মার্চ ১৮, ১৯৭১, বৃহস্পতিবার। সকাল ৮টা। বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের ১৬তম দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রায় জনশূণ্য। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ছাত্রছাত্রীরা যার যার বাড়িঘরে চলে গেছে। হলগুলো ফাঁকা। যারা সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে ব্যস্ত তারা ছাড়া আর কেউ হলে থাকে না। সন্ধ্যার পর সার্জেন্ট জহুর হলের ক্যান্টিনের আশেপাশে ও মাঝ রাতে আনোয়ার হোটেল ছাড়া আর কোথাও কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র সমাবেশ চোখে পড়ে না। ছাত্র লিগের মধ্যে আমরা যারা সশস্ত্র সংগ্রামপন্থী অর্থাৎ সিরাজুল আলম খানের অনুসারি তারা ৭ মার্চের ভাষণকেই স্বাধীনতার ঘোষণা হিসাবে ধরে নিয়ে লড়াইর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলাম। ইউওটিসির ডামি রাইফেল দিয়ে জহুর হলের মাঠে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকেই। সব মিলিয়ে পনের কুড়ি জন। গভির গোপনীয়তার মধ্যে। রাত দুটা থেকে তিনটা। এই এক ঘণ্টা। সেনা বাহিনীর কমান্ডোরা চারদিকে ছেয়ে আছে। ওরা জানলেই আক্রমণ করে বসবে।
যুদ্ধ করবো, অস্ত্র কোথায়? তখন বন্দুক,রাইফেল ও মেশিনগানের তফাত কি সেটাও কেউ জানতো না। আমার একটা বন্দুক ছিল বিধায় আমি সে সবের কিছুটা জানতাম। অস্ত্র নাই বটে তবে মাথায় এটা ঢুকে গেছিল যে যুদ্ধের জন্য fire weapon যোগাড় করতে হবে।
১৮ মার্চ সকালে সূর্যসেন হলের ক্যান্টিনে নাস্তা করতে বসেছি। আমি, আমার এক বছরের সিনিয়র আহমদ শরিফ মনিরসহ আরো পাঁচ-ছয় জন। নাস্তা শেষ করে এটা ওটা নিয়ে কথা হচ্ছে। হঠাৎ আমার মাথায় ঢুকলো অস্ত্র তো হাতের কাছেই আছে।
শরিফ ভাইকে বললাম, উঠেন তো। রাইফেল দু’টার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। টেবিলের সবাই আমার কথায় হতবাক। আমার কিন্তু ততক্ষণে রক্তের মধ্যে সেই টগবগানো শুরু হয়ে গেছে।
নাস্তা করতে করতেই আমার মনে পড়েছিল রেজিস্ট্রার্স বিল্ডিং-এ ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (বর্তমানে সোনালী ব্যাঙ্ক) ও টিএসসির ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক (বর্তমানে জনতা ব্যাঙ্ক) -এর দুই ব্যাঙ্কের দুই নিরাপত্তা প্রহরীর কাঁধে যে দু’টা দোনলা বন্দুক আছে সে দুটো তো আমরা এক্ষুণি গিয়ে এক থাবা মেরে নিয়ে আসতে পারি। তখন সাড়ে নয়টা। ব্যাঙ্ক খোলে দশটায়। আমার প্রস্তাবে দু একজনের মুখ একটু ফ্যাকাশে হলেও সবাই আমার সাথে চললো।
গিয়ে দেখি ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি গার্ড সবে মাত্র ব্যাঙ্কের কোলাপসিবল গেটটি খুলেছেন। আমি তার খুবই পরিচিত। আমার বন্ধু শাজাহান খন্দকার ঐ ব্রাঞ্চের ক্যাশিয়ার। স্কলারশিপের টাকা তোলার জন্য সারাক্ষণই আসা যাওয়া করি। দেখে আমাদের সালাম দিলেন। সালামের জবাব দেবার আগেই আমি তাকে জাপটে ধরে একটানে তার হাতের দোনলা বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়ে নিলাম। তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ভাই এই কাম কইরেন না। ততক্ষণে আমি তার কাঁধের কার্তুজের বেল্টটাও খুলে নিয়ে কারো একজনের হাতে দিয়ে দিয়েছি। ভয়ে কাঁপতে থাকা গার্ডকে ভরসা দিয়ে বললাম, ভাইজান আমরা ব্যাঙ্ক লুঠ করতে আসি নাই। বন্দুক আর গুলির জন্য আসছি।
বন্দুক আর কার্তুজ নিয়ে ‘জয় বাঙলা’ স্লোগান দিতে দিতে আমরা এবার ছুটলাম টিএসসির দিকে। লক্ষ্য ইউবিএল। আমরা যখন ইউবিএলে পৌঁছলাম তখন দশটার দু এক মিনিট বেশি। আমার এক হাতে বন্দুক অন্য হাতে কার্তুজের বেল্ট। তাতে গোটা বিশেক লাইভ এমুনেশন। ঢোকার মুখেই বন্দুকধারি গার্ড। একই পদ্ধতিতে তার বন্দুক ও কার্তুজ-বেল্ট ছিনিয়ে নিয়ে শরীফ ভাইর হাতে দিলাম। ম্যানেজারের রুমে ঢুকে বললাম, একদম ভয় পাবেন না। আমরা শুধু বন্দুক আর কার্তুজই নেবো, আর কিছু না।
আমরা সাত-আটজন এরপর আবারো ‘জয় বাঙলা’ স্লোগান দিতে দিতে সূর্যসেন হলের ক্যান্টিনে ফিরে এলাম।
সমস্যা দেখা দিলো এই দুই বন্দুক আর কার্তুজের বেল্ট রাখবো কোথায়? সবাই ভয় পাচ্ছে। কখন মিলিটারি এসে হামলা করে! অবশেষে ঠিক হলো ওগুলো আমার ৫২৮ নম্বর রুমেই থাকবে। রুমের কোথায়? যে ভাবেই রাখি না কেন, বাইরে থেকে দেখা যাবে। অতএব বিছানার দু’পাশে দুটোকে তোশক চাপা দিয়ে রাখলাম। কার্তুজগুলো ওয়ার্ডরোবে। আজ এ পর্যন্ত থাক। জয় বাঙলা।
শামসুদ্দিন পেয়ারা , লেখক এবং সাংবাদিক ।