বাংলার প্রবাদ – ” সুই হয়ে ঢোকা ফলা হয়ে বের হওয়া ” -বিশ্ব ব্যাপী করোনার প্রভাবে অর্থনীতি হিমশিম খাচ্ছে। দেশে দেশে সরকারগুলো মিলিয়ন- বিলিয়ন- ট্রিলিয়ন টাকা খরচ করছে জমা টাকা থেকে। প্রতিটি দেশই তাদের গচ্ছিত টাকায় হাত বসাতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও চেষ্টার ত্রটি করছে না। এই চেষ্টায় চুরি- দূর্ণীতি আছে, সেটা আরেকটি বিষয় । তবে সরকারকে দেখলাম বাজেটে একটি বড় অংকের থোক বরাদ্দ রেখেছে। এমন কি দ্রুত সেই থোক বরাদ্দকে বৃদ্ধিও করেছে। যে পরিমান বাজেট, সেটার তুলনায় একবারে কম নয় বলা যায়। এমনকি ভিন্ন ভিন্ন খাত থেকেও টাকা সংগ্রহের একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বন্টন সিস্টেমে মহা সমস্যা আছে তবে সরকারের চাওয়ায় অভাব দেখছি না। এটা স্বীকার করতেই হবে, তা না হলে অন্যায় বলা হবে ।
করোনার এই ভয়াবহতায় বিশ্বব্যাংক নিরবে- নিশ্চুপে সিন্দাবাদের ভুত হয়ে ভর করার পাঁয়তারায় আছে। একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, এই মোড়ল বিশ্বব্যাংক কম সুদে ঋণ দেয় বটে তবে কখনোই বিশ্বের বড় বড় পুঁজিবাদীদের বিপক্ষে যাবে না। এরা অনেকটা মাছের মায়ের মতন শোকে কাতর। অবশ্য বিশ্বব্যাংক/ জাতিসংঘ নিজেরাই বড় মোড়ল ।
আজকে জাতীয় পত্রিকায় একটি ভয়াবহ খবর দেখলাম। ” রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্তির পরামর্শ দিয়েছে, এ যেন মামুর বাড়ির আবদার । জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইসসিআর এর সঙ্গে বিশ্বব্যাংক মিলে শরণার্থী সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঋণ- সহায়তা বিষয়ক নীতিমালা ব্যাপক পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবটি হলো, উদ্বাস্তুরা যে সব দেশে রয়েছে সে সব দেশে অন্তর্ভুক্তিকরণ অর্থাৎ তাদের স্ব স্ব দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা এবং এই সংক্রান্ত প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের কথা বলা হয়েছে।
সহজভাবে বলা যায়, স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার মানে তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় আবশ্যিকভাবে প্রভাব পড়বে। অর্থাাৎ তাদের ফেরত পাঠানো পরিবর্তে বাংলাদেশেই রেখে দিতে হবে। তাদেরকে সাধারণ নাগরিকদের মতন ব্যবসা- বানিজ্য থেকে শুরু করে সকল সুবিধা দিতে হবে এবং সর্বত্র চলাফেরা করা তো স্বাভাবিক নিয়মেই হবে। বিশ্বব্যাংক একটি টোপ ফেলেছে অর্থের, আবার এটা জলের মতন পরিষ্কার যে দুই এক কিস্তি অর্থ দিবে হয়তোবা তারপরে যে আবার নতুন প্রস্তাব এনে তা বন্ধ করবে না, সেটারই বা গ্যারান্টি কোথায়? বলাই বাহুল্য যে, এতদিন বিশ্বব্যাংক আর জাতিসংঘ যে সব মন্তব্য করেছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে, সেগুলো ছিলো কেবলমাত্র বাদ কি বাদ এবং সময় ক্ষেপন করা ছাড়া কিছুই না ।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত ফ্রেমওয়ার্কে তিনটি প্রস্তাবনা উল্লেখ করেছে। এক) উদ্বাস্তু এবং হোস্ট কমিউনিটির জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি । দুই) উদ্বাস্তুরা যে দেশে অবস্থান করছে সেই দেশে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে একীভূতকরণ কিংবা আদিনিবাসে ফেরত পাঠানোর সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা । এবং তিন) হোস্ট কান্ট্রির সক্ষমতাকে এমন পর্যায়ে বাড়ানো যাতে উদার ওই রাষ্ট্রগুলো নতুন করে শরণার্থীর ঢেউ এলে পরিস্থিতি সামলাতে পারে অর্থাৎ আরও বেশি উদ্বাস্তু গ্রহণ করতে পারে ।
এবার লক্ষ্য করুন তাদের প্রস্তাবগুলো । প্রথম প্রস্তাবে অর্থের একটি টোপ রেখেছে বটে তবে বিনা গ্যারান্টিতে । দ্বিতীয় প্রস্তাবে একীভূত করে সমঅধিকারের নামে স্থায়ীত্ব দেবার চক্রান্ত । তৃতীয় প্রস্তাবটি হলো সব চাইতে ভয়ানক, প্রয়োজনে আরও উদ্বাস্তু গ্রহণ করার প্রস্তুতি রাখার । আরও লক্ষণীয় যে, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে এ বিষয়ে মতামত চেয়েছে। যদি মতামত প্রদানে দেশ অসক্ষম হয় তাহলে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে বা বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে বলে বিবেচিত হবে।
দেশের জাতীয় পত্রিকায় ভালো খবর দেখলাম যে, বাংলাদেশ সরকার এ সংক্রান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল মন্ত্রনালয়ের পরামর্শ গ্রহণ করে, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের পরিচয় দিয়ে সরাসরি ” স্ট্রং- অবজারভেশন ” বা প্রবল আপত্তি পেশ করেছে। এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তরফ থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে কোনো অবস্থাতেই এটি গ্রহণ করা হবে না । এমনকি উদ্বাস্তু বিষয়ক কোনো ঋণ গ্রহণ না করার জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্কিত বিভাগে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের থেকে মতামত পাঠিয়েছে। এখানে বলা ভালো যে, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের রিফিউজি কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেনি বিধায় রোহিঙ্গাদের ” শরণার্থী “র মর্যাদা দিতে বাধ্য নয় বা কোনো বাধ্যবাধকতা নেই । পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে ইতিপূর্বেও বেশ অনেকবার এমন প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে এসেছে এবং বাস্তবতার কারণেই বাংলাদেশের পক্ষে এটি করা সম্ভব নয় বলেই আপত্তি জানিয়েছে । বাস্তবতাটি হলো ছোট্ট ভূখণ্ডের এই দেশে মানুষ পায়ে পায়ে প্রতিনিয়তই ধাক্কা খায়।
এখানে একটি ভিন্ন বিষয় উল্লেখ করাটা জরুরি বটে। বাংলাদেশ থেকেও প্রবাসে এক কোটির মতন মানুষ বসবাস করে। তবে মনে রাখা ভালো যে এই প্রায় এক কোটির কেউই উদ্বাস্তু নয় । যদি প্রবাসে বসবাস রত সেই সব দেশ থেকে বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠানো হয় তাহলে বাংলাদেশ সরকার সেই মুহূর্তেই সকলকে ফেরত নিতে বাধ্য। করণ এরা কেউই উদ্বাস্তু নয় । তবে অমাদের দেশে রোহিঙ্গারা সরাসরি উদ্বাস্তু। এদেরকে জোর করে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এখানে একটি কঠিন ও মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
লেখার শেষে একটি পরিসংখ্যান দিয়েই শেষ করবো । লক্ষণীয় যে বাংলাদেশ আয়তনে ১৪৮,৪৬০ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ১৬৩ মিলিয়ন। অপরদিকে মায়ানমা আয়তনে ৬৭৬,৫৭৫ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৫৪, ০৫ মিলিয়ন। এবার অংকটি মিলিয়ে নিন। অর্থাৎ আয়তনের দিক দিয়ে মায়ানমার বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৪,৫ গুণ বড় এবং লোক সংখ্যার দিক দিয়ে ৩ গুণ কম। প্রশ্ন হলো বিশ্ব মোড়লরা কি এই অংকটি কষতে পারে না ?
বুলবুল তালুকদার
যুগ্ম সম্পাদক শুদ্ধস্বর ডটকম