অ্যাডভোকেট আনসার খান :বিশ্বের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মানদণ্ডে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে ইতোমধ্যেই চীন স্হান করে নিয়েছে এবং আমেরিকাকে পেছনে ফেলে শীর্ষ স্হানটা দখলে নিতে চীনারা অব্যাহত চেষ্টা করে চলেছে।এজন্য অর্থনৈতিক বিকাশ ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে অর্থনীতির সকল শাখায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করছে।বিশ্বের বাজারগুলো চীনের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটা অর্থনীতিতে আমেরিকাকে পেছনে ফেলে দেবার লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন চীনা নেতা শি জিন পিন।

শুধু অর্থনীতিই নয়,ক্রমবর্ধমানভাবে সামরিক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি,ন্যাভাল ফোর্সের জন্য উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর যুদ্ধ জাহাজ,সাবমেরিন ইত্যাদি সংযোজন,নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করে সমরাস্ত্রের আধুনিকায়ন,পারমাণবিক অস্ত্রের উৎপাদন, বিপনন,নিজেদের ভূখণ্ডের বাইরে সামরিক ঘাঁটি স্হাপন করে একুশ শতকের চ্যালেন্জ গ্রহণে সক্ষম প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে চীনা কর্তৃপক্ষ।

চীনের মূল লক্ষ্য হলো একুশ শতকের বিশ্বব্যবস্হার নিয়ন্ত্রণ, বিশ্বে রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারণী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য দেশকে উপযোগী করে তোলা।অর্থাৎ একুশ শতকের, ‘গেইম অব গ্রেট পাওয়ারস’প্রতিযোগিতার জন্য সক্ষমতা অর্জন করে আমেরিকাকে টপকে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের একদম শীর্ষ নেতৃত্বের স্হানটা অলংকৃত করাই হলো চীনের চুড়ান্ত লক্ষ্য।

শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির বলে বিশ্বের নেতৃত্বের আসন অলংকৃত করার কাজটা এতটা সহজ নয়,এজন্য দরকার বিশ্বের জাতিগুলোর সমর্থন ও সহযোগিতা, বিশ্বাস এবং আস্হা অর্জন করা।চীন এজন্য তার এতোদিনের একঘরে বদ্ধ পররাষ্ট্র নীতি উম্মূক্ত করে ঢেলে সাজিয়ে অন্যান্য জাতিগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্হাপনের জন্য বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে এসেছে কয়েক দশকধরে।প্রতিবেশীসহ বিশ্বের অসচ্ছল,অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল জাতি ও দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে, গ্রহণ করেছে,”ব্ল্যান্ক চেকবুক কূটনীতি।”চেকবুক কূটনীতির মাধ্যমে বন্ধু দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন।আর্থিক বিনিয়োগ করেই চীন তার প্রভাব বিস্তার ও অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার সূযোগ নিচ্ছে।অর্থাৎ বেইজিং অর্থনীতিকে তার সম্প্রসারণবাদী নীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আর্থিক সহযোগিতাপ্রাপ্ত দেশগুলো চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।এভাবেই চীন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রভাব বৃদ্ধি করে চলেছে।সারা বিশ্বের দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে,’বেল্ট এন্ড রোড’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

চীন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধু রাষ্ট্রের খোঁজে নজর দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়া এবং উত্তরপূর্ব এশিয়ার ও আফ্রিকার দেশগুলোর দিকে।আর মধ্যপ্রাচ্যকে তার ভবিষ্যতের শক্তির জন্য অপরিহার্য পিভট হিসেবে বিবেচনা করছে।চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি.ওয়াং সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য সফরকালে”মধ্যপ্রাচ্য অঞ্জল বিশ্বের একটি চৌরাস্তায়”অবস্হিত বলে মন্তব্য করেছেন। এর থেকেই মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে চীনাদের আগ্রহের বিষয়টা স্পষ্ট হয়েছে।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিনের বিখ্যাত-“তিন না নীতি”অর্থাৎ চীন কোনোও প্রক্সির সন্ধান না করার,নিজেদের স্বার্থের কোনোও ক্ষেত্র অনুসন্ধান না করার এবং মধ্যপ্রাচ্যের কোনোও শক্তির শূন্যতা পূরণের চেষ্টা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে,অর্থাৎ এতিনটা নীতির দ্বারা পরিচালিত হয়ে চীন তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি নির্ধারণ করে মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী হয়ে ওঠেছে।তবে তিন না নীতির কারণে ওখানটায় এখনঅবধি চীন কোনোও প্রকারের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেনি।কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের ভূমিকা রাখার আগ্রহ যতোই বাড়ছে,মধ্যপ্রাচ্য ততোই চীনাদের নজর টানছে।

ইতোমধ্যে চীনা অর্থনৈতিক সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা দেশে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। চীন মধ্যপ্রাচ্যের কমপক্ষে পাঁচটা রাষ্ট্রের সাথে “কমপ্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশীপ(সিএসপি) বা বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারত্ব” চুক্তি স্বাক্ষর করে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেছে।২০১৫ সালে ইরাক,২০১৬ সালে সৌদি আরব এবং ২০১৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলো চীন।

সর্বশেষ ইরানের সঙ্গে অনুরূপ কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি সই করেছে গত মাসে।ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত চীনের এ চুক্তি চীন-ইরান সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাইয়েদ খাতিবজাদেহ-চীন ও ইরানের মধ্যে ২৫-বছর মেয়াদী স্বাক্ষরিত এ চুক্তিকে,”পরবর্তী কোয়ার্টার শতাব্দীর জন্য উভয় রাষ্ট্রের সম্পর্কের পূর্ণাঙ্গ রোড ম্যাপ”হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

‘বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারত্ব’-হলো একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিদেশ নীতির হাতিয়ার। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুরক্ষা সহযোগিতার জন্য রোড ম্যাপ চুক্তি স্বাক্ষর করে চীন এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছে যে মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্বিতায় জড়াবে না বা অনুরূপ কোনো বিরোধে উসকানি দেবে না।

মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা চীনের অর্থনৈতিক বানিজ্যের জন্য অপরিহার্য একারণে যে,চীনের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য তেলের সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন রাখা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চীন প্রতিদিন হরমুজ প্রণালী দিয়ে তিন মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি করে থাকে। কাজেই মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জন্য হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে চীনা অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পড়বে।

এ চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে চীন-ইরানের মধ্যেকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ট হবে এবং এতে করে উভয় রাষ্ট্রের বিরাজমান বানিজ্যের জটিলতা নিরসন হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো বলে মনে করেন বিশ্লেষকগণ।অন্যদিকে,আমেরিকা ও জাতিসংঘের ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে ইরান বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এমন একটা অবস্থার মধ্যে দেশটার সাথে বিশ্বের উদীয়মান শক্তিধর রাষ্ট্র চীনের ২৫-বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে ইরানের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা নিরসনের একটা সূযোগ সৃষ্টি হয়েছে।বিশেষকরে,বিশ্ব থেকে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য আমেরিকান চাপকে হ্রাস করবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।কেননা,চীন ইরানকে তার রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদার সুরক্ষার পক্ষে দৃঢ় সমর্থন করে বলে জানিয়েছেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং।

জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি ও জাতীয় উন্নয়নের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়েছিলো।চীনের সাথে স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক ও সুরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির ফলে চীন ইরানের জাতীয় উন্নয়নে পঁচিশ বছরে চার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এবং ইরান অব্যাহতভাবে চীনের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহ করে যাবে।

চীন-ইরান চুক্তির একটা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দিক রয়েছে। এমন একসময়ে চুক্তিটা হয়েছে,যখন বিশ্বশক্তি আমেরিকা চীন ও ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা নতুন করে চাপিয়ে দিয়েছে। ইরান আমেরিকার ঘেরাটোপে পড়ে জাতীয়ভাবে বিপর্যস্ত এবং অন্যদিকে উদীয়মান বিশ্বশক্তি চীন বিশ্বব্যাপী শক্তির বিন্যাস তার পক্ষে নিয়ে আসার জন্য মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে,যেখানে আমেরিকার রয়েছে একাধিপত্য। আমেরিকার ওই একাধিপত্য খর্ব করে ওই অঞ্চলে চীন আধিপত্য বিস্তার করতে সচেষ্ট হয়েছে।মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক ক্ষমতায় চীনকে অভিষিক্ত করার লক্ষ্যে একবিরাট কর্মসূচির অংশ হিসেবে তুরস্ক থেকে ইরান এবং উপসাগরীয় দেশগুলোতে সফরকালে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং চীন-ইরান ঐতিহাসিক ওই চুক্তিটা স্বাক্ষর করেছিলেন,যা ওই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়ে ওঠেছে।

চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের মাঝে ভবিষ্যত সম্পর্কের জন্য পাঁচটা নীতিনির্ধারণ করেছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং। এগুলো হলো,পরস্পরকে সম্মান করা,ন্যায়বিচারকে সমর্থন করা,পারমাণবিক বিস্তার রোধে যৌথভাবে উৎসাহিত করা, যৌথ নিরাপত্তার সুরক্ষা সহযোগিতা এবং যৌথ উন্নয়ন সহযোগিতা ত্বরান্বিত করা।চীন তার লক্ষ্য অর্জনে একে একে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে চলেছে। ইরান ওই অঞ্চলের আমেরিকা বিরোধী একটা গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, তার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে চীন তার আন্তর্জাতিক শক্তি হয়ে ওঠার জন্য অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলে অনুমতি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অধ্যাপক রিচার্ড ফালক মন্তব্য করেছেন যে,চীন-ইরান চুক্তি ওই অঞ্চলে বেইজিংয়ের”আরও একটা এজেন্ডা হওয়ার তৎপরতা”যা একটা “নতুন যুগ” হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।

অন্যদিকে,তেহরানভিত্তিক সাংবাদিক ও ইরান বিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফাতিমা করিম খান ওই চুক্তিকে “গেম চেন্জার”হিসেবে দেখছেন না।তবে চীনকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের আরও স্থিতিশীল পথ খুঁজে পাওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম একটা পথ হিসেবে দেখছেন।’তাঁর মতে,”চীন ট্রেনটায় পা রাখার অপেক্ষায় রয়েছে এবং এতে অনেক আশাবাদ অত্রাঞ্জলে আমেরিকার প্রতিস্হাপন বা বিকল্প হিসেবে চীনের উত্থান ঘটবে।”

এ অঞ্জলে আরও বৃহত্তর ভূমিকা পালন সম্পর্কে তাদের ভবিষ্যতের রাজনৈতিক স্বার্থের ইঙ্গিত দিয়ে চীনা কর্মকর্তারা সম্প্রতি বলেছেন, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনীদের মধ্যেকার বিরোধ মিমাংসায় সরাসরি আলোচনায় চীন মধ্যস্হতা করবে।

মস্কো ভিত্তিক ইউরেশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক এসরাফ ইয়ালিনকিছিলির মতে আমেরিকান শক্তির অব্যাহত উপস্থিতি প্রতিহত করার জন্য চীন উদীয়মান শক্তি হিসেবে ইরান ও রাশিয়ার’উভয়ের সাথেই-,”কৌশলগত জোট”গড়ে তোলতে চায় এভাবেই চীন আগামী আন্তর্জাতিক বিশ্বের নেতৃত্বের আসন অলংকৃত করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার কাজটা করে চলেছে।

লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading