আলোচনার ফাঁকে একদিন কৌতুহলবশত বলেই ফেললাম তাঁর পোশাক সম্পর্কে।কেন খদ্দরের পাঞ্জাবী ব্যবহার করেন-জানতে চাইলাম।আমার মনে আছে-তাঁর স্পষ্ট জবাব ছিলো- ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের আন্দোলনের সময়কালে খদ্দরের কাপড় ব্যবহারের যে হিরিক বাঙালি সমাজে পড়েছিলো তার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলাম এবং এখনো এইসব ব্যবহার করি টাকার অভাবে নয়,এইসব ব্যবহার করে চলেছি আমার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতী-শ্রমজীবি মানুষের সাথে সংহতি প্রকাশ করার জন্য।”যেদেশের লক্ষ-কোটি মানুষ না খেয়ে থাকে, ,সাধারণমানের কাপড় যোগার করে লজ্জা নিবারনেও অক্ষম,সেখানে আমি আভিজাত্যের বড়াই করতে পারিনা”-হান্নান ভাইয়ের স্পষ্ট জবাব।
২০১৪-সালে বিএনপি-জামায়েত জোট সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা চৌদ্দ দলীয় জোটের আন্দোলনের সময়কালে হান্নান ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হয়েছিলো।ওই জোটের জেলা ও মহানগর স্টিয়ারিং কমিটিতে আমরা সদস্য ছিলাম এবং মরহুম আনম শফিকুল হক ছিলেন আহবায়ক।আমার বাসা তখন বালুচরে থাকায় প্রায় সময়ই স্টিয়ারিং কমিটির সভায় বা আন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য যাওয়ার পথে শাহী ঈদগাহ থেকে হান্নান ভাইকে নিয়ে যেতাম বা একসাথে ফিরেও আসতাম।এই সুবাদে তাঁর সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক অনেক গভীর হয়েছিলো।আনম শফিক ভাই এবং কলন্দর আলী ভাইয়ের সাথেও আমাদের সম্পর্ক ছিলো খুবই ঘনিষ্ট এবং চমৎকার।আমরা চারজন প্রায়ই একসাথে রাজনৈতিক আড্ডা দিয়েছি এবং আলোচনা করতাম দেশের ভবিষ্যত নিয়ে।শফিক ভাই আওয়ামী লীগের হলেও তাঁর চিন্তা-চেতনা ও মননে উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও বাম সমাজতান্ত্রিক ধারার প্রভাব ছিলো বেশি।বাকী তিনজন আমরা মূলত বামধারারই লোক।এই কারণে আমাদের চারজনের মধ্যে একটি সহমত ছিলো বিধায় রাজনীতি নিয়ে একটি জায়গায় আমরা একমত ছিলাম যে,রাষ্ট্র ও সমাজের রূপান্তর ও গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বাম মতবাদের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন ছাড়া সম্ভব নয় এবং চৌদ্দ দলীয় জোটের মাধ্যমেও সেটি সম্ভব নয়। এর জন্য বিশ্বস্হ এবং গ্রহণযোগ্য নেতা ও বামদলগুলোর একতা দরকার।নেতৃত্বের প্রশ্ন এলেই হান্নান ভাই অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতেন।আমরা অবশিষ্ট তিনজন দ্বিমত করতাম,আমি বলতাম অধ্যাপক সাহেবের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল-কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগের প্রতি নতজানু। তাছাড়া তাঁর ধর্ম-কর্ম-সমাজতন্ত্র ধারণা দেশের মানুষকে গেলানো যাবে না-এতে হান্নান ভাই উত্তেজিত হয়ে বলতেন-তোমাদের নিয়ে মেহনতি-গণমানুষের অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক তথা সার্বিক মুক্তির আন্দোলন করা অসম্ভব এবং এমনকি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মান করাও যাবে না,তোমরা বুর্জোয়া।পত্রিকায় আমার কলাম লেখার প্রসঙ্গ টেনে হান্নান ভাই বলতেন-ও বাদ হয়ে গেছে,আমেরিকাপন্হী হয়ে গেছে, কেন যে ছাত্র ইউনিয়ন করলো। তখন কলন্দর আলী ভাই খোঁচা দিয়ে বলতেন-খদ্দর পড়লেই বামপন্থী হওয়া যায় না।এতে সমর্থন করতেন শফিক ভাই। এইভাবেই রাজনৈতিক আড্ডায় আমরা অনেক সময় কাটিয়েছি।আমাদের দুই শ্রদ্ধাভাজন নেতা শফিক ভাই এবং হান্নান ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কলন্দর আলী ভাইও অসুস্থ।তাসত্ত্বেও মাঝে-মধ্যে তিনি আমাকে ফোন দিয়ে বলেন-খান আপনার জন্য আমার মনে টানে,কিন্তু আসতে পারি না ভাই আমার জন্য দোয়া করবেন।
হান্নান ভাইয়ের বড় আক্ষেপের জায়গা ছিলো ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের বহুধা বিভক্তি।ওই সংগঠনগুলোর ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে তিনি আমাকে এবং আব্দুল মোনায়েম নেহরু ভাইকে প্রায় সময়ই তাগিদ দিয়েছেন।তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখে যেতে আশাবাদী ছিলেন এবং জীবদ্দশায় তাঁর সেই আশার প্রতিফলন ও মেহনতী-গণমানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তি এবং শোষণমুক্ত সমাজ দেখে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়েও রাজনৈতিক আলোচনাশ শংকা প্রকাশ করতেন।তাঁর শংকাই বাস্তব হলো-তাঁর মনের গভীরে অংকিত বাংলাদেশ তিনি দেখে যেতে পারেননি।
লেখকঃগণফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক,সিলেট জেলার আহবায়ক।