দুশ্চিন্তা ও টেনশনে  সময় যে কিভাবে চলে যাচ্ছে বুঝে উঠতে পারছেন না দেশের শীর্ষ স্থানীয় শিল্পপতি রফিক মল্লিক। কভিড- ১৯ এবং লক ডাউনের তাণ্ডবলীলায় ব্যবসা- বানিজ্য তছনছ হয়ে যাওয়ার উপক্রম, শ্রমিক- কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন ও আনুসাঙ্গিক সুযোগ- সুবিধাসমুহ ঠিক মতো চলছে না। ব্যাংক ও বিভিন্ন  আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে দিন দিন। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির সুদ- আসলের পরিমান ও নিয়মিত কিস্তিও কম নয়। সিআইবির  অবস্থাও সংকটজনক। একটা ঠিক হয়তো আরেকটা বেঠিক হয়ে যায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ এর বকেয়া জমা পড়েছে বিপুল হারে।  কখনো লাইন কাঁটছে আবার কখনো সাময়িক চালু হচ্ছে। জোড়াতালির এ খেলা আজ নিত্যনৈমত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাতের ঘুম, দিনের স্বল্পকালীন বিশ্রাম সবই যেন নিয়মের বাইরে চলে গেছে।

ঘড়ির কাটা টিক টিক করে চলছে এবং এক সময়ে ঘন্টা বাজিয়ে ঘোষনা করলো সময় রাত একটা।।স্ত্রী গভীর নিদ্রামগ্ন। মনে মনে ভাবলেন ” এক কাপ কফি হলে ভালো হতো”। নিজেই কিচেনে ঢুকে কফি বানিয়ে নিলেন এবং চেয়ারে ধীর- স্থীর হয়েে বসলেন। কফির কাপ ঠোঁটের কাছে  নিতেই লক্ষ্য করলেন একটা পোকা কফির জলে হাবুডাবু খাচ্ছে, বাচার আপ্রান চেষ্টা করছে। অবাক হলেন, ভাবলেন এতো সুন্দর, পরিস্কার ও পরিপাটি কিচেনে পোকা আসলো কোথা থেকে? কাজের লোকগুলো কি এ সব বিষয়ে একেবারেই বেখেয়াল?  স্ত্রীও কি সার্বিক পরিস্থিতিতে কিচেনের কোন খোঁজ খবর নিতে পারছে না? সময় স্বপক্ষে না থাকলে হয়তো এমনি হয় আর কি! কফি আর পান করা হলো না।

পায়চারি করতে লাগলেন রুমের ভিতরেই। বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বাগানের বিভিন্ন ধরনের গাছগুলো যেন বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে এক মহা সংগীতের ঐক্যতান রচনা করে চলছে। মনটা বেশ কিছুটা ফুরফুরে ও চাঙ্গা হয়ে উঠলো। জানালার সামনে এগিয়ে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী উপভোগ করতে লাগলেন।

“বাহ্ কি অপরুপ সুন্দর এ প্রকৃতি। বহুদিন এ দৃশ্য দেখা হয়নি। সেই বাল্যকালে মামা বাড়ীতে যখন  সকলের সাথে বেড়াতে যেতাম তখন এ দৃশ্যাবলী চোখে পড়তো।অথচ নিজের বাড়িতেই যে সে সম্পদ পড়ে আছে তা কখনো নজর দেই নি। ধন- সম্পদের নেশায় শুধু গড়েছি কিন্তু এর সৌন্দর্য ও প্রয়োজনীয়তার যৌক্তিকতা নিয়ে নিজেকে কোন প্রশ্ন করি নি।” আকাশে মাঝে মাঝে বিজলী চমকাচ্ছে। বিজলী চমকানো ইদানিং জনমনে ভয়- ভীতির সঞ্চার করেছে কারন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। এটা মনে আসতেই তিনি জানালার সামনে থেকে সরে আাসেন। মন স্থীর থাকছে না, অবুঝ শিশুর ন্যায় ব্যবহার করছে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  ভাযায় ” হেথা নয়, অন্য কোথা,অন্য কোথা, অন্য কোনখানে”। “মনের উপর কারো হাত নেই, মনের উপর জোর খাটানোর চেষ্টা করা বৃথা”–ম্যাকডোনাল্ড।

স্ত্রী আজ তিন মাস ধরে অসুস্থ এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসাধীন আছেন। সাধারনতঃ রাতের ঔষধ খাওয়ানো ও পরিচর্যার কাজটা তিনিই করে থাকেন। ঔষধ খাওয়ানোর সময়ের আগেই স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেলে স্বামীকে পায়চারিরত অবস্থায় দেখতে পান। স্বামীর অস্থিরতা সম্পর্কে তিনি সবই জানেন। স্বামীর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন অপলকনে এবং ডাক দিয়ে বললেন “কি করছো, এভাবে পায়চারি করছো কেন? তোমার তো ঘুমের প্রয়োজন।”

“আমার আবার ঘুম ও জেগে থাকা।  জীবনের সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। কি হবে কিছুই বুঝতে পারছিনা।” আক্ষেপের সুরে জবাব দিলেন রফিক মল্লিক । ঔষধ খাওয়ানোর পর্ব শেষ হলে স্ত্রীও আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। এর পরপরই মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলেন একমত্র মেয়ে স্বপ্না আমেরিকা থেকে কল করেছে। হ্যালো বলতেই স্বপ্না কেঁদে দিয়ে বললো “আব্বু তুমি কেমন আছো, আম্মু  কেমন আছে ?”

মেয়ের কন্ঠ যে কোন পিতা-মাতার কাছেই শ্রুতিমধুর ও কাঙ্ক্ষিত । তার উপরে যদি হয় একমাত্র মেয়ে এবং বিদেশে অবস্থানরত। বিশেষতঃ পিতা- কন্যার বিরল আত্মীক ও চুম্বকীয় সম্পর্ক নিয়ে সৃষ্টির শুরু থেকে নানা ধরনের প্রবচন প্রচলিত রয়েছে দেশে- দেশে, সমাজে- সমাজে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে। ইসলামের ইতিহাসে রসুল হযরত মোহাম্মদ(সঃ)এর কন্যাদের,উল্লেখযোগ্যভাবে কন্যা ফাতেমার (রাঃ)সাথে গভীর স্নেহ- ভালবাসার কথা কিংবদন্তি হয়ে আছে। স্বপ্না তেমনি চেতনা ও ভাবে পিতা রফিক মল্লিকের প্রাণ।

” ভালো আছি, আম্মু আমরা। তুমি কেমন আছো?

“ভালো। তোমাদের কথা মনে পড়ে সব সময়। মনে হয় এখনই চলে আসি। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর আসা যায় না। হাজারোটা সমস্যা সংসার ও  পরিবার নিয়ে।”

” আমার বাবা, নানা ও নানু মনিরা সব ভালো আছে তো?

“হ্যা আব্বু  সবাই ভালো ও সুস্থ আছে। আমারা আল্লাহর কৃপায় এখন বলা যায় করোনা ঝুঁকি মুক্ত। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নাকি খারাপের দিকে যাচ্ছে?”

” হ্যা তাই। তবে মনে রাখতে হবে ছাপান্ন হাজার বর্গ  মাইল এলাকার বাংলাদেশে বিশ কোটি লোকের ভারের তুলনায় পরিস্থিতি ইউরোপ ও আমেরিকার মতো ভয়াবহ নয়। তবে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং

মৃত্যুর হারও বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের এখানকার  এক বিশেষ সমস্যা হলো ব্যক্তিগত দূুরত্ব ও সামাজিক দুরত্ব(স্যোসাল ডিস্ট্যান্স) ও লকডাউন  শব্দগলোর সাথে জনসাধারনের ব্যাপক কোন পরিচিতি নেই। বিপরীতে এগুলোর পূর্ব শর্ত সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে উন্নত বিশ্বে যেভাবে মেনে চলা হয় আমাদের এখানে বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারনে সরকার কোনভাবেই জনগনের খাদ্য সরবরাহ ও চিকিৎসাার দায়িত্ব নিতে পারবে না। ধর্মপরায়ন জনগোষ্ঠীর বড় ভরসাই তো সৃষ্টি কর্তা।

নিয়ম মোতাবেক সরকারী ও বেসরকারী প্রচেষ্টা চলছে।আবার পাশাপাশি অব্যস্থাপনা ও দুর্নীতিও বেশ ভরে আছে।  মুল কথা কি জানো, জাতি হিসেবে এখনো আমরা সততা, আদর্শ ও দেশপ্রমকে ধারন ও লালন- পালনে অনেক পিছিয়ে আছি। আত্মকেন্দ্রিকতা, হীনমন্যতা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আর আমারাও গড্ডালিকা প্রবাহের ন্যায় নিজেদের সিক্ত ও প্রলেপিত

করে যাচ্ছি, ইচ্ছায়- অনিচ্ছায়। মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বালাদেশের জন্য এটা এক অশনি  সংকেত। রাজনীতি, সুষ্ঠু নির্বাচন,ভোটাকাধিকার প্রয়োগ করা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্মীয় ও সামাজিক মুল্যবোধ আজ নানামুখী, বিচিত্রতর অবক্ষায় ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কোথায়ও কোন জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতার নিয়ম কাঠামো স্থীর ও চলমান নেই। আমাদের সবই আছে আবার কিছুই নেই। আম্মু, এতো কিছুর পরও আমরা সচল ও এগিয়ে যাচ্ছি। জিডিপি গড় প্রবৃদ্ধি ৭%, মাথাপিছু গড় আায় ২২০০ মার্কিন ডলার, বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ  ৪৭ বিলিশন মার্কিন ডলার যা দিন দিন বেড়েই চলছে প্রধানত তৈরী পোশাক রফতানি  ও রেমিট্যান্সের জন্য, বিদুৎৎ,কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে সফলতা, গড় আয়ু ৭০ বছরে উন্নীত হওয়া,সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর ব্যাপ্তি, মানব উন্নয়ন সুচকের উর্ধগতি, বহুমাত্রিক উন্নয়ন ও সম্পর্কের কানেক্টিভিটি সৃষ্টি  ইত্যাদি বিষয়গুলো সহজেই প্রতীয়মান। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন অতি বৃষ্টি, ঝড়, ঘুর্নীঝড়, জলোচ্ছ্বাস নানা রকমের বিপদ- আপদ  নিত্যদিনের সাথী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে প্রকৃতিও আগের মতো বন্ধু ভাবাপন্ন থাকছে না। আশার কথা হলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সফলতা দেশে- বিদেশে স্বীকৃতি পাচ্ছে। “তলাবিহীন ঝুঁড়ি” আখ্যায়িত বাংলাদেশ আজ “দৃঢ় তলাযুক্ত অর্থনৈতিক দেশ” হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। অতি জনসংখ্যা দেশ হলেও দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যসঙ্কটের দেশ আর নয় বংলাদেশ।

জাতিসংঘের গৃহীত মানদন্ডে এ বছরই বংলাদেশ মধ্যেম আয়ের দেশের প্রাথমিক স্তরে পদার্পন করলো। এটাকেই বিশ্ব বাাংক, আইএমএফ, আইডিবি, জাইকাসহ উন্নত বিশ্ব আখ্যায়িত করেছে “মিরাকেল” বলে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ হলো দক্ষিন এশিয়ার দ্বীতিয় উদীয়মান এশিয়ান টাইগার। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।”

“আব্বু, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি বিশেষতঃ বাংলাদেশ- ভারত ও বাংলাদেশ- চীন নিয়ে নানামুখী সংকট ও চ্যালেঞ্জের কথা শুনছি এবং পাশাপাশি বহ ধরনের মুখরোচক কথা- বার্তা লোকমুখে চলমান

রয়েছে। এ সম্পর্কে অনেক আমেরিকান ও বিদেশী পরিচিতরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, জানতে চায়। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে?”

” আম্মু, তুমি নিজেও রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও মাসটার্স একজন মেধাবী ছাত্রী ছিলে এবং আমেরিকায় পিএইচডি করে সেখনে আজ একজন স্বনামধন্য অধ্যাপকে অধিষ্ঠিত হয়েছো। তাই এসব বিষয়ে তোমার গভীর আগ্রহ আমাকে বেশ আনন্দ দেয় বৈকি।

অল্প কথায় বলা যায় যে ভূরাজনীতির সার্বিক বিবেচনায় ভারত-চীন বৈরী সম্পর্ক  যে কোনভাবেই  বাংলাদেশের উপর প্রভাব ফেলাটাই স্বাভাবিক। ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী এবং দক্ষিন- পুর্ব কোনের সামন্য অংশ( মায়ানমার- বাংলাদেশ সীমান্ত ১৯৩ কিলোমিটার ) এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ছাড়া বাকী তিনদিকেই ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত।বাংলাদেশ- ভারত আন্তর্জাতিক সীমানার পরিমান ৪১৫৬ কিলোমিটার।  অন্যদিকে,চীনের সাথে বাংলাদেশের কোন সীমান্ত নেই, সে দৃষ্টিকোন থেকে চীন আমাদের  দুরবর্তী প্রতিবেশী। তবে চীনের সাথে মায়ানমারের সীমান্তের পরিমান ২১০০ কিলোমিটার। যেহেতু মায়নমার ও বাংলাদেশ ভৌগলিক সীমান্ত দ্বারা যুক্ত এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে বাংলাদেশ যেমন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার সেতুবন্ধন তেমনি মায়ানমারও দক্ষিণ পুর্ব  ও দক্ষিণ এশিয়ার সেতুবন্ধন। চীন- মায়ানমার সম্পর্ক আবার ঐতিহাসিক গভীরতায় গ্রোথিত এবং মায়ানমারকে এ অঞ্চলে চীনের এক হাতিয়ার বলা যেতে পারে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের ভুমিকা এ জন্যই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

আগামীর বিশ্বশক্তি হিসেবে চীন দ্রুত বিকশিত হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ইতোমধ্যে তার অবস্থান সুদৃঢ়, সুসংহত এবং স্বীকৃত। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক বিশেষভাবে শেখ হাসিনা সরকারের সময় ২০০৯ সাল থেকে বহুমুখী ও বহুমাত্রিক অবয়বে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে অবিশ্বাসভাবে যদিও এর যাত্রা শুরু হয় পচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ৩১ আগস্ট ১৯৭৫ সালে চীন কতৃক বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের মধ্য দিয়ে।তৎকালীন প্রধান সমরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেনারেল জিয়াউর রহমান এর সোপান রচনা করেন ১৯৭৭ সাল তার চীন সফর ও সংযোগের মাধ্যমে। এরই ধারাআহিকায় এরশাদ কাল, খালেদা জিয়া কাল সম্পর্কের বহুমুখীকরনের ভিত আরো পোক্ত করার পদক্ষেপ নেন।

আওয়ামী লীগের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে নভেম্বরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার চীন সফরের মাধ্যমে। শেখ হাসিনা ঐ সময়ই চীনের অগ্রগতির গুরুত্ব ও মাত্রা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ভিআাইপি লাউঞ্জে  অপেক্ষমান সাংবাদিকের বলেছিলেন ” এশিয়াতে চীনের বিরাট ভুমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে”।  ঐতিহাসিক যোগসূত্র বলেই শেখ হাসিনার সাথে চীনের নেতৃত্বের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। চীনের গুরুত্ব ও ভুমিকা নিয়ে ১৯৫২ সালের ২-১১ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে গণচীন সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে দুনিয়ার যে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে এদের তুলনা করা যাবে। নয়াচীনের উন্নতি দেখে সত্যিই আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। দুনিয়ার যে কোনো শক্তির সঙ্গে তারা মোকাবিলা করতে পারবে সকল দিক থেকে’। (আমার দেখা নয়াচীন, পৃষ্ঠা-১১৮)

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের বাংলাদেশ সফর এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের ধারাবাহিক  চীন সফর ও বহুমাত্রিক যোগাযোগ  এ সম্পর্ককে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করছে। চীন বাংলাদেশের নতুন বন্ধু এবং মুক্তি যুদ্ধে যা অবস্থান ছিলো বিপরীত মেরুতে। ভারত বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের বন্ধু এবং স্বাধীনতা ও মুক্তি যুদ্ধে যার ভুমিকা ও অবদান ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জল অধ্যায়। বাংদেশ যেমন শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সাথে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, কংগ্রেস সরকার, দল ও জনগনকে স্মরণ করবে তেমনি ঐ সংকটকালে চীনের শীর্ষ নেতা মাও সে তুং ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের নেতিবাচক ভুমিকাকেও ভুলে গেলে চলবে না।  মনে রাখতে হবে সচেতনে, কোন দেশই নিজ স্বার্থের বাইরে অন্য রাষ্ট্র, গোষ্ঠী ও জনগণের পক্ষে কার্যকরীভাবে সোচ্চার ও ভুমিকা রাখেনা হোক সেটা আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব অথবা সৌদি আরবসহ মুসলিম উম্মাহর দেশ সমুহ অথবা বামপন্হী রাশিয়া, চীন এবং অন্যান্য দেশসমুহ। বিশ্ব, আন্চলিক ও দ্বিতীয় পক্ষীয় রাজনীতি ও কূটনীতির এটাই হলো চরম বাস্তবতা ও নির্মমতা।

আম্মু, একজন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হিসেবে সব সময় মনে রাখবে যে কংগ্রেস শাসিত ভারত আর বিজেপি শাসিত ভারত  এক পাল্লায় মাপা যাবে না। নরেন্দ্র মোদী শাসত ভারত আর বাজপেয়ী শাসিত ভারত ও এক নয়। নেতৃত্ব  ও ব্যক্তি রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব ও মাত্রা বহন করেন। নেতৃত্বের চিন্তা- ভাবনা, দৃষ্টিভঙি, শিক্ষা ও পটভূমি সরকার ও দলের ঐতিহাসিকভাবে চলমান ধারাবাহিকতায় নতুন বাক, মেড় ও গতি সৃষ্টি করতে পারে। এ কারনেই নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী  একই কংগ্রেসের নেতা হয়েও নিজ নিজ অবস্থানে স্বতন্ত্র।  মোদীর নেতৃত্বের কালটা তেমনি “মোদীত্ব” দ্বারা প্রলেপিত। ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে যেয়ে তিনি ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতকে তার ঐতিহাসিক স্বকীয়তা থেকে বিচ্যূত ও বিভ করেছেন প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সৃষ্টি করেছেন অহেতুক দুরত্ব। অতিনাটকীয়তা ও অতি আবেগঘন রাজনৈতিক ও কূটনীতিক পদক্ষেপে আজ তিনি ও তার দল নিম্নমুখী ধারার শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশ- ভারত সম্পর্ক কেমন তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আক্ষেপেই বুঝা যায় যখন তিনি বলেন “এতো দিলাম কিন্ত কি পেলাম?” অর্থাৎ মোদী সরকার “নিতে জানে, নিতে চায় কিন্তু  দিতে জানে না, চায় না”। বাস্তবেও  দেখা যায় যে মুলত বাংলাদেশ  এ সময়টা ভাটার শিকার। প্রাপ্তি যা ঘটেছে তা কংগ্রেস ও অমোদী বিজেপি সরকারের আমলে। তিস্তা, ট্যারিফসহ বিভিন্ন ইস্যূগুলো ঝুলে আছে বছরের পর বছর অথচ উত্তর- পূর্ব ভারত আজ বাংলাদেশের সহযোগিতার কারনেই অনেকটা শান্ত, নিরাপদ ও উন্নয়নের পথে হাটতে পারছে। অনাস্থা,সন্দেহ ও অবিশ্বাস ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষিত রোল মডেল ভারত- বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এ গভীর অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও পর্যালোচণা করলে স্পটতর হয়ে যায় কেন বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক দৃঢ়তর ও সুসংহত হচ্ছে। কেন শেখ হাসিনা সরকার ব্যাপকতর উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য  চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন, কেন সামরিক শক্তি  অর্জনে  প্রতিরক্ষা নীতিমালার বিকল্প হিসেবে ” ফোর্সেস গোল ২০৩০” নিয়ে এগুচ্ছেন? আজ যা স্পট নয়, হয়তো সময়ই সব বলে দেবে।

আম্মু, ভুরাজনীতি, দ্বীপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বহুবিধ সম্পর্কের বলয়ে ভারত মুলতঃ  চীন বিরোধী অবস্থানে রয়েছে সুদীর্ঘকাল থেকে। অতএব, বাংলাদেশে চীনের বহুমুখী ও মহুমাত্রিক কর্মকাণ্ড  ও সম্পর্কের গভীরতা বংলাদেশ- ভারত সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাবের ব্যাপ্তিও ঘটাচ্ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের  “ভারসাম্য চলমান রাখার অবস্থান” রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে প্রশংসনীয় ও বাস্তবতা সমৃদ্ধ। তবে এ সম্পর্ক উঠা-নামার মধ্যেই আছে। শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক ও কূটনীতিক পারদর্শিতা ও উৎকৃষ্টতার ইতিবাচক ধারার স্বাক্ষর রেখে আগাতে পারছেন অদ্যবধি। দেখা যাক, আগামীর চ্যালেঞ্জ,বাস্তবতা ও সুবিধাসমুহ বাংলাদেশ কিভাবে ও কতটুকু সফলতার সাথে মোকাবেলা ও টিকিয়ে রাখে।” “ধন্যবাদ আব্বু, তোমার সহজ ও বোধগম্য বক্তব্যের জন্য।”

হঠাৎ চেঁচামিচির আওয়াজে রফিক মল্লিক উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন “কি হয়েছো আম্মু, কে চেচামেচি করছে? “না আব্বু, তেমন কিছু  নয়। ছোট ছেলে রনি গাড়ির চাবি খুঁজে পাচ্ছেনা, তাই এমন করছে। এটা ও মাঝে মাঝেই করে থাকে। একটু বেখায়ালী বড় ভাইয়ার মতো।” “ওহ্ তাই বলো! থাক এসব কথা,আজ আর নয়। নিজের দিকে ও পরিবারের দিকে যত্নবান থেকো।”

” আচ্ছা আব্বু আবার কথা হবে।আম্মুকে সালাম দিও। আল্লাহ হাফেজ”।

“আল্লাহ হাফেজ, আম্মু”।

মেয়ের সাথে কথার সময়টুকু রফিক মল্লিক ভিন্ন এক জগতে চলে গিয়েছিলেন। তবে দুই পুত্র সন্তান জাভেদ ও আবেদের কথা মনে হতেই বেদনাবিধুর হয়ে পড়লেন

পর মুহুর্তেই। দুইজনেই উচ্চ শিক্ষিত। জাভেদ মল্লিক গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের দ্বীতিয় কর্ণধার ব্যক্তি কিন্ত ব্যাবসা- বানিজ্য বিষয়ে বেখেয়ালী, অপচয়কারী এবং পিতা- মাতার প্রতি দায়িত্বশীল নয়। নিজের সংসার ও পরিবারে বাইরে খুব একটা ভাবনার লোক সে নয়। এমনকি পিতা- মাতার সাথে সহ- অবস্থানেও তার ওজরের কোন কমতি নেই। আবেদ আমেরিকায় লেখাপড়া শেষ করে সেখানেই এক তিউনিশিয়ান মেয়েকে বিয়ে করে নাগরিক হিসেবে বসবাস করছে।

মাঝে মাঝে দেশে আসে কিন্ত পিতার হাজারো অনুরোধ সত্যেও নিজেদের বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের সাথে জড়াতে চরম অনীহা। অথচ যখন- তখন টাকা- পয়সার প্রয়োজন লেগেই থাকে। পুত্রদের নিয়ে সব সময়ই বুকভরা বেদনা বহন করে চলছেন মল্লিক দম্পতি। এতোসব ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার দুশ্চিন্তা তাকে ঘীরে ফেলে। আবার পায়চারি করতে করতে নিজেকেই বাক্যবানে বিদ্ধ করতে লাগলেন “আজ আমি এতো সম্পদের মালিক হয়েও অসহায়, আমার দ্বায় আমাকেই বহন করতে হবে। আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু- বান্ধব- পরিচিতজন কেউ আজ আমার পাশে নেই, যাদেরকে তাদের বিপদে- আপদে সাহায্য করেছি, পাশে দাড়িয়েছি তারাও আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নির্মম ও অকৃতজ্ঞতার সুরে। তা হলে জীবনে সবই কি মিথ্যা, মায়া! জীবনের অর্থ ও তাৎপর্য কি? বৃষ্টি থেমেছে। এবার একটু বারান্দায় যাই।” হঠাৎ যেন মনে হলো কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। ভয় পেলেন প্রচন্ডভাবে এবং কিছুটা  কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। মনে হলো তার পিতা- মাতার কন্ঠ। তাকে বলছে “বাবা সংকটে জ্ঞান হারায়ও না। সাহস ও দৃঢতা রাখো। আল্লাহর উপরে বিশ্বাস রাখো, তাকে বেশী বেশী করে ডাকো। তিনিই তো সব, মানুষ তো উছিলা মাত্র।সআল্লাহ চাইল উছিলাও সৃস্টি হয়ে যাবে। তুমি জাগতিক চেষ্টাও চালিয়ে যাও”।

হতভম্ব হয়ে তাড়াতাড়ি টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে চেয়ারে উপবিষ্ট হলেন। পানিতে চুমুক দিতেই মাইকে ফজরের আযান ভেসে এলো। মনোযোগ সহকারে শুনলেন আর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো।  নিজেকেই প্রশ্ন করলেন “হে মন, কেন তুমি এ আযান ও নামাজের গুরুত্ব দেও নাই? কেন তুমি জীবনের সবচেয়ে বড় আপনজন ও বন্ধুকে চিনতে পারো নাই? আজ আমি বুঝতে পারছি জীবনের কোথায়, কেন এবং  কিভাবে ভুল করেছি। আমি তো আমার সৃষ্টি কর্তা ও তার বিধানকে চেনার ও জানার চেষ্টা করি নাই। আমি তো সামঞ্জস্যহীনভাবে

সম্পদের পাহাড় গড়েছি অথচ পরিবার ব্যতিরিকে, ভাই- বোন, আপনজন, সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করি নাই। নিজেকে নিয়েই ছিলাম ব্যস্ত প্রতিনিয়ত।  এ সম্পদ সেতো আমার নয়, আমি অভিভাবক মাত্র । আজ আমি আর অসহায়, একা নয়। আমি  স্রস্টাকে চিনতে পেরেছি, নিজেকে আবিষ্কার করতে পেরেছি।”

অতপর  নিজে গাড়ী ড্রাইভ করে নামাজের জন্য মসজিদের দিকে ছুটে চললেন।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading