মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ গায়ে লাগেনি এমন পরিবার, মানুষ বা গ্রাম পাওয়া যাবে না বাংলাদেশে। কেউ হারিয়েছে স্বজন, কেউ সম্পদ। পাকিস্তান ও তার সহযোগিতাদের হাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বাঙালিদের সবাই। আমি মোঃ আজিজল হক আকন্দ (৭১), পিতা: রইচউদ্দিন আকন্দ, মাতা: মোছাঃ ডালিম বেগম, গ্রাম: রাণীগ্রাম, সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকা। ৬ ভাই ৩ বোনের মধ্যে আমি চতুর্থ। বাবা তাঁতের কাজ করতেন, তিনি মারা যান ১৯৬৫ সালে। সংসারের প্রয়োজনে ওই বয়সেই আমিও হয়ে উঠি তাঁত শ্রমিক। ১৯৬৮ সালে বিয়ে করি সদর থানার মেছড়া ইউনিয়নের খাড়–য়া গ্রামের মছিরণ বেগমকে। ‘৬৯-এর ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনীতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, গ্রামের মানুষও অংশ নি নিতে থাকে মিটিং-মিছিলে। আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার সমর্থক হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ। তা পূর্ণতা পায় সত্তুরের নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে সবচেয়ে জনসমর্থিত রাজনৈতিক দল। আমাদের বংশের আব্দুল বারী আকন্দ থাকতেন শহরের, তার বাসা মাড়োয়ারি পট্টিস্থ সিরাজগঞ্জ মহুকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদারের বাসার পাশে। নানা কারণে বংশের আব্দুল বারী আকন্দ হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী। পাশ্ববর্তী গ্রামের শহিদুল ইসলাম তালুকদার মহুকুমা আওয়ামী লীগ বড় নেতা, ফলে আমাদের গ্রামটিও হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। সত্তুরের নির্বাচনে আমি নিজ রোজগারের ছয় আনা খরচ করে একটি বড় নৌকা বানিয়ে রাস্তার মোড়ে লাগিয়ে দেই। এ নির্বাচনে প্রার্থীদের তেমন খরচই করতে হয়নি। আওয়ামী লীগ প্রার্থী এএনএ পদে মোতাহার হোসেন তালুকদার এবং এমপিএ পদে সৈয়দ হায়দার আলী আমাদের গ্রাম থেকে একচেটিয়া ভোট পায়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। সরকারি সকল কর্মচারী আন্দোলনের পক্ষে আসায় এবং কোনও মিলিটারি ক্যাম্প না থাকায় সহজেই স্বাধীন হয়ে যায় সিরাজগঞ্জ মহুকুমা। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে (২৭ এপ্রিল) ভোররাতে পাকসেনারা ট্রেনে করে সিরাজগঞ্জ আসে। আমাদের বাড়ি রেললাইনের পাশে হওয়ায় ট্রেন আসার শব্দ শুনে আমরা পরিবারের সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। খোকসাবাড়ি হাসপাতালের কাছে গিয়ে দেখতে পাই তিনজন এক আহত মানুষকে নিয়ে উদ্ধশ্বাসে ছুটে যাচ্ছে। তাদের কাছে শুনতে পাই, শহরে মিলিটারি এসে গেছে। তাদের গুলিতে আহত হয়েছে ওই মানুষটি। ওইদিন আমরা গিয়ে আশ্রয় নেই বহুলীর খাগা গ্রামে ফুপাতো ভাই মোজাহের আলী মুন্সীর বাড়িতে। দিনের বেলায় দূর থেকে দেখতে পাই আমাদের গ্রামসহ শহরের পাশ্ববর্তী গ্রামগুলি মিলিটারির আগুনে পুড়ছে। পরের দিন আমি আর আমার ভাই হোসেন আলী আকন্দ অবস্থা বুঝতে গ্রামে আসি। দেখতে পাই, আমাদের শালকাঠের ঘরবাড়িতে তখনও আগুন জ্বলছে। আমরা দুই ভাই কোনও রকমে আগুন নেভাই। গ্রামের প্রায় পনেরটি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় সেদিন। সেখান থেকে বের হয়ে গ্রামের ভিতরে অবস্থা দেখতে যাই। রেললাইনের পাশে দেখতে পাই, বড় বাড়ির আয়নাল প্রামানিকের গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে। শেয়াল-কুকুর শহিদের সে লাশ খুবলে খাওয়ার চেষ্টা করেছে। আমাদের কিছুই করার ছিল না, আমরা দুই ভাই খাগায় গিয়ে তার আত্মীয়-স্বজনকে খবর দেই।
বয়সটা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার হলেও বড় ভাইয়ের বারণে আর যাওয়া হয় না মুক্তিযুদ্ধে। পাকসেনারা আসার পর পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মীরা জেগে ওঠে, গঠন করা হয় শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী। বিপদে পড়ে বা তাদের সাহসে লোকজনের চলাচলা শুরু হয়। আড়াই/তিন মাস আমরা খাগা গ্রামেই থাকি, পরে আমরাও চলে আসি নিজ গ্রামে। ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় বলে আমার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে যাই আমার শশুরবাড়ি খাড়–য়া গ্রামে। আমি রাণীগ্রাম আর খাড়–য়ায় নিয়মিত ঘোরাফেরা করতে থাকি। ভাটপিয়ারী যুদ্ধের দিনে আমি ছিলাম খাড়–য়া গ্রামে। সেখান থেকেই শুনেছি গোলাগুলির শব্দ। পরের দিনই পাকসেনারা ভাটপিয়ারী ক্যাম্প বন্ধ করে শহরে চলে যায়। তার সাতদিন পর শহর থেকে পাকসেনারা এসে ভাটপিয়ারীতে গণহত্যা চালায়। এরপর থেকেই বৃদ্ধি পায় মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা। তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়েছে। মনে আছে, মাঝে মধ্যেই দেখা পেতাম খোকসাবাড়ির বরুণ, আবু সাইদ ভূঁইয়া ও বাবলুর সঙ্গে। শৈলাবাড়ি যুদ্ধের আগে প্রচার করা হয় যে, সেখানকার পাকসেনা ক্যাম্পে হামলা চালাবে মুক্তিযোদ্ধারা। এলাকাবাসী অনেকেই তখন এলাকা ছেড়ে চলে যায়। আমিও চলে যাই আমার শশুরবাড়ি খাড়–য়া গ্রামে। কয়েকদিন ধরে তুমুল যুদ্ধ হয় আমাদের এলাকায়। আমাদের বাড়ির পাশের রেল ক্রসিংয়েও যুদ্ধ হয় শেষ দিন। সেখানে অন্তত ছয় জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। আমি সেদিনও আমার শশুরবাড়ি খাড়–য়াগ্রামে। শেষ যুদ্ধের দিন (১৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন বসে আছি পুরান রেললাইনের ওপর, তখন কয়েক জন আমাদের সামনে দিয়ে নিয়ে যায় শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আহসান হাবিবের মরদেহ। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। পরেরদিন আমরা গ্রামের মানুষ ও তার সহযোদ্ধারা শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আহসান হাবিবের জানাজা ও দাফনে অংশ নেই। শহিদ ইঞ্জিনিয়ার আহসান হাবিবকে কবরস্থ করা হয় খাড়–য়া ঈদগাহ মাঠের পাশের কবরস্থানে। সেদিনই মুক্ত হয় সিরাজগঞ্জ শহর। তার পরের দিন আমি চলে আসি আমার নিজ গ্রাম রাণীগ্রাম। আজিজল হক আকন্দ (৭১), তাঁত শ্রমিক। ৬ সন্তানের জনক। সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ২০ জুন ২০২১ বিকেলে, রাণীগ্রাম বাজারে।
অনুলিখনে- সাইফুল ইসলাম,
মুক্তিযোদ্ধা-লেখক-সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক