ভাঙ্গার জান্দী গ্রাম, গাভা নরেরকাঠী গণহত্যা ১৯৭১ য়ের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্ষা বিনাশ করতে সমগ্র দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযঞ্জ সংগঠিত করে। পরবর্তী নয় মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালী নিধন অব্যাহত থাকে। এসব গণহত্যায় ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে কানাচে রয়েছে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভুমি ও গণকবর। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন দীর্ঘ নয়মাস ধরেই পাকবাহিনীরা গণহত্যা সংগঠিত করে। তারমধ্যে আজ ২ মে সংগঠিত হয় ফরিদপুরে ভাঙ্গার জান্দী গ্রাম, বরিশালের গাভা নরেরকাঠী গণহত্যা সংগঠিত হয়।
ভাঙ্গার জান্দী গ্রাম গণহত্যা : ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম জান্দী। ১৯৭১ সালের পূর্বে এই গ্রামের সাথে ভাঙ্গা উপজেলার যাতায়াত ব্যবস্থা তেমন ভালো ছিলনা, ভাঙ্গা হতে ২ কি. মি. দক্ষিণে নওপাড়া নামক স্থান হতে পায়ে হেটে ৩ কি. মি. ভিতরে যেতে হতো। ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফরিদপুর জেলায় প্রবেশ করে, ফরিদপুরের শ্রী-অঙ্গনে ঢুকেই প্রথমে তারা ৮ জন সাধুকে হত্যা করে। এ খবর ফরিদপুরে ছড়িয়ে পরলে ফরিদপুর শহরের হিন্দুরা ফরিদপুর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে থাকে। ফরিদপুরের আন্যতম পরিবহন ব্যবসায়ি টনিক সেন সপরিবারে ফরিদপুর শহর ছেড়ে জান্দী গ্রামে তার এক নিকট অত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। তিনি ফরিদপুর শহর ছাড়ার আগে ফরিদপুর ফিলিং ষ্টেসন হতে তেল সরিয়ে রেখে আসে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তার পবিরহন দিয়ে সাহায্য করেন। এতে পাকিস্তানী সেনারা খিপ্ত হয়ে তাকে খুজতে থাকে। টনিক সেনের ড্রাইভার রাজাকার এমদাদ কাজী কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে টনিক সেনের অবস্থান বলে দেয়। ২ মে ১৯৭১ ভোর ৩টার সময় রাজাকার শাহজাহান মাস্টার, এমদাদ কাজী, জৈনক হারুন মেম্বার ও টনিক সেনের ড্রাইভার সহ প্রায় শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য জান্দী গ্রাম ঘিরে ফেল। পাকিস্তানি সৈন্যরা জান্দী গ্রামে টনিক সেনকে ধরতে প্রথমে বণিক পাড়ার আক্রমণ চালায়। টনিক সেনকে গুলি ও বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। টনিক সেনের ভাগনে সুকেশ সেন ছিলেন ফুটবল খেলোয়াড়। কালীমোহন সেনের বাড়িতে ওই দিন একসঙ্গে ১৮ জন ব্যক্তিকে ধুতি দিয়ে বেঁধে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। পরে বেয়নেট দিয়ে কোপানো হয়। ১৭ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। গুলিতে যারা মারা যায়নি তাদের বেয়নেট দিয়ে খুজিয়ে হত্যা করে। তবে একজন সেদিনের মতো বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি ব্যবসায়ী রতিকান্ত চন্দ্র। তারা পূজারত আবস্থায় জান্দী গ্রামের মন্দিরের পূরহিদকে মন্দিরের ভিতরেগুলি করে হত্যা করে। মন্দিরের পাশের হিন্দু বাড়ি গুলো হতে পরুষদের ধরে হত্যা করে এবং নারীদের নির্যাতণ করে। তাদের হত্যা ও নির্যাতন করার পর, ঐ গ্রামে আত্মগোপন করে থাকা হিন্দু পুরুষদের ধরে হত্যা করে। সেদিন ৪১ জনের বেশি পুরু কে হত্যা কওে তারা । অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হয়। এরপর তারা মালামাল লুট করে ভাঙ্গা থানায় চলে যায়। পরর্বতীতে তাড়া গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা এদিন ফরিদপুর সদরের ঈশান গোপালপুর গ্রামের স্থানীয় জমিদার ঈশান সরকারের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া ২৮ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। হত্যাকান্ডের পর পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর এলাকাবাসী সরকার বাড়ির পুকুর পাড়ে তাদের গণকবর দেয়।
গাভা নরেরকাঠী গণহত্যা : ১৯৭১ সালের এদিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দেশীয় সহযোগী রাজাকার কর্তৃক বরিশালের গাভা নরেরকাঠী গ্রামে বাঙালি হিন্দুদের ওপর সংঘটিত একটি গণহত্যা। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারেরা সেদিন প্রায় ১০০ জন বাঙালি হিন্দুকে হত্যা করে। গাভা নরেরকাঠী বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার অন্তর্গত একটি গ্রাম। ১৯৭১ সালের আগে গাভা স্কুলবাড়ি ও গাভা বাজার এলাকা মূলত হিন্দু-প্রধান গ্রাম ছিল। ১৯৭১ সালের ২ মে সকালে আশেপাশের গ্রামের রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী গাভা নরেরকাঠী গ্রামে প্রবেশ করে। তারা শান্তি কমিটির সভার কথা বলে গ্রামের হিন্দু পরিবারের লোকদের বেরিযে আসতে বলে। পরে স্থানীয় রাজাকারেরা তাদের আটকে নিকটবর্তী খালের ধারে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। হত্যাকান্ডের পর পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর এলাকাবাসী সরকার বাড়ির পুকুর পাড়ে ২৮ জনের লাশ গণকবর দেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গণহত্যার স্থানটি গ্রামবাসীরা চিহ্নিত করে । ১৯৭১ সালে এদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা ইতিহাসের নির্মম ঘটনা । সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড ঘটেছে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে হার মানায়। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তারাই অনুপ্রেরণা হয়ে ভবিশ্যত প্রজন্মকে পথ দেখাবে। তথ্যসুত্র- মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
লেখক , কাজী সালমা সুলতানা , গবেষক এবং গণমাধ্যম কর্মী ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading