৭১ সালে কিছু রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটি ছাড়া পুরো জাতি ছিল একটি সূত্রে বাঁধা ৷ একজন মানুষের জীবনে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন সবচেয়ে বড় পাওয়া ৷ যা সবার ভাগ্যে জোটেনা ৷ আমরা যারা প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলাম, তাদের কাছে এটা শুধুই স্মৃতি নয়,অনেক কিছু,যা লিখে প্রকাশ করতে পারবনা ৷
স্বাধীনদেশে সবকিছু ভালভাবে চলবে ,অন্তত যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন তাদের সেই সদিচ্ছা থাকবে এই আশাটা ছিল খুব স্বাভাবিক কারনেই , কিন্তু হয়নি ৷ সেজন্য স্বাধীনতা যুদ্ধটাই বৃথা, ভুল হয়ে গেছে এরকম হতাশা যাদের মধ্যে সক্রীয় তাদের দোষ দেইনা করুনা করি ৷ যে হতাশা থেকে তারা বলেন তার মধ্যে লুকিয়ে আছে তাৎক্ষনিক কিছু না পাওযার বেদনা আর বিক্ষোভ ৷ শাসকদলকে তার রাজনীতির পরিচয়ে না বুঝে শুধু ব্যক্তিক পরিচয়কে সামনে আনা। এই ভুলটা ব্যক্তি করলে মেনে নেয়া যায় কিন্তু রাজনৈতিক দল যখন এই ভ্রান্তির মধ্যে ঘুরপাক খায় তখন বুঝতে হবে সেটি কোন রাজনৈতিক দল নয় ৷ নিছক খিস্তি খেউড় করা একদল বেকার লোকের সম্মিলন ৷ যা সংস্কৃতিক চেতনাবিহীন বলেই অভিহিত করা যায় ৷
৭৩ সালে ডাকসুতে ভোট ডাকাতি দিয়ে শুরু হওয়া প্রক্রিয়াটি , জাতীয় নির্বাচনে বহমান থাকার ফলাফল অল্প কিছুদিন পরেই বোঝা গেল,গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশটি আর চলছেনা ৷ ৭৪ সালের মানবসৃষ্ট র্দুভিক্ষ প্রমাণ হয়ে গেল শাসকদল কত বড় মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে আছে ৷
তারপর বাকশাল সৃষ্টি আর যোগদানের গণ হিস্টরিয়া দেখে এই জাতীর,তথা দলগুলোর সংস্কৃতির মান কত নিকৃষ্ট তার প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ প্রতিবাদ ছিল , রাজপথে মিছিল ছিল, কেউ কেউ সশস্ত্র প্রতিরোধ করতেও চেয়েছেন কিন্তু ফলাফল ছিল দুঃখজনক ৷ অথচ সংস্কৃতিক মান তৈরী করার এক বিশাল দায়িত্ব ছিল সদ্য স্বাধীন দেশের নেতৃত্বের ৷ কিন্তু শাসকদলের চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক ও সংস্কৃতিহীন কার্যকলাপ সমস্ত জাতিকে গভীর খাদে ফেলে দেয় ৷
৭৫ সালে পরিবর্তন হল রক্তক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে ৷ তারপর সেই তোষামদ আর চাটুকাররা কিন্তু বহাল তবিয়তেই ছিল ৷ পোষাক বদল হলেও, মনন আর মেধার দিক দিয়ে ছিলনা কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ৷ সেই ধারাবাহিকতার সাক্ষী এখনও আমরা বহন করে চলেছি ৷
সে সময়ে নেতাদের বানী আর কার্যকলাপ শুধু পেপারে আর টিভিতে দেখা যেত ৷ তার সাক্ষী আছে পুরাতন পত্রিকা আর ভিডিও ফুটেজে ৷ কিন্তু বর্তমান দুনিয়ার, তথ্য প্রবাহের অবাধ গতির ফলে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে পাল্টে গেছে পুরো দৃশ্যপট ৷
প্রযুক্তি আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশাল দুনিয়ায় প্রত্যেকটি মানুষ এখন টিভি, পত্রিকার মালিক ৷ সে কারো জন্য অপেক্ষা করেনা ৷ নিজেই সাংবাদিক, উপস্থাপক ,মুদ্রাকর আর সম্পাদক ৷ তার মান যাই হোকনা কেন সে তার জগতের ঈশ্বর ৷
এই আমিত্ব ও অপরদিকে যুথবদ্ধ চিন্তার অভাবে সামগ্রীক নৈরাজ্যটা ক্রমেই গ্রাস করছে পুরো সমাজকে ৷ ভাই ভাইকে , নেতা কর্মীকে, কর্মকর্তা তার কর্মচারীকে চিনতে সহজ হচ্ছে এটা ঠিক ৷ কিন্তু অপরদিকে বিভেদ আর নৈরাশ্য ক্রমেই বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে সামগ্রীক রাষ্ট্র তথা সমাজ কাঠামোকে ৷ ফ্রেম দিয়ে বিভক্ত করার মানসিকতা এসেছে এই সংস্কৃতিহীনতা থেকে
পছন্দ না হলেই কথার আঘাত, কোন অতীত দৃস্কৃতিকারীদের সাথে তুলনা করা , সহযোগী বানিয়ে দেবার নোংরা মানসিকতার ফলাফল জাতি আজ দুই ধারায় বিভক্ত ৷ তৃতীয় কোন মত আর কারো থাকতে পারে, এটা বিশ্বাস করার মানসিকতা আজ লুপ্তপ্রায় ৷কোন অভিযোগ উঠলে রাষ্ট্র, দল কিংবা ব্যক্তি যেই হোকনা কেন তার জবাবদিহীতা করা নূন্যতম গণতান্ত্রিক চর্চাটা কেউ করতে চাইছেনা ৷ সবাই নিজেকে প্রকাশ করতে ব্যস্ত ফ্রেম দিয়ে অথবা কথা দিয়ে ৷
কর্মী জনগনের ভাষা নেতাকে বলেনা ৷ সে সেলফি তুলতে যায় তার নিজের প্রচারের জন্য ৷ নেতা খুশী, কর্মীও খুশী মধ্যেখানে ঢুকে যায় শাহেদ, সাবরীনা,আর হালের পাপিয়ারা ৷ নেতার বিপদ ,উদ্ধারে নেমে কর্মীরা আবার ফ্রেমবন্দী করেন নিজেকে ৷ এই চাপান উতরের নিত্য খেলায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ মাটি চাপা পড়ে ৷ রাষ্ট্রের কর্তারা এই সুযোগে হয়ে যান কর্তৃত্ববাদী শাসক ৷ উপভোগ করার সুযোগটা আমরাই করে দেই তাদের ৷
এই মানসিকতার পরিবর্তনটা জরুরী ৷ না হলে সুশাসন, মানবিক রাষ্ট্রর ধারনাটি বিশ বাঁও পানির গভীরেই থাকবে ৷ রাষ্ট্র আরো বেশী কর্তৃত্ব পরায়ন হয়ে উঠবে ৷ আমরা বিভিন্ন রংয়ের,ঢংগের, ডিজাইন, আয়তনের ফ্রেমে বিভক্ত হবো ৷ ভুলে যাব সুষ্ঠ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা ৷ ভুলে যাব বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার কথা ৷ ভুলে যাব দূর্নীতি ও শোষনমুক্ত সমাজের কথা ৷
বিভেদ ,বিভক্তি দিয়ে মেগা প্রকল্প হয়, সাথে মেগা দূর্নীতিও হয় কিন্তু প্রকৃত উন্নয়ন হয়না ৷ আর প্রকৃত উন্নয়ন না হলে সুখে শান্তিতে থাকাও যায়না, এটাই বাস্তবতা কিন্তু কাম্য নয় ৷
ইফতেখার আহমেদ বাবু
সোশাল এ্যাকটিভিষ্ট