চ্যান্সেলর ম্যার্কেল শনিবার তাঁর ৬৭ তম জন্মদিন উদযাপন করেছেন। তবে চ্যান্সেলর অফিসে তার শেষ জন্মদিনের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিলো: বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সাথে (ভাই মার্কাস, বোন আইরিন সহ) একটি ছোট পারিবারিক উদযাপন।

তবে নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়া এবং রাইনল্যান্ড-প্যালাটিনেটে বন্যার বিপর্যয় অ্যাঙ্গেলা মের্কেল তার জন্মদিন  উদযাপনের পরিবর্তে: সংকট হিসেবে, বিশেষ সভা করেছেন। গতবছর ১৭ জুলাই একবার লিখেছিলাম, তবে এবার জার্মান চ্যান্সেলর হিসেবে তাঁর শেষ জন্মদিন, কারণ সেপ্টেম্বরে তিনি আর চ্যান্সেলর থাকবেননা।

অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সম্পর্কে ইতিমধ্যে বেশ কিছু ঘটনা জানা যায়: তিনি বাস্তববাদী মানুষ, মোটেও অহংকারী নন, স্বামীর সাথে থিয়েটার অপেরাতে যেতে পছন্দ করেন এবং প্রতিবছর একই জায়গায় ছুটি কাটাতে পছন্দ করেন। যাইহোক, চ্যান্সেলরের জীবন সম্পর্কে আরও অনেক পরিচিত তথ্য রয়েছে, যিনি ১৭ জুলাই তাঁর ৬৭ তম জন্মদিন এক অনাড়ম্বর পরিবেশে উদযাপন করেন।

নিম্নলিখিত কয়েকটি কারন তাঁকে জনগনের অনেক কাছে পৌঁছে দিয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেঃ

তিনি তাঁর ক্ষমতা টিকে রাখতে পঞ্চম বারের জন্যে কল্পনা না করে আগামী ইলেকশনে না দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ইতিমধ্যেই তিনি দলের (সিডিইউ) প্রধানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন: চ্যান্সেলর ম্যার্কেল করোনার মহামারী শুরুর পর থেকেই একটি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। সংক্রমণ এবং ভুক্তভোগীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার পরে ফেডারেল প্রজাতন্ত্রের সমস্ত জনজীবন বন্ধ ছিল, দেশটি তিন মাস সম্পূর্ণ লকডাউন ছিল, যার পরিণতি চ্যান্সেলর এবং তার অনেক কলিগদের দীর্ঘ সময়ের জন্য কোয়ারেন্টাইন করে থাকতে হয়। তা সত্ত্বেও, তিনি তার সাময়িকভাবে বাড়িতে পৃথক পৃথক অবস্থায় থাকাকালীন এবং সেখান থেকে সরকারী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হয়েছিল, যদিও তার প্রচলিত সংবেদনশীল ব্যবহার এর জন্য পরিচিত ম্যার্কেল বেশ শান্ত ছিলেন।

নজিরবিহীন সংকটের মধ্যে নাগরিক জীবন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ ঠিক রাখতে জার্মানি থেকে ম্যার্কেল বিস্তৃত অর্থনৈতিক প্রণোদনা  (প্রায় এক ট্রিলিয়ন ইউরো) অনুমোদন দিয়ে জনগনের বিশ্বাস ও আস্থা উপভোগ করছেন। সম্প্রতি আবার সমালোচনাও কুড়িয়েছেন। কারণ: প্রথমদিকে তার উপস্থিতিতে ম্যার্কেল মুখ-নাক সুরক্ষা পরেন নি। একটি সংবাদ সম্মেলনে, সিডিইউ রাজনীতিবিদ, যিনি তখন থেকে একটি মুখোশ পরেছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে ম্যার্কেল “দূরত্বের নিয়মগুলি মেনে চলছেন” কাজেই তখন তাকে সুরক্ষা পরিধান করতে হবে না।

জনগনের আস্থাভাজন এর কয়েকটি কারনের প্রথমটি হলোঃ দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে তিনি ২০২১ সালে চ্যান্সেলর হিসেবে আর নির্বাহী চেয়ারে না বসে তার আসনটি খালি করবেন, এটা অবশ্য তিনি একবছর আগেই ঘোষণা দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই দলের প্রধান থেকে ইস্তাফা দিয়েছেন।

শনিবার (১৭ জুলাই), ম্যার্কেল, তিনি তার ৬৭ তম জন্মদিন উদযাপন করছেন। তিনি এই দিনটি কিভাবে উদযাপন করলেন? সন্তানহীন অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল তার স্বামী ইয়োখিম জাউয়ার (৭১) এর সাথে ঘড়োয়া ভাবেই কাটাবেন তিনি বলেছেন, স্বামী ইয়োখিম জাউয়ার, বার্লিন হুম্বোল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ান্টাম রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক এবং বার্লিনে তাঁর সাথে একটি ৫ রুমের এপার্টমেন্টে বসবাস করেন তিনি, সরকারি চ্যান্সেলর বাংলোতে তিনি থাকেননা, শুধু অফিস করেন। সম্ভবত তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের   সাথেও চ্যাট করছেন, তবে এসব খবর পত্রিকায় ছাপা হয়না, অথবা চ্যান্সেলর ৬৭ তম জন্মদিনে রাষ্ট্রীয় ভাবে কোনো অনুষ্ঠান  হয়নি। হতে পারে যে তিনি এক গ্লাস চেরি ভদকার  সাথে একান্তভাবে তাঁর স্বামীর সাথেই দিনটি উদযাপন করছেন, যে পানীয়টি অল্প বয়স্ক ছাত্র থাকা অবস্থায়ও  অ্যাঙ্গেলা উপভোগ করতেন।

কেন তিনি তাঁর স্বামীর পারিবারিক নাম আজও রাখেন নি তা নিম্নলিখিত তথ্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। ইউনিভার্সিটি পার্টিতে তিনি “আমি বারমিড ছিলাম” কাউন্টারটির পিছনে ছিলাম, অ্যাঙ্গেলা মের্কেল সাত বছর আগে একজন ‘চিত্র’ প্রতিবেদককে বলেছিলেন যখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সাবেক পুর্ব জার্মানিতে ছাত্র জীবনে, (কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী) সমাজতান্ত্রিক দলে তাঁর কাজ কী ছলো? এই প্রশ্নের জবাবে অ্যাঙ্গেলা মের্কেল বলেন “ব্যাকগ্রাউন্ডে, প্রায়শই পশ্চিমা সংগীত শুনতাম”। অ্যাঙ্গেলা পশ্চিমা শিল্পীদের মধ্যে, বিটলস এবং রোলিং স্টোনকে পছন্দ করতেন। সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন: “আমি মস্কোতে আমার বিটলসের প্রথম এলপি রেকর্ড কিনেছিলাম।”

তিনি এখনও তার প্রথম স্বামীর শেষ নাম (ম্যার্কেল) রাখেন কেনো? অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল ১৯৫৪ সালে হামবুর্গের এক যাজক এর কন্যা অ্যাঙ্গেলা কাসনার হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, অ্যাঙ্গেলার ৬ বছর বয়সে তাঁর বাবা পূর্ব-জার্মানির মেক্লেনবুর্গে এক চার্চে যাজক হিসেবে চাকুরী করেন, সেই থেকে তিনি সমাজতান্ত্রিক জার্মানির বাসিন্দা ছিলেন। দুই জার্মানি একত্র হবার দশ বছর পরে ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি কোয়ান্টাম রসায়নবিদ ইয়োখিম জাউয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, যার সাথে তার ১৪ বছর আগে দেখা হয়েছিল। পারিবারিক নাম ‘ম্যার্কেল’ তাঁর প্রথম স্বামী উলরিখ ম্যার্কেল এর, যার সাথে তিনি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বিবাহিত ছিলেন

বার্লিন প্রাচীরের পতনের রাতে, তিনি সংক্ষিপ্তভাবে উদযাপন করলেন এবং খুব শীঘ্রই ঘুমাতে চলে গেলেন ১৯৮৯ সালে বার্লিনের প্রাচীরটি যখন ভেঙ্গে যায়, কয়েক হাজার মানুষ ভোরের প্রথম দিকে উদযাপন করেছিলেন – তবে অ্যাঞ্জেলা মের্কেল নয়, তখন তার বয়স তখন ৩৪ বছর।

২০০৫ সালে ফেডারেল চ্যান্সেলর নির্বাচিত হওয়ার আগে অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল দু’বার ‘হেলমুট কোল’ মন্ত্রীপরিষদে একবার ফ্যামিলি ও ইয়ুথ এবং একবার পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রী ছিলেন, এরপর তিনি তিনবার চ্যান্সেলর নির্বাচনের পদপ্রার্থী হিসেবে “প্রথম” হয়েছিলেন। সাত জন চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের আগে দেশের ভাগ্য অর্জন করেছিলেন, তারা সবাই পুরুষ ছিলেন। ২০০৫ সালে তার নির্বাচনের সাথে পদার্থবিজ্ঞানী জার্মান ইতিহাসের প্রথম ফেডারাল চ্যান্সেলর এবং এই পদে অধিষ্ঠিত প্রথম বিজ্ঞানী হন। তার পূর্ব জার্মানির শেকড়গুলির জন্য তিনি আজো ধন্যবাদ দেন, অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল নতুন ফেডারেল রাজ্যগুলি থেকে আসা প্রথম চ্যান্সেলর। তিনি বয়সে তার পূর্বসূরিদের থেকেও আলাদা ছিলেন – মাত্র ৪৫ বছর বয়সে দলের প্রধান ও ৫১ বছর বয়সে চ্যান্সেলর, শপথ গ্রহণের সময় সবচেয়ে কম বয়সী চ্যান্সেলর ছিলেন ম্যার্কেল।
বারাক ওবামাকে বিদায় জানানোর সময় তিনি তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন দারুনভাবে, তাই মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা তাঁর বিদায়ী সফরে বার্লিনে শেষ যাত্রা করেছিলেন। ওবামার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা বেন রোডস তিন বছর পরে তাঁর “ইন হোয়াইট হাউস: বার্স ওবামার সাথে ওবামা” বইটি এই সফরটি কীভাবে চলেছিল – এবং তার বস এবং অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের মধ্যে সম্পর্ক সম্পর্কে আকর্ষণীয় তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। তিনি লেখেন, তাদের দু’জন তিন ঘন্টা একসাথে ডিনার করছেন সারা পৃথিবীর সমিস্যা নিয়ে কথা বলেছন; ওবামা তার মেয়াদকালে আর কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে খাওয়া-দাওয়ার চেয়ে বেশি সময় ধরে বসে ছিলেন না। বিদায় সময়ে, “একক অশ্রু” তার চোখে ঝলমল করেছিলো, যা স্ব-নিয়ন্ত্রিত অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের পক্ষেও বিরল ছিলো।

অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল শুধু নিজ দেশেই নয়, সারা বিশ্বে একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতার আসন দখল  করেছেন, ইউরোপের প্রতিবেশি ফরাসি, ইটালি সহ সকল দেশের সাথে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, একসময় “ম্যার্কোজি” নামে ম্যার্কেল- সার্কোজি জুটি ফরাসি জার্মান সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করেছেন। এসব কিছুই অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল একঅক নিজের সাফল্য বলে মনে করেন না, তার ১৫ সদস্যের মন্ত্রীসভা আর পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তেই, করোনা মহামারীতেও জনগনের আস্থা অর্জন করেছেন, প্রতিটি শ্রমিক, কর্মচারী তাদের মাসিক বেতন পেয়েছে, খাদ্যউপাদান নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলেছে, এমনকি ইটালি স্পেন থেকে শত শত কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষদেকে জার্মানিতে স্পেশাল প্লেনে নিয়ে এনে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে। সর্বপরি জার্মান স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিনামূল্যে জনগনের দারপ্রান্তে পৌছে দিয়ে করোনা মোকাবেলা করায় এখনো ইউরোপের শীর্ষ স্থানে আছে দেশটি, করোনা মহামারীতে মৃত্যুর হার পশ্চিম ইউরোপে সবচেয়ে কম, কিন্তু অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল সেসবে তাঁর নিজের কৃতিত্ব মনে করেন না। ইতিমধ্যেই জার্মানিতে ৬০% জনগনের ভ্যাক্সিন দেওয়া শেষ হয়েছে এবং দীর্ঘ দেড়বছরের প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ইউরো জনগন ও উদপাদনশীল কোম্পানিকে প্রণোদনা  দিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন।

আমি ১৫ বছর আগে ম্যার্কেল সমর্থক ছিলামনা, কিন্তু বিগত কয়েক বছর তাঁর রাজনীতিক জীবন ও ব্যক্তিগত ভাবে একবার দেখা করার সুযোগে, তাঁর প্রতি একটা আস্থাভাজনতা ও সহনশীলতা গড়ে উঠেছে, তাই তাঁর চ্যান্সেলর হিসেবে এই শেষবারের মতো জন্মদিনে বিস্তারিত পর্যালোচনা করলাম। Happy Birthday Angela ♥

ছবি সুত্র, source: Bundes Presseamt .


মীর মোনাজ হক

সাংবাদিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক , বার্লিন জার্মানি ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading