বাংলা সিনেমার মিষ্টি মেয়ে কবরী করোনার কাছে হেরে চলে গেলেন অনন্তলোকে। জীবনে চলার পথে বহু প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি জয়ী হয়েছেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে জয়ী হন। কিন্তু মহামারি করোনায় বাংলা সিনেমার কালজয়ী এই কিংবদন্তি নায়িকা, চলচ্চিত্র পরিচালক, সাবেক সংসদ সদস্য কবরীকেও কেড়ে নিলো। এক নক্ষত্র হারিয়ে গেল। ‘সুতরাং’ থেকে শুরু করে ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘অবাক’, ‘দ্বীপ নেভে নাই’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘ময়নামতি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সারেং বৌ’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘সুজন সখী’ ‘রংবাজ’, ‘দেবদাস’, ‘বধূ বিদায়’সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে অনবদ্য সাবলীল অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেন বাংলার চলচ্চিত্রের স্নিগ্ধ ছড়ানো নায়িকা কবরী। চরিত্রের প্রয়োজনে কোনো কোনো সময় তিনি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগৎও ছিল প্রতিযোগিতাপূর্ণ। সেই সময়ে বাংলা সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষের নিজের মানুষ হিসেবে স্থান করে নিয়েছিলেন কবরী। ‘মিষ্টি মেয়ে’ নামে কবরী সব শ্রেণির দর্শকের আপন হিসেবে অবস্থান গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, যা চলচ্চিত্র জগতের অন্য কেউ পারেননি। সেই ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবেই দর্শকের হৃদয়ে অবস্থান করেছেন এবং নিজের জনপ্রিয়তা রক্ষা করে গেছেন যতদিন অভিনয় করেছেন। কবরী ১৯৫০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম ছিল মিনা পাল। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত পরিচালক সুভাষ দত্ত ১৯৬৪ সালে তার ‘সুতরাং’ ছবির জন্য প্রথম নায়িকা নির্বাচন করেন তাকে। ১৩ বছরের সেই কিশোরী মিনা পাল চলচ্চিত্রে এসে হয়ে যান কবরী। কবরী নামটি দিয়েছিলেন সৈয়দ হক। সুতরাং চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই কবরী অভিষিক্ত হন। অনেক আগে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেন, ‘সুতরাং’ সিনেমার কিশোরী কবরী দর্শকদের কাছে যে এতটা জনপ্রিয়তা পাবেন, তা তিনি ভাবতেই পারেননি। সেই সময়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে তাকে প্রচুর রিহার্সেল করতে হয়েছিল। চোখ তুলে তাকাতে সাহস পেতাম না, খুব লজ্জা পেতাম। সব দত্তদা (সুভাষ দত্ত) শিখিয়েছেন। কিন্তু ‘সুতরাং’-এর পর আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপরের দুই দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে বিচরণ করে সাবলীল গতিতে রানীর আসনে বসেন।
একে একে অভিনয় করেছেন দর্শকপ্রিয় ছবি থেকে শুরু ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রসহ নানা ধরনের চলচ্চিত্রে। এসব চরিত্রায়নে তিনি যে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তা শুধু চলচ্চিত্রকেই দর্শকপ্রিয়তা দেয়নি, নিজেও আসন করে নিয়েছেন দর্শকের হৃদয়ে। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন কবরী। কবরীকে সিনেমার পর্দায় বাংলাদেশি সাধারণ মেয়ের মতোই দেখা যেত। বাস্তবের গ্রামীণ নারী বা শহুরে মধ্যবিত্তের ঘরের মেয়ের চরিত্রটাও তেমনি ছিল। অভিনয় শিল্পী হিসেবে স্বকীয়তা ও সহজাত গুণ কবরীকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। ‘মিষ্টি মেয়ে’ ছাড়াও ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ হিসেবেও কবরীর পরিচিতি ছিল। তার মুখের গড়ন, আচরণ ও অভিনয়গুণ মানুষের মনে তেমন ধারণার জš§ দিত আর তিনি হয়ে যেতেন দর্শকের আপনজন। অভিনয়কালে সাধারণ মেকআপ এবং সাধারণ মেয়েদের মতো করে চুল সাজাতেন। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের নৈপুণ্যতা দিয়ে একাধিকবার দখল করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চলচ্চিত্রে দর্শকরা সবসময় তাদের পছন্দের নায়কের সঙ্গে পছন্দের নায়িকাকে দেখতে চান। সে কারণে চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকার জুটি একটা বড় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সিনেমায় ‘নায়করাজ’ হিসেবে পরিচিত রাজ্জাকের সঙ্গে কবরীর জুটি ছিল অসাধারণ দর্শকপ্রিয়। বলা যায় বাংলাদেশের সিনেমায় এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠা জুটির মধ্যে রাজ্জাক-কবরী জুটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত। বাংলাদেশের সিনেমায় এ জুটি নিয়ে গানও রচিত হয়েছে। এই জুটি নিয়ে একাধিক সাক্ষাৎকারে কবরী কথা বলেছেন। এক সাক্ষাৎকারে কবরী এ জুটি সম্পর্কে বলেন, অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় প্রেম করা হয়নি। কিন্তু রাজ্জাকের সঙ্গে অভিনয় করার সময় এক ধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করতাম। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই সফল অভিনেতা কবরী চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও চলচ্চিত্র নির্মাণেরও কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র জগতের বাইরেও তার ছিল এক বিশাল জগৎ।
তিনি সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন, সচেতন থেকেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শানিত রাখার বিষয়ে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুকালে কবরী ইস্কাটনে থাকতেন। যুদ্ধ শুরু হলে সেখান থেকে চলে যান চট্টগ্রামে। সেখান থেকে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। গ্রামের বাড়ি থেকে অনেক কষ্টকর পথ পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা চলে যান। কলকাতায় থাকাকালে উদ্বোধন করা হয় বাংলাদেশ হাইকমিশন। সেই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে কবরী বক্তৃতা করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতেই কবরী তার বক্তৃতা শেষ করেন। তার বক্তৃতা সংবাদমাধ্যমে সারা জাগে। কলকাতায় থাকাকালে আর্থিক ও অন্যান্য কারণে সিনেমায় সুযোগ পাওয়ার চেষ্টা করেন কবরী। কলকাতা সিনেমার নামকরা নির্মাতা সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, উত্তম কুমারসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে চলে যান মুম্বাইতে। কিন্তু তিনি সিনেমায় কাজ করার সুযোগ পাননি। অবশেষে আইএস জোহরের পরিচালনায় জয় বাংলাদেশ সিনেমার জন্য ২০ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন। সেই ২০ হাজার টাকার মধ্যে ১০ হাজার টাকা বাংলাদেশ হাইকমিশনের তহবিলে জমা দেন। সিনেমাটি খুব ব্যবসা সফল হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত ছিলেন কবরী। বছর চারেক আগের এক আলোচনা সভায় বক্তৃতাকালে কবরী যুদ্ধকালে এদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের বর্ণনা করেন অশ্রুসজল নয়নে। নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী শফিউদ্দিন সারওয়ারকে বিয়ের পর তিনি কবরী সারওয়ার নামে পরিচিত পান। ২০০৮ সালে তাদের বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে। এরপর কবরী রাজনীতিতে আসেন এবং তখন থেকে তিনি সারাহ বেগম কবরী নামে পরিচিত। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্র্থী হিসেবে কবরী নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বিজয়ী হয়ে ২০০৮-২০১৩ মেয়াদে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই গুণী অভিনেত্রী পরিচালক বাংলা সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছেন, রেখে গিয়েছেন অনেক স্মৃতি। সেই স্মৃতি নিয়ে হৃদয়ের মনিকোঠায় রয়ে যাবেন বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে কবরী ।
কাজী সালমা সুলতানা , লেখক এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading