এটাই হচ্ছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর অনুষ্ঠিত বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের সামনে ২১শে জুন, ১৯৭৬ থেকে ১৭ই জুলাই, ১৯৭৬-এর মধ্যে দেয়া কর্নেল আবু তাহেরের জবানবন্দি।
পূর্ণ গোপনীয়তায় রাষ্ট্রদ্রোহ ও বিদ্রোহের অভিযোগে শাসকগোষ্ঠী আবু তাহেরের প্রহসনের বিচার করে। তৎকালীন সামরিক শাসক এই বিচার-সম্পর্কিত যেকোনো ধরনের খবর এবং তাহেরের জবানবন্দি প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারপরও বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ এটা প্রকাশ করেন। বিচারকক্ষের অনেক আইনজীবী, সহযোদ্ধা, সামরিক ব্যক্তি তাৎক্ষণিকভাবে তাহেরের বক্তব্য লিখে নেন। দ্রুত ও সাবলীল বক্তব্যটি সবাই সমান দক্ষতায় লিখতে পারেননি। ফলে বিভিন্ন সূত্রের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশনায় অসংলগ্নতা দেখা যায়।
১৯৭৭ সালের আগস্টে বোম্বের ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ পত্রিকায় এই বক্তব্য প্রথম প্রকাশিত হয়, যার উৎস ছিলেন একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব। ওই বছরের শেষের দিকে ঢাকায় তাহেরের বক্তব্যটি প্রকাশিত হয় ‘রণাঙ্গণ থেকে ফাঁসির মঞ্চে’ শিরোনামে। ১৯৭৮ সালে মোটামুটি একটি পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য ঢাকায় প্রকাশিত হয় ‘সমগ্র জনতার মধ্যে আমি প্রকাশিত’ শীর্ষক পুস্তিকায়। প্রথম দুটি উৎসের বক্তব্যকে সম্মিলিত সম্পাদনার মাধ্যমে লরেন্স লিফসুলৎস এর গ্রন্থের মুনীর হোসেন কর্তৃক অনুবাদকৃত ‘অসমাপ্ত বিপ্লব: তাহেরের শেষ কথা’ গ্রন্থে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়।সেখান থেকেই এ লেখাটি সংগৃহীত।
বিপ্লবের প্রস্তুতি ও পাকিস্তান থেকে পলায়ন:
জনাব চেয়ারম্যান ও ট্রাইব্যুনালের সদস্যবৃন্দ, আপনাদের সামনে দণ্ডায়মান এই মানুষটি, যে মানুষটি আদালতে অভিযুক্ত সেই মানুষ এই দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য রক্ত দিয়েছিল, শরীরের ঘাম ঝরিয়েছিল। এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত পণ করেছিল। এটা আজ ইতিহাসের অধ্যায়। একদিন সেই মানুষটির কর্মকাণ্ড আর কীর্তির মূল্যায়ন ইতিহাস অতি অবশ্যই করবে। আমার সকল কর্মে, সমস্ত চিন্তায় আর স্বপেড়ব এই দেশের কথা যেভাবে অনুভব করেছি তা এখন বোঝার সম্ভব নয়।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! এই দেশের সঙ্গে আমি রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ। আর এরা কীভাবে অস্বীকার করে এই দেশের অস্তিত্বে আমি মিশে নেই। যে সরকারকে আমি বসিয়েছি, যে ব্যক্তিটিকে আমিই নতুন জীবন দান করেছি, তারই আজ এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। এদেশে ধৃষ্টতা এত বড়ো যে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো আরো অনেক বানানো অভিযোগ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা করেছে। আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে তার সবই বিদ্বেষপ্রসূত, ভিত্তিহীন,ষড়যন্ত্রমূলক। সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি সম্পূর্ণ নিরাপরাধ।
এই ট্রাইব্যুনালের রেকর্ডকৃত দলিলপত্রেই দেখা যায় যে ১৯৭৫-এর ৬-৭ই নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে আমার নেতৃত্বে সিপাহী অভ্যুত্থানে হয়। সেদিন এভাবেই একদল বিভ্রান্তকারীর ঘৃর্ণ ষড়যযন্ত্রে নির্মূল করা হয়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান আর দেশের সার্বভৌমত্বও থেকে অটুট। এই যদি হয় দেশদ্রোহিতার অর্থ তাহলে হ্যাঁ, আমি দোষী। আমার দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি। এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছি। সেনাবাহিনী প্রধানকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করেছি। সর্বোপরি বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে মানুষের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছি। সেই দোষে আমি দোষী। এর জন্য সেই ৭৬-এর ২১শে জুন থেকে আমাকে এভাবে ভয় দেখানো ও কষ্ট দেয়ার কোনো দরকার ছিল না। ১৯৭৫-এর ৭ই নভেম্বর বিচাপতি সায়েমের যে সরকারকে আমরা ক্ষমতায় বসিয়েছি তারা এসব ভালোভাবেই জানে। কতগুলো নীতির প্রশ্নে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছে ছিলাম। সব রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়ার কথা ছিল। রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করতে দেয়ার কথা ছিল, আর একটা সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল একটা সরকার গঠনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। আমার দেশবাসী এর সবই জানে। তারা তা কৃতজ্ঞাতার সাথে মনে রেখেছে।
আমাকে এভাবে জেলের মধ্যে এমন এক নিম্ন আদালতের সামনে বিচার করার জন্য হাজির করা হয়েছে। এটা দেশ ও জাতির জন্য চরম অপমানজনক। আপনাদের কোন অধিকার নেই আমার বিচার কারবার। আমার বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগগুলো খণ্ডণ করার আগে আপনাদের সামনে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই যা এখানে উল্লেখ করা হবে খুবই প্রাসঙ্গিক।
২৫শে মার্চের সেই কালোরাত্রির কথা আমাদের মনে পড়ছে। পাকিস্তানি সেনারা বর্বর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমাদের দেশবাসীর ওপর। সেদিন চাপিয়ে দেয়া এক যুদ্ধ জয়ী হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না। হেরে গেলে আমদের ওপর চেপে বসতো এক জঘন্যতম দাসত্ব। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাদের পত্রপত্রিকায় তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছিল, বাঙালিরা উচ্চশিক্ষার যোগ্য নয়। তাদের দৌড় থাকবে মাদ্রাসা পর্যন্তই। বাঙালিরা এমনকি দেশপ্রেমিকও নয়। তাদের সংস্কৃতি নীচু মানের। এদেরকে শুধুমাত্র উর্দুভাষাতেই কথা বলতে বাধ্য করা উচিত। যখন থেকে আমার দেশের মানুষের অবস্থা সম্বন্ধে ভালোভাবে বুঝতে শুরু করি, তখন থেকেই আামি পাকিস্তানের ধারণাটার সাথেই কখনো একমত হতে পারিনি। জাতীয় আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়ন করতে বাঙালিরা নিজেদের জন্য একটা স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে পারে না। এ ধরণাটাই আমি কখনো মেনে নিতে পারিনি। তখন থেকেই আমি সবসময় চেয়েছি আমার দেশের জনগণের মুক্তি ও বাঙালি জনসাধারণের জন্য একটা ন্যায় ভিত্তিক আবাসভূমি।
আমি জানি না, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে আমার মতো আর কতজন বাঙালি অফিসার এভাবে একটা স্বাধীন বাংলাদেশের কথা চিন্তা করেছিলেন। নিজের বেলায় এতটুকু বলতে পারি স্বাধীনতার এই স্বপ্ন এক ধ্রুবতারার মতো আমার সব কাজে পথ দেখিয়েছে। আমার এখনও মনে পড়ে পাকিস্তানিরা আমাদের কি পরিমাণ ঘৃণা করত। তাদের অবজ্ঞা ও উপহাস ছিল অসহ্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে আমাদের শেখানো হত বাঙালিরা হচ্ছে বিশ্বাস ঘাতকের জাত। তাদের জন্ম হয়েছে গোলামী করার জন্য। বাঙালিদের পাক্কা মুসলমান ও দেশপ্রমিক নাগরিক বানানো পাকিস্তানিদের পবিত্র দায়িত্ব। আমরা যারা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলাম তাদের জন্য সেই দিনগুলো ছিল চরম পরীক্ষার মতো। সেদিন আমি দেশ ও জাতির ডাকে সাড়া দিতে দ্বিধা করিনি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল হেড কোয়াটার থেকে “সব কিছু পুড়িয়ে দাও, যাকেই সামনে পাও তাকেই মেরে ফেল”- তখন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত কারুরই আর জানতে বাকি ছিল না সামরিক জান্তার বর্বর চক্রান্ত। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি নি। ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান জানেন আমি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পেছনের সারির অফিসার ছিলাম না। আমি ঐতিহ্যবাহী বালুচ রেজিমেন্টে কমিশন পাই, পরে পাকবাহিনীর অভিজাত প্যারা কম্যাণ্ডো গ্রুপ স্পেশাল সার্ভিসেস ট্রুপে আমি যোগ দেই। দীর্ঘ ৬ বছর আমি সেই গ্রুপের সাথে যুক্ত ছিলাম। একজন সৈনিক ও অফিসার হিসেবে মনাসামনি শত্রুকে মোকাবেলা করতে আমি কখনো ভয় পাই নি।
পাক-ভারত যুদ্ধে আমি কাশ্মীর ও শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেই। সেই যুদ্ধের ক্ষত চিহ্ন এখনো আমার শরীরে বর্তমান। বাঙালী অফিসারদের মধ্যে একমাত্র আমিই ‘মেরুন প্যারাসুট উইং’ পাই। আমি এক সাথে ১৩৫টি ষ্ট্যাটিক লাইন জাম্প করার কৃতিত্বের অধিকারী। আমার কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। জর্জিয়া প্রদেশের ফোর্ট বেনিং-এ অবস্থিত রেঞ্জার ট্রেনিং ইনষ্টিটিউট আমাকে রেঞ্জার পুরস্কারে ভূষিত করে। আমি নর্থ ক্যারেলিনার ফোর্ট ব্র্যাগ-এ অবস্থিত স্পেশাল ফোর্সেস অফিসার্স ট্রেনিং ইনষ্টিটিউট থেকে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রী লাভ করি। উল্লেখযোগ্য, তখনো পর্যন্ত আর কোন বাঙালী অফিসার এই কৃতিত্ব অর্জনে সক্ষম হননি।
এখন সামরিক জান্তার বর্বরতম ফ্যাসিস্ট আক্রমণের দিনগুলোয় ফিরে আসা যাক। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রে এক প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছিলাম। দেশে ফিরে দেখি নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জিতেছে। দেশে ফিরে অনেকের সাথে আলাপ করার পর আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হবে না। সামরিক জান্তা আর তার দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানি রাজনীতির অধ্যায়ে একটা জ্বলন্ত অভিশাপ, এরা কোনদিনই রাষ্ট্রক্ষমতার আইনানুগ দাবিদার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাদের দৃঢ় সংকল্প ছিল যে তারা কখনো পাকিস্তানে কোন বাঙালিকে ক্ষমতাসীন হতে দেবে না, শেখ মুজিবকে তারা কোনভাবেই মেনে নিতে বা সহ্য করতে পারছিল না। আমি অঘটনের আভাষ পেলাম। তাই আমার স্ত্রী ও পরিবারকে ময়মনসিংহে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেই।
রণি চৌধুরীর ওয়াল থেকে নেয়া