“বঙ্গবন্ধুর নিস্প্রান জমাট বাঁধা রক্তাক্ত লাশ ৩২ নম্বর সড়কের তার বাড়ির সিঁড়িতে রেখেই মোশতাক অত্যন্ত নিপুন হাতে মাত্র ১৪ ঘন্টার মধ্যে যেন গুছিয়ে ফেললেন পুরো দেশটাকে কারফিউ দিয়ে। সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনী গুলোর সমর্থন ও আনুগত্য ও বায়তুল মোকারমে জুমার নামাজ আদায় করে পাকিস্তান পন্থীদের প্রকাশ্যে এনে এবং আওয়ামী লীগকে বজায় রেখে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত না করে মোশতাক যা করেছিলেন তা যেন আগে থেকেই তার গোপন খাতায় লেখা ছিল।“
বঙ্গভবনে মোশতাকের ৮১ দিন
লেখক -আবু আল সাঈদ , – পৃষ্ঠা ৩
নির্মোহ, নির্মম ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ পরবর্তী বাস্তব চিত্র। ৮১ দিনের ইতিহাস ৮১ পাতায় শেষ করেছেন লেখক আবু আল সাঈদ। যা লিখেছেন তা সাধারণ ভাবে গ্রহণ যোগ্য। নিরেপেক্ষ বলা চলে। ১৯৭৫ সালে আবু আল সাঈদ দৈনিক সংবাদের সিনিয়র রিপোর্টার হিসাবে কর্মরত ছিলেন । সহজ সরল বর্ণনায় একজন কর্মজীবী সাংবাদিককে কলমে উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবর্তনের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়। অতি সংক্ষিপ্ত বই। ৮১ দিনের ছোট গল্প বললে তেমন ভুল হবে না।
লেখার শুরুর দিকে লেখক নিজের রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট করছেন। ছাত্রজীবনে লেখক ছাত্রলীগ এর রাজনীতির সাথে বরিশালে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বাকশালের কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন লেখক আবু আল সাঈদ। ঘটনার বর্ণনায় খানিকটা একদেশদর্শিতা এসেছে।রাজনৈতিক পরিচয়ের স্পষ্টতা লেখাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
পথ চলতে যা দেখছেন তাই লিখেছেন সাংবাদিক আবু আল সাঈদ । তথ্য সূত্র কিংবা রেফারেন্স ব্যবহার করেনি লেখক। বিভিন্ন বক্তব্যের রেফারেন্স – তথ্য সূত্র দিলে ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য লেখা ও গবেষণার কাজে অধিকতর সুবিধা ও গ্রহণযোগ্য হতে পারত। বিতর্কিত কোন তথ্য নেই বইটিতে। প্রচলিত কথা গুলিকে সাংবাদিক হিসেবে আবু আল সাঈদ পযবেক্ষন করেছেন কাছ থেকে সাংবাদিকের দৃষ্টি নিয়ে।
জাসদ ভিন্ন অপরাপর রাজনৈতিক শক্তি মোশতাকে সর্মথন করেছিল সেই কথা এই পুস্তিকায় উঠে এসেছে। তবে এই সময়ে জাসদের উপর খোন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক নির্যাতন নিয়ে কোন আলোচনা নেই। আওয়ামী লীগ ও চীনপন্থী বামপন্থীরা যখন নানা মাত্রায় মোশতাকের সমান্তরালে পা ফেলছিলেন সেই সময়ে একমাত্র রাজনৈতিক দল জাসদ খোন্দকারমোশতাক বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছিল।
শেখ মুজিব হত্যার পর তাঁর দলের লোকদের পালিয়ে যাওয়া, কারো ভোজবাজির মতো নেতা বদল কিংবা নিস্ক্রিয়তার কারণ নিয়ে একেবারেই আলোকপাত করতে পারেননি লেখক। আবার সাধারণ জনতার মনোভাব কেন বিরূপ হলো তারও বিশ্লেষণ কিংবা ন্যূনতম ইঙ্গিত নেই লেখকের কলমে ।
সাংবাদিক আবু আল সাঈদ নিপুন হাতে আওয়ামী লীগের উপরের স্তরের নেতা, সেনা ও রক্ষীবাহিনীর ভূমিকাকে এড়িয়ে লিখছেন ৮১ দিনের শাসনকালের ইতিহাস লিখতে। মোশতাকের শাসন কালের শুরু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকান্ড দিয়ে। মুজিব হত্যায় সেনা ও রক্ষীবাহিনীর নীরবতা ও দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার বিষয় আলোচনা থেকে দূরে রেখে শাসন আমলের ইতিহাস অনেকটা রাবণকে বাদ দিয়ে প্রচলিত রামায়ণ লেখার সামিল।
সাংবাদিক আবু আল সাঈদের জবানিতে ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষের মোশতাকপন্থী চরিত্রের কথা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে জেনারেল , ওসমানী, রাজনীতিবিদ মওলানা তর্কবাগীশ, হাজী দানেশ দের মোশতাক প্রিয়তার কথা। ১৯৭৫ সালের তিন সামরিক অভ্যুথানের সাথে জেনারেল ওসমানীর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কোন আলোচনা হয় নাই। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বা প্রধান সেনাপতির পদ-পদবীর ভক্তিবাদ – গুরুবাদ জেনারেল ওসমানীর সেই সময়কার রাজনৈতিক ভূমিকার সমালোচনাকে অবদমনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে আসছে।
মওলানা ভাসানী মোশতাকের সমর্থনকারীদের কাতারেই ছিলেন। মওলানা ভাসানী মুজিব হত্যাকান্ডের পর মোশতাকের দায়িত্ব গ্রহণকে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেছিলেন টেলিগ্রাম বার্তায়।
শেষের পাতা পড়তে সামান্য হোঁচট খেতে হবে । জাসদ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এমন ভাবে লিখেছে যাতে মনে হবে লেখক ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে কোথায় এই লেখাটি প্রকাশ করেছেন। ” জাসদ কি এ মিছিল বের করেছে ক্যান্টনমেন্টের সাথে কথা না বলেই। ” জাসদের পক্ষে সেনাবাহিনীর মধ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কে ? ” ঘটনার ১৫ বছর পর লেখকের এই জাতীয় প্রশ্ন দেখে মনে হতে পারে লেখাটি ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালের ভোরে লেখা। ১৯৯২ সালে এই বই প্রকাশের অনেক আগেই লেখকের উত্থাপিত প্রশ্ন গুলি বহুল আলোচিত ও গ্রন্থিত। কিন্তু শেষ লাইনে মোশতাকের শেষ বয়সের কথা লিখেছেন। এই থেকে যায় বইটি ১৯৯০ এর পরে লেখা।
বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৯১ সাল , প্রকাশক সাগর প্রকাশনী । ১৯৯২ সালে প্রকাশিত বইয়ে এম আর আখতার মুকুলের মুখবন্ধ ছিল। দ্বিতীয় মুদ্রণ ১৯৯৫ সাল, আগামী প্রকাশনী। দ্বিতীয় মুদ্রণ থেকে এম আর আখতার মুকুলের মুখবন্ধকে বাদ দিয়ে সংকীর্ণতার ঝান্ডাকে তুলে ধরেছেন লেখক ও প্রকাশনী। খোন্দকার মোশতাকের শাসনামল নিয়ে তেমন কোন বই চোখে পরে না। সেই হিসেবে বইটি ব্যাতিক্রম।
অপু সারোয়ার