
” ঢাকা আমার খুব প্রিয় শহর, কিন্তু আমি থাকি
আজিমপুর নামক একটি গ্রামে ;
খুব ছোট খাটো একটি গ্রাম,বলা চলে শান্ত , স্নিগ্ধ ছোট একটি পাড়া
ঢাকা আমার খুব প্রিয় শহর, কিন্তু আমি পছন্দ করি গ্রাম – আজিমপুরের এই খোলা মাঠ, এই সরু গলি
ঢাকার মানুষ– আজিমপুরের এই ছোট্ট গ্রামেই থাকতে ভালোবাসি ।
পৃথিবী আমার খুব প্রিয়, কিন্তু আমি বাঙলাদশে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”
“মহাদেব সাহা”
আমার জন্ম, সোনালী স্বর্ণ বেলা কেটেছে আজিমপুরে— আজিমপুর আমার প্রথম প্রেম দ্বিতীয় জনীন ।আমার যত আবেগ, যত মমতা , ভালোবাসা আজিমপুর ঘিরে ।
মানুষের এক মাত্র স্বর্গ , যেখানে সে অবাধে বিচরণ করতে পারে– সে স্বর্গ আমার ছেলে বেলা,যৌবন বেলা, আমার আজিমপুরের বেলা।
এটা সাহিত্য নয়, তাই সাহিত্যের সৌকর্যের ভাবনা নেই।এখানে আমি আমার মনের মাধুরী মিশিয়ে বিচরণ করতে পারি আমার স্বর্ণ বেলায় ।
কি সুন্দর ছিল আমাদের কলনীর জীবন।যৌথ জীবন সম্মিলিতভাবে বেঁচে থাকার আনন্দ, মধ্যবিত্তের মুল্যবোধ, জীবনবোধে,যাপিত জীবন।
সরদার ফজলুল করিম তার “দি রুটস” লেখোনিতে উল্লেখ করেছেন “মানুষের মুক্তি তার অস্তিত্বে ।ব্যক্তি বা জাতি যে ভাবেই দেখিনা কেন , শক্তি তার শেকড়ে।কত গভীরে সে প্রবিষ্ট হয়েছে তার উপর।মানুষের শেকড়ের মাটি আক্ষরিক অর্থে মাটি নয়।মানুষের শেকড়ের মাটি তার অভিজ্ঞতা, তার ইতিহাস, তার অতীত ।যার ইতিহাস নেই,অতীত নেই সে শেকড় হীন , শূন্য লতার মতো।যে মানুষ ৠদ্ধ হতে চায় তার উচিত তার শেকড় অন্বষনে।” আমার শেকড় আজিমপুর ।
প্রত্যক জাতি গোষ্ঠীর একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে প্রেক্ষাপট।আজিমপুরের তেমনি একটা পূর্ব ইতিহাস আছে।
আজিমপুর প্রতিষ্ঠা পায় মোঘল আমলে।আজিমপুর নাম করণ নিয়ে দ্বিমত আছে। কারো মতে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা আযম খানের নাম অনুসারে কেউবা বলেন পৌত্র আজিমুলের নামের সাথে মিল রেখে।
শাহজাদা আযম বাঙলার সুবেদার ছিলেন ১৬৭৮-৭৯
সাল পর্যন্ত ।আজিমুশাহ বাঙলার সুবেদার ছিলেন ১৬৯৭- ১৭০৩ সাল পর্যন্ত ।
মোগল আমলে বিশ শতকে রাজ কর্মকর্তা কর্মচারিদের বাসস্থান তৈরি হয়েছিল আজিমপুরে।ব্রিটিশ আমলে তা পরিত্যক্ত হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর শান্তির শহর ঢাকা হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী । দলে দলে লোক তখন ঢাকামুখী।প্রশাসনের প্রয়োজনে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের আবাসন প্রয়োজন ।প্রাদেশিক রাজধানীর পরিকল্পনা দায়িত্ব পেলো ইংরেজ স্হপতি কোলম্যান হিক্স।কোলম্যান হিক্স তার দল পশ্চিমের লালবাগের আগ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ আজিমপুর এলাকা নির্ধারণ করলেন সরকারি কোয়ার্টারের জন্য । চড়ক শাল আচ্ছাদিত জলা জঙ্গল পরিস্কার করা হলো।

পরিকল্পনা প্রনয়নকারি,বৃটিশ স্হপতি হিক্সের এ দেশের বাসস্থান তৈরিতে ধর্মীয়, সামাজিক ,চাহিদা তার কাছে অদ্ভুত লেগেছিল।শৌচাগারের পাশে ,রান্না ঘরের অনুমোদন ছিল না।শয়নকক্ষের পাসে বারান্দা থাকা জরুরী ছিল এবং বারান্দা থেকে অন্দর মহল যেন দেখা না যায় ।স্নানকক্ষ,শৌচাগার পৃথক করার নির্দেশ ছিল।সাধারণ পর্যায়ে, তখনো চেয়ার টেবিল বসে খাওয়ার রীতি শুরু হয়নি।রান্না ঘর বা তার পাশে , কোন স্থানে , মেঝেতে আসন পেতে,খাবার খাওয়ার রেওয়াজ ছিল।ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে, মক্কা বা পশ্চিম দিকে, সামনে বা পেছনে শৌচাগার স্থাপন সম্ভব ছিল না।শয়ন কক্ষের বিন্যাস পশ্চিম দিকে পা দিয়ে শুতে হয়,এমন ভাবে করা বারণ ছিল।( এটা এখন প্রচলিত) এর ফলে বাস ভবন তৈরিতে তার অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল।
আজিমপুর এস্টেট নির্মাণ প্রকল্পটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি পথ প্রদর্শন পদক্ষেপ ছিল।খুব অল্প সময়ে প্রকল্পটি শেষ করা হয়।চারটি ব্লকে —
তিন কক্ষ বিশিষ্ট ৪৮ টি দুই কক্ষ বিশিষ্ট ৪৫ টি ফ্ল্যাট এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ব্যায় নির্ধারণ হয়েছিল ৭৫ লক্ষ টাকা।১৯৪৯ এর জানুয়ারীতে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ঐ বছর অক্টোবরে।সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের উদ্যমী প্রকোশলীদের একাগ্রতা দপ্তরের প্রধান প্রকোশলী খান বাহাদুর মোহম্মদ সোলায়মান এর নেতৃত্বে।আজিমপুর কলনী গন্য হয়েছিল সে সময়ের সমজাতীয় সরকারি আবাসিক এলাকার পথ প্রদর্শক প্রকল্প হিসাবে।(তথ্য লন্ডন থেকে প্রকাশিত Building November 1950 সাময়িকী Colman Hicks O Flats in Dacca প্রবন্ধ)
আজিমপুর কলোনী ঘিরে গড়ে উঠেছিল ছাপড়া, মসজিদ, বাচ্চাদের স্কুল লিটিল এঞ্জেল স্কুল, ছেলেদের মাধ্যমিক ওয়েস্টেন্ড স্কুল , মেয়েদের আজিমপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়,ইডেন কলেজ, হোমইকনোমিক্স কলেজ। ম্যাটারইনিটি, আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টার ।( প্রথম পর্ব )
লিনু হক, সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী এবং মুক্তিযোদ্ধা ।