বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত, অতি সম্প্রতি “বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র; ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে” শিরোনামে একটি অনন্য গবেষণালব্ধ মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বইটির নাম এবং কলেবর (৭৩৬ পৃষ্ঠা) যেকোনো আগ্রহী পাঠককে শুরুতেই ভাবাতে পারে – একটানা দেখে শেষ করা যাবে তো! এ দ্বিধা আমারও ছিল। কৃতজ্ঞতা স্বীকারপর্বও গতানুগতিকতার বাইরে। এ পর্বে পাঠক বিস্মিত হতে পারেন ব্যক্তি লেখক ড. বারকাতকে দেখে – তিনি কত সরল, বিনয়ী, মানবিক, মৌলিক চিন্তাভাবাপন্ন এবং সাদামনের। প্রকৃতির সাথে তার সখ্যতা, তার জ্ঞানের ইর্ষনীয় ব্যাপ্তি ও গভীরতা এবং অকপটে নির্মোহ মত প্রকাশের সৎসাহস। নিরন্তর জ্ঞান অসন্ধানের সুদীর্ঘ পরিক্রমায় তার অর্জিত দার্শনিক ভিত্তি। পাঠক হয়তো ভাবতেও পারেন, প্রকৃতির বিধিবিধানের অধীনতা স্বীকার করে, বিশুদ্ধ ও বৈপ্লবিক চিন্তার দৃঢ়তা নিয়ে ড. বারকাতের শোভন বাংলাদেশের” সন্ধানযাত্রায়, তার দর্শণ অনুসন্ধানে পর্যাপ্ত সময় তো দেয়াই যায়। এ অনুভূতি আমার বেলায়ও ঘটেছে।

এ বইয়ের মুখবন্ধের বিস্তৃত কলেবরও গতানুগতিকতার বাইরে। বেশ দীর্ঘ হলেও, পড়ে মনে হবে যেন একটি সম্পূর্ণ বই। লেখক তার স্বভাবজাত প্রজ্ঞা ও মুন্সিয়ানায়, অত্যন্ত সফলভাবে পাঠককে এত বড় মৌলিক গ্রন্থের সর্বাঙ্গীণতা উপলব্ধির নিমিত্তে সহজ-পাঠ প্রণয়ন করেছেন। বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র এর মতো এত ব্যাপক ও জটিল সমীকরণের প্রেক্ষাপটে শোভন বাংলাদেশের ধারণাকে অবয়ব দিয়েছেন। তার মৌলিক চিন্তা চেতনা ও বিশ্লেষণে যে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তা অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাবিদ ড. বারকাতকে বৈশ্বিক মাত্রায় তুলে ধরেছে। প্রসঙ্গত, বিশ্ব বিখ্যাত মার্কিন লেখক Noam Chomsky থেকে Congratulations on the book সম্বলিত বার্তা, সম্ভবতঃ এই প্রথম একজন বাঙালি লেখক ও চিন্তাবিদ ড. বারকাত পেয়েছেন – যা অপরিমেয় সম্মানের।

এ বইতে লেখক অত্যন্ত চমৎকারভাবে বর্তমান চলমান বৈশ্বিক পুঁজিবাদ প্রভাবিত ব্যবস্থাকে “অশোভন আখ্যায়িত করে, ক্রমবর্ধমান শোষণ এবং বৈষম্যতাকে উত্তরণশীল” বলে দাবি করেছেন। শোষণ এবং বৈষম্যতার ভিত্তিকে উপড়ে ফেলে মানবমুক্তির লক্ষ্যে, প্রকৃতির বিধিবিধানকে মান্য ও লালন করে আলোকিত মানবসমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে, তার প্রস্তাবিত এবং বিনির্মিত শোভন সমাজব্যবস্থা অথবা শোভন জীবনব্যবস্থার তত্বকাঠামোকে General Theory of Decent Society & Decent Life” আখ্যায়িত করে তা পাঠকের গ্রহণ-বর্জনের” বিবেচনায় উদারভাবে উপস্থাপন করেছেন।

লেখক, বর্তমান বৈশ্বিক মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির যেসকল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় ধারণাসমূহকে নিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, তথাকথিত অবশ্যম্ভাবী সফলতা ও কার্যকারিতার দাবি করে, তাকে একটি “myth” (বিভ্রান্তি) আখ্যায়িত করে তা চ্যালেঞ্জ করেছেন। অত্যন্ত জোরালো যুক্তি, তথ্য উপাত্ত দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, পুঁজিবাদ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন সহায়ক নয়। এমনকি, ‘efficient, civilized’ নয়। তার মতে, এ সকল ধারণা, সত্যিকার অর্থে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে, সকল দেশ, সমাজ ও মানুষের কল্যাণে আদৌ সৎভাবে ক্রিয়াশীল নয় এবং দাবিকৃত সুবিধাদিও নিশ্চিত করে না’। বরং, তিনি অধিকতর স্পষ্টভাবে বলেছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতি, সবকিছু সূক্ষ্ম এবং সচেতনভাবে একমাত্র কর্পোরেট ও মুনাফার স্বার্থে” চালিত। এসবের সত্যতা নিরূপণে, প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীকালে উন্নত বিশ্বসহ সকল রাষ্ট্র ও অর্থনীতির ভঙ্গুরতার উন্মীলন এবং প্রকৃতির কাছে বাজার অর্থনীতি ব্যবস্থার অসহায় আত্মসমর্পণ। অনেক দেশের গণতন্ত্রহীনতা এবং চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনকে বিবেচনায় না নিয়ে, মুক্তবাজার অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষক দেশসমূহের, সেসব দেশ ও নেতৃত্বের অব্যাহত সমর্থন প্রদান। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ওপর কর্তৃত্ব অব্যাহতভাবে বজায় রাখা ও অন্যের জন্য তা সহজলভ্য না করা এবং নিজেদের স্বার্থেই বিদ্যমান অনাকাঙ্ক্ষিত অসাম্যতা ও দারিদ্রতার চলমানতা বজায় রাখা। সর্বোপরি, বিশ্ব অর্থনীতির বিকাশ ও মানবকল্যাণকে অব্যাহতভাবে একটা নেতিবাচক ঘুর্ণিয়মান চক্রের মধ্যে আবদ্ধ রাখা।

ক্যাপিটালিজমের মিথ বিশ্লেষণের একপর্যায়ে ড. বারকাত তার গ্রন্থে পুঁজিবাদের পতনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির বিকাশের পরিক্রমায়, সমাজ বিবর্তনের ধারায়, সাম্রাজ্যবাদ, রাজতন্ত্র, দাসপ্রথা, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, উদারনীতি, বিশ্বায়ন, নব্য-উদারনীতিসহ অসংখ্য বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী মৌলিক আলোচনা করেছেন। ঐতিহাসিক, দার্শনিক, তাত্ত্বিক এবং বাস্তবতার নিরিখে, বিশেষভাবে তিনি আলোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয় এবং ধারণার উপর, যেমন: মানুষ মানুষের ওপরে কর্তৃত্ব ও আধিপত্য; প্রকৃতির পণ্যায়ন; সমাজের পন্যায়ন; আর্থিকিকরণকৃত পুঁজি; মুক্তি-সাম্য-ভাতৃত্ব; আইনের শাসন; আন্তর্জাতিক শ্রেণি-সংগ্রাম; বৈশ্বিক ক্ষমতার বিন্যাস; এবং একবিংশ শতকের অর্থনৈতিক মহামন্দা ও ভাইরাস বিপর্যয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণপ্রাপ্ত যে সকল সার্বজনীন সিদ্ধান্ত, ইত্যাদি, যা যেকোনও অনিসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য মূল্যবান বলে বিবেচিত হতে পারে।

লেখকের গ্রন্থের নামকরণে “বড় পর্দার” বিষয়টির বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা দেখে নিশ্চিতভাবে প্রতিয়মান হবে, এটি একটি Testament of inquiry of the causes of possible (inevitable !) collapse of the dominance of capitalism – not just driven by the forces of events but causation of all factors holistically perceived। পুঁজিবাদের অবশ্যম্ভাবী পতনের নিরিখে ড. বারকাত মনে করেন, এ পরিক্রমায় পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে চিরায়ত দ্বন্দই সকল সমস্যার মূল। Post-Capitalist Order-এ, সকল সমস্যার ক্লাসিক সমাধানে, ঐ দ্বন্দকে সমূলে উৎপাটিত করতেই হবে।

ড. বারকাতের গ্রন্থের বলিষ্ঠতা, পোস্ট-ক্যাপিটালিস্ট অর্ডারের বিকল্প হিসাবে “শোভন রাষ্ট্রের” মডেল উপস্থাপন। তবে, তা নিঃসন্দেহে অনেক বিতর্কের জন্ম দেবে। এ মডেলের প্রতিপাদ্য হিসাবে তিনি মনে করেন : (ক) “গণতান্ত্রিক সম্মতির” ভিত্তিতে শোভন দেশ প্রতিষ্ঠিত হবে; ক্যাপিটাল এবং লেবার এর মধ্যে চিরায়ত দ্বন্দ্ব দূরীভূত করা হবে; প্রকৃতিকে মান্য ও লালন করা যাবে; এবং জনগণকে করা হবে ‘আলোকিত’। (খ)“Means of Production (উৎপাদনের উপায়) রাষ্ট্রীয় মালিকানায়” থাকবে (যেমন-শিল্প ও কৃষি)। রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিষয়টি সমঝোতার ভিত্তিতে বা ভোটের মাধ্যমে হতে পারে (অথবা শ্রেণি সংগ্রাম বা বিপ্লব এর মাধ্যমে হওয়ার কথা অনেকে ভাবতে পারে)। (গ) ‘উৎপাদনের উপায়ের ওপর শ্রমজীবী-কর্মজীবী জনগণের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা’ হবে এবং তা পরিচালিত হবে যৌথ-মালিকানাভিত্তিক সমবায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এখানেই, প্রচলিত সমাজতন্ত্রের প্রায়োগিকতার সাথে ড. বারকাতের শোভন রাষ্ট্র ব্যবস্থার পার্থক্য। তিনি বলেছেন, ‘প্রায়োগিক সমাজতন্ত্রে পুঁজিবাদীদের হাত থেকে উৎপাদনের উপায় কব্জা করা গেছে, কিন্ত তা কখনও শ্রমজীবী-কর্মজীবী মানুষের প্রত্যক্ষ মালিকানায় নেয়া যায়নি’।

ড. আবুল বারকাত তার General Theory of Decent Society বিনির্মাণে পরস্পর-সম্পর্কিত ও নির্ভরশীল তিনটি বৃহৎ-বর্গীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি উপাদানের (broad foundational components) সমন্বয়ে যে একশিলা স্তম্ভের (Monolithic Pillar) ধারণা উপস্থাপন করেছেন তা সত্যিই চমৎকার। তার শোভন সমাজের ‘আলোকিত জনগণ’ হবে জ্ঞানসমৃদ্ধ, মুক্তচিন্তার, সংস্কৃতিবান, বিজ্ঞানমনস্ক, এবং পাস্পরিক সহমর্মিতায় উচ্চ-সংহতিসমৃদ্ধ সৃজনশীল মানুষ। শোভন রাষ্ট্র হবে সত্যিকারের জনগণের রাষ্ট্র, গণতন্ত্র হবে প্রকৃত অর্থের Demos-দের শাসন। শাসনপদ্ধতি হবে নীচ থেকে উপরে (bottom-up)। আমলাতন্ত্র হবে জ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্ক নারী-পুরুষের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। দেশ রক্ষা করবে জনগণ। এবং, এসবের ‘মিথস্ক্রিয়ায় শক্তিশালী হবে শোভন সমাজের ভিত্তি, সমাজ হবে সত্যিকারের বৈষম্যহীন’। তাতে ‘রাষ্ট্র ও জনগণের কাঙ্ক্ষিত সত্যিকারের ক্ষমতা (power) গুটিকয়েক পুঁজিপতির oligarchy থেকে রাজনীতির (Politics) কাছেই ফিরে আসবে’।

মুক্ত বাজার ব্যবস্থার আলোকে ড. বারকাত জাতীয় বাজেট নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন- Budget shouldn’t be based on consideration of revenue first, rather the reverse, needs first। তার ‘শোভন সমাজব্যবস্থার’ মূল উদ্দেশ্য হবে সত্যিকারের জনকল্যাণমুখী বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন – যা সকলের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, কাজ এবং বিশ্রাম ও বিনোদনসহ সামাজিক ন্যায়-অধিকার (socially justifiable rightsনিশ্চিত করবে। শুধু দরকার বাজেট বিষয়ে ‘প্রথাগত মানসিকতার পরিবর্তন’। বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে, উল্লিখিত মৌলিক বিষয়ে বিস্তৃত তথ্য, উপাত্ত, এবং বলিষ্ঠ যুক্তি দিয়ে তিনি বলেছেন এগুলো দয়া দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়। উপরন্ত দাবি করেছেন, সামাজিক ন্যায়-অধিকারকে তার প্রস্তাবিত শোভন সমাজ ও রাষ্ট্র অত্যন্ত সম্মানের সাথে স্বাভাবিক দায়িত্ব হিসাবে নিশ্চিত করবে।

লেখক জোরাল যুক্তি তুলে ধরেছেন, মুক্ত বাজার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকরা কিভাবে religious tradition’কে এড়িয়ে politics of religion’ এর মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থে সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রে নেতিবাচক প্রভাব চলমান রেখে প্রকারান্তরে তাদেরকেই শক্তিশালী করছে।

প্রশ্ন হতে পারে লেখক ড. আবুল বারকাত কী Idealist or Realist? তিনি কী সমাজতন্ত্রী না সাম্যবাদী? এর বাইরেও প্রশ্ন থাকে, প্রস্তাবিত শোভন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব? বাস্তবতার নিরিখে, শোভন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গণতান্ত্রিক সম্মতির ভিত্তিতে শোভন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং উৎপাদনের উপায়ের ওপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা যে সহজ নয়, তা ইতিহাসই বলে। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটও সংঘাতপূর্ণ ও রক্তক্ষয়ী ছিল।

আজকে পুঁজিবাদী বিশ্বের যে ক্রাইসিস, তা নিয়ে অনেক আগে থেকেই গবেষণা, আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকে বিশ্ব রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ এবং আমেরিকার নেতৃত্ব ও ক্ষমতার আধিপত্যের পতনেরও ইঙ্গিত দিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবক্তা, সমর্থক এবং নেতৃত্বদানকারী দেশসমূহ হয়ত একটু বেশি মাত্রায় আত্মপ্রসাদেই ভুগেছে। বিশ্বায়নের ধারণাকে সামনে এনে, নব্য-উদারনীতি ও উদার বৈদেশিক বাণিজ্যেই সকল দেশের উন্নয়নের একমাত্র চাবিকাঠি–এ ধারণাকে জনপ্রিয় এবং বাস্তবায়ন করেছে। সবকিছুতে রাষ্ট্রের ভূমিকা একেবারে গৌণ করা হয়েছে। তাতে, শেষ বিচারে তাদের লাভ হয়নি। ইতোমধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশসমূহের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বৈশ্বিক মহামারী, বৈশ্বিক ব্যবস্থার বিবেচ্য বিষয়সমূহ যেমন- স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, উন্নয়ন, প্রযুক্তি এবং জলবায়ুসহ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক ক্ষমতার প্রাধান্যের বিন্যাসকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

অন্যদিকে পুঁজিবাদের বিপরীতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পতনও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সেখানকার বাস্তবতা হচ্ছে ‘উৎপাদনের উপায়ের ওপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব’ দীর্ঘ মেয়াদে স্থায়ীত্ব (sustainable) পায়নি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নিশ্চিতভাবে intrinsic fallacies, contradictions and weakness ছিল (যেমন, রাষ্ট্র ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে ব্যক্তি, দল ও নেতৃত্বের দলীয় আমলাতান্ত্রিকতার নিগড়, দুর্নীতি, অপচয়, অদক্ষতা, স্বজনপ্রীতি, ও অব্যবস্থাপনা) যা বড়-পর্দায়, ‘শোভন রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠায় বিবেচনায় নিতে হবে। তবে, সমাজতান্ত্রিক সমাজে বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, বিনোদন ইত্যাদি, তুলনামূলকভাবে বাজার অর্থনীতির চেয়ে আজকের প্রেক্ষাপটে ভালো মনে হতে পারে। তবে, স্বাধীন চিন্তা-চেতনা, মানুষের নিজস্বতা ও প্রতিভাকে শানিত করে কোনো কিছুর উদ্ভাবন এবং তার স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার ইত্যাদি, কোন ব্যবস্থায় প্রাধান্য পাবে তা বিশেষভাবে বিচার্যের বিষয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে অনেক দেশ বেরিয়ে এসে বাজার অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের বাস্তব অভিজ্ঞতায়, চীন নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে বজায় রেখে মুক্ত বাজার বিশ্বের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে উন্নয়নের উল্লম্ফন ঘটিয়েছে। এখন বাজার অর্থনীতির দুরবস্থা দেখে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটিয়ে (২০২৫ সালের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন) আভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়িয়ে, তাদের উন্নয়নের ইতিবাচক ধারা বজায় রাখার মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতির নেতৃত্বে থাকতে চায়। বৈশ্বিক কৌশলগত ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসে তা কতটুকু স্থায়ীত্বশীল (sustainable) এবং শান্তিপূর্ণ হবে, উপরন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যেও পারস্পরিক-নির্ভরশীলতা (interdependence) ও পরিপূরকতা (complementarity) কতদিন শান্তিপূর্ণভাবে চলমান থাকবে তা কে জানে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে চীন পিছিয়ে। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণে বিশ্বে প্রথম। অস্তিত্বের হুমকিসহ, বিশ্ব আজ অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এটিই আজ বিশ্ব-বাস্তবতা।

অর্থনীতিতে, পুঁজিবাদলালিত অসমতা এবং দারিদ্রতার দুষ্টচক্রকে ভাঙতে ইউরোপের ধনী দেশসমূহের “কল্যাণ-রাষ্ট্র” ধারণাও বাস্তবে ‘ব্যর্থ’ হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরে Post neo-Liberal Order নিয়েও বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও নেতৃত্ব পর্যায়ে ডায়লগ শুরু হলেও ভাইরাসের বিধ্বংসী আবির্ভাব সকল বিবেচনাকে নিশ্চিতভাবে পাল্টে দিয়েছে। দেখার বিষয়, তারা Post neo-Liberal Order এর লক্ষ্যে, বৈশ্বিক প্রাধান্যের বিন্যাসে মুক্ত বাজার অর্থনীতির দর্শনকেই প্রাধান্য দিয়ে সমাধান খুঁজবে, না রাষ্ট্রের অধিকতর ভূমিকার বিষয়ে কোনো আমূল পরিবর্তণের পক্ষে অবস্থান নেবে এবং প্রকৃতিকে মান্য ও লালন করে এগিয়ে যেতে সমাধান খুঁজবে।

শোভন সমাজের আলোকে ‘পুঁজি ও শ্রমের’ দ্বন্দ্ব বেশ জটিল। মার্কসীয় Theory of value যা physical labour এর ভিত্তিতে মূল্যায়িত, সেখানে মানুষের intellectual and cognitive labour (মেধা ও মনন ভিত্তিক শ্রম) মূল্যায়ন কিভাবে বিবেচিত হবে। এ বিষয়টি, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুষ্ঠভাবে সমাধান করতে পারেনি, যা ছিল সে ব্যবস্থার এক বড় দুর্বলতা। যদি তার সুরাহা না হয়, তাহলে মেধা, জ্ঞান ও বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় কে কী ভুমিকা রাখবে? সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, ব্যক্তির স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের ধারায়, রাষ্ট্রযন্ত্র কোনও হস্তক্ষেপ করবে কিনা। প্রশ্ন আসে এজন্য যে, শোভন রাষ্ট্র ও সমাজের মূল ভিত্তিই হচ্ছে আলোকিত মানুষ এবং ঐ আলোকিত মানুষেরই ‘গণতান্ত্রিক সম্মতি’ (democratic consent)। তবে, বাস্তবতার নিরিখে শোভন রাষ্ট্রকেই, সমাজ ও অর্থনীতিতে অধিকতর গুরুদায়িত্ব নিতে হবে। আবারও প্রশ্ন – সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর সাথে শোভন রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিন্যাসের পার্থক্য কী? বাজার অর্থনীতির বিপরীতে, শোভন সমাজ ও রাষ্ট্র, সমাজতান্ত্রিক না হলে, শোভন সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর সাথে দার্শনিক, তাত্ত্বিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং জটিল বাস্তবতার কী পার্থক্য? আর যদি সমাজতন্ত্রের আঙ্গিকে শোভন সমাজ তার ভবিষ্যৎ রোড-ম্যাপ তৈরি করে এগুতে চায়, বিদ্যমান বাস্তবতায় চীন কি শোভন সমাজের সকল উপাদান বিশেষ করে ‘আলোকিত মানুষ’ তৈরি করে সঠিক পথে এগুচ্ছে? আবার, যে সকল রাষ্ট্র বাজার অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে তাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণ কি সার্বিকভাবে মুলধারায় সম্পৃক্ত? এসব নিয়ে আবুল বারকাতের বিশ্লেষণ মতে ‘সমাজতন্ত্র তার মূল অভীষ্ট অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে এবং মুক্ত বাজার বলে কোথায়ও কোন কিছু ছিল না এবং নেই’।

শোভন রাষ্ট্রের পত্তন এবং অগ্রগতিকে স্থায়ীত্বশীল করতে, বিশেষ করে transition, transformation, and establishment of Cooperatives of workers joint-ownership সম্পর্কিত কার্যকরণের মৌলিক বিষয়ে ড. বারকাত এখনই বিস্তৃত কিছু বলতে চাননি। শোভন রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার ‘উত্তরণপর্ব (transition phase) ও রুপান্তরপর্বের (transformation phase) বিষয়ে তিনি ২০৫০ সালের দিকে নিখুঁতভাবে বলা সম্ভব হবে’ বলে উল্লেখ করেছেন। বাস্তবতার নিরিখে বিষয়গুলি বেশ জটিল এবং যে কোনও সমাজ ও দেশের জন্যই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা, বাজার অর্থনীতির ক্ষমতা-কাঠামোয় বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যসত্বভোগী স্বার্থান্বেষী মহলের সক্রিয় অবস্থান এবং তার সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বার্থের মিলন, যা সকলদেশেই তথাকথিত এক কঠিন ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করে রেখেছে। এমতাবস্থায়, শুধু আলোচনা বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সমাধাযোগ্য নয়। আর, বাজার অর্থনীতির বর্তমান সকল সুবিধাভোগী শ্রেণী (যেমন- আমলা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবি, বুদ্ধিজীবী, প্রেস ও মিডিয়া) তো সক্রিয় আছেই। তাদের তথাকথিত ক্ষমতার steel frame-কে ধর্তব্যে নিতেই হবে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সমাজ ও অর্থনীতির বিকাশের ধারায় পুঁজিবাদ কৃষি, শিল্প ও টেকনোলজির বিপ্লব ঘটিয়ে, সকলকে তা শুধুমাত্র অনুসরণের এক এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। সবাই তাদের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে এবং উন্নত ‘পশ্চিমা বিশ্বের’ প্রতি অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।

প্রাসঙ্গিকভাবে, অনেকেই ভাবতে পারেন, ড. বারকাত বোধহয় Ideal State (আদর্শ রাষ্ট্র) এর কথা ভাবছেন। এ বিষয়ে লেখক স্পষ্টই বলেছেন, কেউ ‘সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রকে বড় পর্দায় দেখতে চায়নি বা দেখেনি’। ‘মানুষকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেনি’, বরং ‘উল্টোটাই ভাবনাজগত ও কর্মকাণ্ড নিয়ামক’ ছিল। তাই, শোভন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবুও, লেখকের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, সমাজের কোন অংশীজন (stakeholder) গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, সমঝোতার ভিত্তিতে, শোভন সমাজ প্রতিষ্ঠায় ডায়লগ বা ডিসকোর্স শুরুর মাধ্যমে জনমত তৈরিতে প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা রাখবে। এখানে নিবেদিত রাজনৈতিক মতাদর্শভিত্তিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি? না, আলোকিত মানুষগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনটি আনবে। বিষয়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং বৈকি। লেখক নিজেই বলেছেন, পুঁজিবাদ তার স্বার্থে, প্রয়োজনে অনেক ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর

ড. বারকাত বৈশ্বিক শোভন সমাজ বিনির্মাণে আলোকিত মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা, সমঝোতা এবং ডায়লগকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিশেষভাবে দাবি করেছেন, ‘আর্থিকীকরণকৃত পুঁজিবাদের’ নেতিবাচক চক্র ও কুফল এবং ‘ভাইরাসের’ সর্বগ্রাসী ক্ষতি মিলে “বড় পর্দায় প্রকৃতির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য-আস্থা-সম্মানভিত্তিক নুতন এক জীবনব্যবস্থা ‘শোভন সমাজব্যবস্থা’-উদ্দিষ্ট আলোকিত মানুষের বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ সময়ের দাবি”। যেহেতু, ইতিহাসের গতিধারার অভিজ্ঞতায়, সকল দেশ ও সমাজ কোনও না কোনভাবে, যেকোন সমাজ ও অর্থনীতির দর্শনের সফল মডেলকেই অনুসরণ করে এগিয়ে যায়, সেহেতু, আলোকিত মানুষসমেত শোভন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে কোন ভূখণ্ড বা অঞ্চলের নেতৃত্ব এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে, তা ভাববার ও দেখার বিষয়।

এখানে, আরও বড় প্রশ্ন হতে পারে, এই “আলোকিত মানুষ” কিভাবে পাওয়া যাবে। এজন্যে, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ কি ইতোপূর্বে বর্ণিত “একশিলা স্তম্ভ” তৈরিতে একনিষ্ঠ হবে? পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবে? যেখানে দরকার (আবুল বারকাতের গ্রন্থের উধৃতি মতে) জ্ঞান বলতে শুধু “what to think” নয় “how to think” কে প্রধান্য দিয়ে নির্মোহ বিশ্ব ইতিহাস, বস্তুনিষ্ঠ দর্শন, নীতিশাস্ত্র, সুনির্দিষ্ট শাস্ত্রের চিন্তার ইতিহাস, গণিতের দর্শন, মানবশ্রমের ইতিহাস, অর্থাৎ মানুষের মেধা ও মননের স্ফূরণ ও বিকাশের নিমিত্তে জীবন, দর্শন ও বিজ্ঞান ভিত্তিক সৃজনশীল শিক্ষার ব্যবস্থা ও বাস্তবায়ন। এই আলোকিত মানুষের ধারণা থেকে বাংলাদেশ এখনই বিশেষভাবে উপকৃত হতে পারে।

ড. আবুল বারকাতের শোভন সমাজ ও রাষ্ট্রের ধারণার সাথে কোনও সচেতন পাঠক, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমাণের স্বপ্নের কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলার প্রাসঙ্গিকতা বিচার্যে আগ্রহী হতে পারেন। জাতির পিতাও একটি শোষণ ও বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, আলোকিত সোনার বাংলাদেশ চেয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে, সদ্য স্বাধীন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনে শিক্ষানীতিসহ অনেক কার্যকর উদ্যোগ নেয়া শুরু করেছিলেন, যাতে তার সোনার সন্তানেরা আলোকিত মানুষ হয়। চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের আমলারা হবে জনগণের সত্যিকারের বন্ধু। তিনি অন্তর থেকে বলতেন, আমার কৃষক, আমার শ্রমিক, আমার মেহনতি জনতা’; ‘তোমরা আমলারা (যারা “সকল সাব”!) তাদেরকে সম্মান করে কথা বলবে’। জাতির পিতার এ উদাত্ত আহবানের ভিত্তি ছিল মহান স্বাধীনতার মূল্যবোধস্নাত দেশের আপামর জনসাধারণকে সত্যিকারের মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন এবং তাদের সার্বিক কল্যাণ। বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ ডাক দিয়ে ‘ভূমি সংস্কারসহ’ “বহুমুখী সমবায়েরও” প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। কিন্ত জাতির দুর্ভাগ্য, তাকে সপরিবারে ( ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫) নিহত হতে হলো। ড. বারকাত, তার গ্রন্থে স্পষ্টতই পুঁজিবাদী সমাজের এ ভয়ঙ্কর দিকটার ইঙ্গিত দিয়েছেন। স্পষ্টভাবে বলেছেন, জাতির জনক সদ্য স্বাধীন (১৯৭১) বাংলাদেশকে কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি বিনির্মাণে উদ্যোগী হলে, “দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে জাতির জনককে হত্যার মাধ্যমে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টোদিকে চালিত করে”।

বাস্তবতার নিরিখে নিশ্চিতভাবে ড. বারকাতের গ্রন্থের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে অনেক বির্তক হবে। অনেকে হয়ত ভাববে, আবুল বারকাত ইউটোপিয়ান। কল্পনার জগতে বাস করেন। হতেই পারে। এ বির্তকে না গিয়ে বলা যায়, কেউ কি ভেবেছিল, আমাদের জীবদ্দশায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটবে? পরবর্তীতে রাশিয়া আবার ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে? পুঁজিবাদ, উদারবাদ, নব্য-উদারবাদের ধারক ও বাহক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের মতো দেশ (যাকে আমেরিকাই বিশ্বায়নের সাথে সম্পৃক্ত করেছে) বৈশ্বিক ক্ষমতার প্রাধান্যের বিন্যাসে চার দশকের মধ্যেই অপ্রতিরোধ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে? একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক ক্ষমতার প্রাধান্যের বিন্যাস এশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে? রাশিয়া, ইরান, ভারত, তুরস্ক, সৌদি আরব, ইসরায়েল আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে বৈশ্বিক ক্ষমতার প্রাধান্যের বিন্যাসে প্রভাব বিস্তার করবে? আমেরিকা ও ইউরোপের সম্পর্কের টানাপড়েন সৃষ্টি হবে? জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান সারা পৃথিবীকে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে? সর্বশেষ, বৈশ্বিক মহামারী সারা পৃথিবীর সকল কর্মকাণ্ড, জীবনযাত্রা, এবং সার্বিক অর্থনীতিকে অচল করে দেবে? যা আগে কল্পনা করা যায়নি, তাই তো আজ বাস্তবতা। এটাই, সময় ও ইতিহাসের পরিক্রমার নির্মোহ বাস্তবতা।

এ পরিক্রমায়, সকল সময়, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশ ও কল্যাণে কিছু কিছু দুরদর্শী প্রতিভাবান ব্যক্তি তাদের দর্শন ও মতবাদ নিয়ে হাজির হন। সেসকল দর্শনের দৃঢ়ভিত্তিতে, সমাজ ও রাষ্ট্রের সংস্কার, বিনির্মাণ, কল্যাণ ও বিকাশে রাষ্ট্রনায়করা, স্ব স্ব রূপকল্প সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে, অনুকরণীয় যুগান্তকারী নতুন বাস্তবতাও সৃষ্টি করেন। চিন্তাবিদ ড. আবুল বারকাত, সময়ের তাগিদেই, তার বড় পর্দায়, সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র ভাবনায় ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে প্রণীত গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সময়োপযোগী।

শোভন সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্শন ও ধারণার সাথে দ্বিমত থাকবে, বিতর্ক হবে এটাই তো স্বাভাবিক। মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব, বিতর্ক ও ডিসকোর্সের মাধ্যমেই সমাজ বিকাশের দর্শনের ধারা বিকশিত হবে। সভ্যসমাজে অতীতে তাই হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হবে। বাংলাদেশ তো, সেই সমাজেরই অংশী হতে প্রত্যাশী।

চিন্তাবিদ ড. আবুল বারকাত আমাদের চিন্তা, ভাবনা, ও মননের জগতকে provoke করেছেন। Also, ignited our mind। আমরা কি বড় পর্দায়, শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে, আলোকিতপথে মনোজগতের এ যাত্রায় অংশী হতে পারি না! নিশ্চয়ই পারি। ড. বারকাতকে তার দর্শন ও মতাদর্শের আলোকে তাকে নিয়ে অনেকে অনেক কিছুই ভাববেন। আমি তার এই মৌলিক গ্রন্থের সান্নিধ্যে এসে, মানুষের সম্মান, ন্যয্যতা, সাম্য, এবং কল্যাণে শোভন সমাজের দর্শন, আদর্শ, যৌক্তিকতা এবং প্রায়োগিকতার রূপকল্প তৈরিতে তার মধ্যে এক ঐকান্তিক ও নিবেতদিতপ্রাণ মানবতাবাদীকে দেখেছি

তার শোভন সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্শন আমাদের সচেতন পাঠক সমাজের চিন্তা ও ভাবনার জগতকে ঋদ্ধ করবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading