অ্যাডভোকেট আনসার খান : ইথিওপিয়ার ফেডারেল সশস্ত্র বাহিনী এবং টিগ্রয় আন্ঙলিক সেনাবাহিনীর মধ্যে টিগ্রয় অন্ঙলে সামরিক সংঘাত শুরু হওয়ার পরে প্রায় পাঁচ সপ্তাহর অধিক সময় চলে গেছে,-গেলো চার নভেম্বরে সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিলো।

সংঘাতে জড়িতদের একপক্ষে আছে,ইথিওপিয়ার ফেডারেল সরকারের সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্যদিকে রয়েছে, টিগ্রয় আঞ্চলিক সরকারের টিগ্রয় পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট(টিপিএলএফ) বাহিনী।

ইথিওপিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হলেন,আবি আহমেদ এবং টিগ্রয় আঞ্চলিক সরকারের প্রেসিডেন্ট হলেন ডেব্রিয়েশন জেব্রিমাইকেল।তিনি আবার টিপিএলএফ, চেয়ারম্যানও।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন,চলমান সংঘাত ও গৃহযুদ্ধ আরও বিস্তৃত হতে পারে এবং এর ফলে ইথিওপিয়া বিভক্ত হওয়ার আশংকা বিদ্যমান রয়েছে।

প্রশ্ন এসেছে কেন এ সংঘাত? এ সংঘাতের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।তবে,রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য স্হাপনের জন্যই এ গৃহযুদ্ধ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।

২০১৮ সালে আবি আহমেদ ক্ষমতায় আসার পূর্বে প্রায় তিন দশক রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা নিয়ণ্ত্রণ করেছিলো টিপিএলএফ। কাজেই,টিগ্রিতে কারা শাসন করতে পারবে তা নিয়ে বিরোধ নয়,দেশটার অর্থনীতিতে কারা নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে তা নিয়েই লড়াই চলছে।

ইতোপূর্বে ক্ষমতায় থাকাকালে টিপিএলএফ নেতৃতাধীন সরকার পুরানো ইথিওপীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ভেঙে দিয়ে টিপিএলএফ বাহিনীকে স্পষ্টত ইথিওপিয়া সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তরিত করেছিলো।এটা নিশ্চিত করা হয়েছিলো যে,নতুন বাহিনীতে শীর্ষ স্হানীয় জেনারেল ও অন্যান্য সামরিক নেতারাও যেন টিপিএলএফ থেকেই আসে।ফলে সামরিক শক্তির ওপরও টিপিএলএফ এর শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্টিত হয়েছিলো।

টিপিএলএফের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি অবশেষে অর্থনৈতিক আধিপত্যের জন্ম দিয়েছিলো। একারণে, তার দলের নেতারা দেশের অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত এর জমি ও বিদেশী সাহায্য ইত্যাদির ওপর সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলো।

২০১৮ সালে আবি আহমেদ ক্ষমতায় আসার কারণে উপরোক্ত সব ক্ষমতার ওপর টিপিএলএফ এর আধিপত্য হুমকির মধ্যে পড়েছিলো।ফলে টিপিএলএফ তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য যুদ্ধে জড়িয়েছে,তেমনি আবি আহমেদও তাঁর ক্ষমতা সুপ্রতিষ্টিত করতে টিপিএলএফ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন।গত অক্টোবরে ফেডারেল সরকার টিগ্রয় অঞ্চলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্বান্ত নিয়ে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ টিগ্রিকে বাজেট সহায়তা স্থগিত করার পক্ষে ভোট দেয়।

এই সেপ্টেম্বরে ইথিওপিয়া ফেডারেলের পার্লামেন্ট সহ আন্ঙলিক পার্লামেন্টের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু কোভিড-১৯ এর কারণে আবি সরকার সব নির্বাচন স্হগিত করে দেন।তা উপেক্ষা করে টিগ্রয় আঞ্চলিক পার্লামেন্টের নির্বাচন করে ফেলে আঞ্চলিক সরকার এবং টিপিএলএফ সমস্ত আসনগুলোতে জয়লাভ করে।তবে ফেডারেল সরকারের পার্লামেন্ট ওই নির্বাচন ও ফলাফল বাতিল করে দেয়।টিপিএলএফ আবির কর্মকাণ্ডকে অবৈধ আখ্যা দিয়েছিলো। আবি সরকারও টিপিএলএফ এর ভূমিকাকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অবৈধ বলে ঘোষণা করেছিলেন।তাই নির্বাচন নিয়েও আবি সরকার এবং টিপিএলএফ,এর মধ্যে বিরোধ তীব্রতা পেয়েছে বলে কোনো কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন।

অনেকে মনে করেন,এ সংঘাতের অন্যতম কারণ হলো,আদর্শিক,নৃ-গোষ্ঠীগত ও জাতিগত স্বার্থকেন্দ্রীক।দেশটার রাজনীতি-“নৃতাত্ত্বিক ফেডারেলিজম”পদ্বতিতে পরিচালিত হয়।এ ফেডারেশনের একটা কেন্দ্রীয় সরকার রয়েছে।এ ফেডারেশনের অন্যতম অংশীদার হলো টিগ্রয় নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়’-যারা ইথিওপিয়ার মোট জনসংখ্যা ১০৯.২মিলিয়নের ৭.৩ শতাংশ এবং দশটারও অধিক নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম।

টিগ্রয়ের জনগণ ইথিওপিয়ার সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি শাসনে প্রান্তিক ছিলো।তাই বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া জন্য লড়াইয়ে বহু বিদ্রোহী নৃ-গোষ্ঠীর অন্যতম হিসেবে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নেবার লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে টিগ্রয়ানরা প্রতিষ্ঠা করেছিলো-“টিগ্রয় পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট বা (টিপিএলএফ)।”এ সংগঠন সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো এবং অন্যান্য দলের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিলো ১৯৯১ সালে।তবে মূল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিলো টিপিএলএফ এর হাতেই এবং ২০১৮ সালে আবি আহমেদ ক্ষমতায় আসার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় তিন দশক ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলো টিপিএলএফ এবং টিগ্রয় আন্ঙলিক সরকারও ছিলো টিপিএলএফ এর নিয়ন্ত্রণে।এখনও টিগ্রয় আঞ্চলিক সরকার পরিচালনা করছে এ সংগঠন।

আবি আহমেদের ক্ষমতায় আসার পূর্বের তিন দশক টিপিএলএফ পরিচালিত জোট সরকারের মূল অংশীদার ছিলো এবং পাশাপাশি টাইগ্রয়ও শাসন করছিলো।কারণ টিপিএলএফ কেবল শাসনে,রাজনীতিতে নয়,দেশের অর্থনীতি,সামাজিক,সাংস্কৃতিক,ধর্মীয় এবং সামরিক ব্যবস্হায়ও একাধিপত্য স্হাপন করেছিলো।

আবি আহমেদ ক্ষমতায় আসার পরে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।তিনি তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,সামরিক ও সামাজিক সংস্কার নিশ্চিত করার জন্য আবি কয়েকটা জাতিগত দলকে নিয়ে “সমৃদ্ধি পার্টি” গঠন করেন এবং টিপিএলএফ-কেও তাঁর সাথে যোগদানের আহবান জানান।কিন্তু টিপিএলএফ সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

আবি আহমেদের সাথে টিপিএলএফ এর তীব্র মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছিলো নির্বাচন বাতিল করা,সমৃদ্ধি পার্টি(পিপি)গঠন,যা দেশকে বিভক্ত করবে বলে মনে করে টিপিএলএফ, আবির সংস্কার প্রচেষ্টা,ইরিত্রিয়ার সাথে ২০১৮ সালে আবির সরকারের সীমান্ত সমস্যা দূরীকরণের জন্য চুক্তি, যা ইথিওপিয়ার স্বার্থের পরিপন্হী মনে করে টিপিএলএফ,সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সংস্কারের নামে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা দপ্তর থেকে টিপিএলএফ সদস্যদের অপসারণ করা।এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আর্মি চীফ ও গোয়েন্দা প্রধানগণকে অপসারণ।

প্রধানমন্ত্রী আবি জাতিগত গোষ্ঠীর আরও সুষম প্রতিনিধিত্ব আনয়নের লক্ষ্যে সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীতে সংস্কারের কাজ শুরু করবেন বলে ঘোষণা করেন।তাঁর এ উদ্যোগের বাস্তবায়ন টিপিএলএফ এর দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সামরিক আধিপত্যকে পুরোপুরিভাবে হুমকির মধ্যে ফেলেছে, টিগ্রয়ে অঞ্চলে এর প্রভাবের ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করবে বলে মনে করেন টিপিএলএফ নেতারা।

এছাড়া, টাইগ্রিয়রা মনে করে,আবির সংস্কার প্রচেষ্টা বর্তমান ফেডারেল ব্যবস্হা ধ্বংস করে এর স্হলে ইউনিটারিয়াল সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অংশমাত্র,যা টিপিএলএফ মেনে নিতে পারে না।

এসব কারণে, প্রধানমন্ত্রী আবি বিশ্বাস করেন যে,টিপিএলএফ তাঁর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং প্রধানমন্ত্রীর সংস্কার প্রচেষ্টা নষ্ট করার অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়েছে টিপিএলএফ। অন্যদিকে,টিপিএলএফ মনে করছে,প্রধানমন্ত্রী আবিরের সংস্কার প্রচেষ্টা টিপিএলএফ এর প্রভাব ও আধিপত্য খর্ব করার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে।

এভাবেই টিপিএলএফ ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বিরোধ তিক্ততা ও শত্রুতায় পর্যবসিত হয় এবং জনগণের মধ্যেও এর প্রভাব পড়ে।জনগণের মধ্যেও বিভাজন এবং শত্রুতা ছড়িয়ে পড়ে।

প্রধানমন্ত্রী আবি টিপিএলএফ বাহিনীকে দমন করার জন্য তাঁর সরকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেন এবং টিপিএলএফ বাহিনীও সরকারী বাহিনীকে প্রতিরোধ করার প্রত্যয় করে।টাইগ্রয়ের নেতা ডিব্রেটসিয়ন বলেন যে,তাঁর বাহিনী তাঁর জনগণ ও টাইগ্রয় অঞ্চলকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করবে।”আমরা যুদ্ধজয়ের জন্য প্রস্তুত-” বলেন তিনি।উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি জবাব এবং চ্যালেঞ্জ অবশেষে গৃহযুদ্ধ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে ইথিওপিয়া ও টিগ্রয় অঞ্চলে।

এ গৃহযুদ্ধের শেষ পরিণতি কী হতে পারে? এর উত্তর,- যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের ওপর নির্ভর করছে। যুদ্ধে টিপিএলএফ বিজয়ী হলে ইথিওপিয়া বিভক্ত হয়ে টিগ্রয় অঞ্চল আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading