নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর মিরপুরের অন্যতম চাঁদাবাজ ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন গ্রেফতারের পর কিছুটা সস্তি ফিরে আসলেও কার্যত চাঁদাবাজি তো বন্ধ হয়নি বরং মামুনের জায়গা দখল নিতে তৈরী হয়েছে ঠান্ডা লড়াই। ইতোমধ্যে মামুনের সহযোগীরা গা ঢাকা দিয়েছে। মামুনের শুন্যতার সুযোগ নিয়ে এখনই তৈরী হয়েছে সিন্ডিকেট। বিশেষ করে পল্লবীতে গজিয়ে উঠা নতুন সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলছে চাঁদাবাজি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এ বিষয়ে নজরদারী অব্যাহত রয়েছে। চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পল্লবীর চাঁদাবাজি : মিরপুরের পল্লবীর বাসিন্দারা বলছেন, রাজধানীর পল্লবীতে চাঁদাবাজিতে অতিষ্ট সাধারণ মানুষ। লেগুনা স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনা সবই যেন চাঁদাবাজির উৎস। এলাকায় এমন কোন উৎস নাই যেখানে চাঁদাবাজি হচ্ছেনা। সাধারণ লোকজন বলছেন, পরিস্থিতি এমন যে আপনি হাঁটাচলা করলেই এলাকার বিশেষ কয়েকজন লোককে চাঁদা দিতে হবে, নইলে আপনি হাঁটতেও পারবেন না। শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন গ্রেফতারের পর তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও বর্তমানে নতুন সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর পল্লবীর এভিনিউ ৫ ও মিরপুর ১০ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন অঞ্চল ২ এর কার্যালয়ের পাশে গড়ে ওঠেছে অবৈধ লেগুনা স্ট্যান্ড। একের পর এক লেগুনা ভিড় জমায় এ স্ট্যান্ডে। এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে লেগুনায় ওঠেন যাত্রীরা। এতে চলাচলে সমস্যা হয় পথচারীদের।
পথচারী রাজিব বলেন, সারা দিন এখানে লেগুনা ভিড় জমিয়ে একের পর এক যাত্রী উঠাতে থাকে। লেগুনার জন্য হাঁটতে পারি না। লেগুনাযাত্রী সুফিয়া বেগম বলেন, এ লেগুনাগুলোর জন্য পুরোটা রাস্তায় জট লেগে থাকে। সকালে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় যানজটের কারণে অনেক দেরি হয়ে যায়। এ রাস্তা দিয়ে কোনো বাস চলাচল করে না। তাই চলাচলের সুবিধার জন্য লেগুনা ব্যবহার করতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন পল্লবীর নাভানা টাওয়ার মোড় থেকে মিরপুর ১০ নং গোলচক্কর পর্যন্ত শতাধিক অবৈধ লেগুনা চলাচল করে। এ রুটে লেগুনা নামাতে হলে ৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাজী আমান উল্লাহ আমানের অনুমতি নিতে হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অদক্ষ ও কম বয়সী কিশোররা লেগুনা চালাচ্ছে। প্রত্যেকের বয়স ১৩ বছর থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। এদের কারোই ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। শুধু হাজী আমানের অনুমতিতেই দেদারসে চলছে এ অবৈধ লেগুনা।
মিরপুর ১০ গোলচক্করে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্র্যাফিক পুলিশ বলেন, রাস্তাটিতে লেগুনা পার্ক করা অবৈধ। তবে যাত্রী নামানোর জন্য গাড়ি দাঁড় করার অনুমতি আছে। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে রাখলে ওদের উঠিয়ে দেয়া হয়।
ভাসমান বাজারে চাঁদাবাজি : শুধু অবৈধ লেগুনা নয় আমানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এভিনিউ ৫ এ অবৈধভাবে গড়ে উঠা ভাসমান বাজার। পল্লবীর ১১/সি এভিনিউ ৫’র ৮ নং লাইনের মোড় থেকে শুরু করে আব্বাস উদ্দিন স্কুলের মোড় পর্যন্ত রয়েছে ২০০ দোকান।
সড়ক ও জনপথের (সওজ) এর জায়গা দখল করে বসানো এ অবৈধ বাজার থেকে হাজী আমান উল্লাহ আমানও তার সহযোগীরা চাঁদা হিসেবে মাসে আদায় করছেন অন্তত ২ লাখ টাকা । এই চাঁদার ভাগ যাচ্ছে সরকারদলীয় নেতা আর পুলিশের পকেটে। আর যাত্রী ও পথচারীরা শিকার হচ্ছেন ভোগান্তির।
বাসাবাড়ির ময়লাতে চাঁদাবাজি : এভিনিউ ৫, মদিনা নগর ও সবুজ বাংলার প্রায় ১৭০০ বাড়ি থেকে ময়লা ও আবর্জনা ডাস্টবিনে ফালানোর জন্য সংগ্রহ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। এ সেবা শহরের নাগরিকদের জন্য ফ্রি থাকলেও মিরপুরে এ সেবা পাওয়ার জন্য চাঁদা দিতে হয় হাজী আমান উল্লাহ আমানকে। প্রতিমাসে এখান থেকেও প্রায় ১ লাখ টাকা ইনকাম করেন হাজী আমান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এভিনিউ ৫ এর ৮ নং লাইনের এক বাসিন্দা নাম নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভাই আমরা তো জানি ময়লা ডাস্টবিনে ফালানোর জন্য কোনো টাকা দিতে হয়না। কিন্তু আমাদের প্রতিমাসে ৫০ টাকা করে দেওয়া লাগে। না দিলে আমানের লোকজন ময়লা সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়। এতে আমাদের ভোগান্তি বাড়ে।
ওয়াসার পানি পূঁজি করে চাঁদাবাজি : মদিনা নগরে দীর্ঘদিন পানির খুব সংকট রয়েছে। এখানে প্রতিদিন ওয়াসা থেকে পানির গাড়ি আনাতে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। কারো পানি প্রয়োজন হলে আমানের মাধ্যমেই পানি সংগ্রহ করতে। আমান ফোন দিলে পানির গাড়ি আসবে সে হস্তক্ষেপ না করলে পানি আসবে না। এজন্য প্রতি গাড়ি পানির জন্য ২২০০ টাকা করে দিতে হয় বলে জানান মদিনা নগরের এক বাসিন্দা।
এভিনিউ ৫ এর ৪ নং লাইনে অবস্থিত মাক্কি জামে মসজিদ কমপ্লেক্সের কয়েকজন মুসল্লী জানান, এ মসজিদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন হাজী আমান উল্লাহ আমান। মসজিদের উন্নয়নের টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগও রয়েছে আমানের বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালে মসজিদের উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। তখন বিল জালিয়াতি করে মসজিদের লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছিল এই ধার্মিক লেবাসধারী আমানের বিরুদ্ধে।
হাজী আমান ডিএনসিসির ৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিকের ঘনিষ্ঠ লোক। এজন্য তার বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে ৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাজী আমান উল্লাহ আমানের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে কেউ এ অভিযোগ প্রমান করতে পারবেনা। লেগুনা চলে জয়নাল, বাবু এদের নেতৃত্বে। এরা কাদের প্রশ্রয় দেয় তারাই জানে। আমি মসজিদেরও সাধারণ সম্পাদক। এলাকায় রাজনীতি করি অনেকেই শত্রু আছে, শত্রুরা এ ধরনের অভিযোগ করতে পারে।
ডিএনসিসির ৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সির কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক বলেন, একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করা হলে পাওয়া যায়নি। পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াজেদ আলি বলেন, চাঁদাবাজির শিকার ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পল্লবী থানা এলাকা থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক মফিজুর রহমান মামুনকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি।তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রবিরোধী একটি সন্ত্রাসী চক্র টার্গেট কিলিং ও ব্যাপক সহিংসতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে চোরাবাজার থেকে অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে মর্মে তথ্য পায় ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেষ্টিগেশন বিভাগ। বিষয়টিতে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সম্ভবনা বিবেচনা করে ছায়া তদন্ত শুরু করে কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেসিটগেশন বিভাগ। উক্ত সন্ত্রাসী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান শুরু করে পুলিশ। সোমবার ভোর ৬.৪০ টায় পল্লবীর বাইতুন নুর জামে মসজিদের পাশে রাস্তা হতে এ সন্ত্রাসী চক্রের সদস্য সন্দেহে এক ব্যাক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।
ডিবি জানায়, মামুন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফেরারী আসামী। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, খুন,মাদক, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাবহার ও ডাকাতির অভিযোগে পল্লবী থানায় ২৭ টি মামলা, ১৫ টি গ্রেফতারী পরোয়ানা ও ২ টি সাজা পরোয়ানার তথ্য পাওয়া যায়।
ডিবি আরো জানায়, গ্রেফতারকৃত মামুন এক সময়ে মিরপুরের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ করতেন। সে ২০০১ সালে কিছুদিন কারাভোগের পর ২০০৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারত গমন করে। পাসপোর্ট জালিয়াতি ও অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেফতার হয় এবং ১০ বছর সাজা ভোগ করে। কারাভোগ শেষে ভারতে বসেই মামুন বিদেশে অবস্থানরত মিরপুরের অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম ও সাহাদাত বাহিনীর প্রধান সাহাদাতের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ ও সমম্বয়ের মাধ্যমে ঢাকার মিরপুর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য তৎপর হয়। গ্রেফতারকৃত মামুন বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ীদের ফোন করে প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করে চাঁদা দাবি করতো। অপরাধজগতে তার অবস্থানকে সুসংহত করতে সম্প্রতি সে ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে।