আজ ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান দিবস। ১৯৯০ সালের এ দিনে আট বছর আট মাস ১২ দিন ক্ষমতায় থাকার পর সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বে পরিচালিত গণআন্দোলনে সামরিক স্বৈরাচার লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা দখল করেই এরশাদ সংবিধান স্থগিত ঘোষণা করে, সামরিক ফরমানবলে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং সারা দেশে সামরিক আইন জারি করেন। এরশাদ ক্ষমতা দখলকালে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হন। একই বছর ১৫ নভেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দেশে সে সময় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর থেকেই শুরু হয় আন্দোলন। বিশেষত, মজিদ খানের শিক্ষানীতি নিয়ে গড়ে ওঠে সে ছাত্রআন্দোলন। সামরিক শাসন উপেক্ষা করে ১৯৮৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে একটি ছাত্রমিছিল শিক্ষা ভবন অভিমুখে যাত্রা করে। ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী গুলি চালায়। গুলিতে শহীদ হন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালি সাহা সহ অনেকে। এরপর আরও দানা বাঁধে আন্দোলন। রাজনৈতিক দলগুলোও গড়ে তোলে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের জোট। আওয়ামী লীগ, জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ সমমনা দলগুলো নিয়ে গড়ে ওঠে ১৫-দলীয় জোট। এর পাশাপাশি বিএনপি ও সমমনা (জামায়াত ব্যতীত) দলগুলো নিয়ে গড়ে ওঠে ৭-দলীয় ঐক্যজোট। শুরু হয় যুগপৎ আন্দোলন। সামরিক শাসনবিরোধী লাগাতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালে এরশাদ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করেন। নির্বাচনে অংশ নেওয়া-না নেওয়ার প্রশ্নে ১৫ দল ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগ, সিপিবিসহ আট দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং জাসদ-বাসদসহ অন্যরা নির্বাচন বর্জন করে। একই সঙ্গে ৭-দলীয় জোটও নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগ পায় ৭৬ আসন, জামায়াতে ইসলামী ১০ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পান ৩২ আসন।
নির্বাচনে সীমাহীন অনিয়ম, কেন্দ্র দখল, ভোট ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ফলে গোটা নির্বাচনব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এর ফলে এরশাদ যে উদ্দেশ্যে নির্বাচন করেছিলেন, তা সফল হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো আবারও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাজনৈতিক মাঠে তখন ৮ দল, ৭ দল ও ৫-দলীয় ঐক্যজোট। এর বাইরে জামায়াতে ইসলামী আন্দোলনে থাকার চেষ্টা করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা রাখেনি। আন্দোলনকে এককেন্দ্রিক করতে গড়ে ওঠে তিন জোটের লিয়াজোঁ কমিটি। লিয়াজোঁ কমিটিতে আন্দোলনের কর্মসূচি চূড়ান্ত হলে তা ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দল থেকে ঘোষণা করা হতো। ধারাবাহিক আন্দোলনে ক্রমেই তা তীব্রতর হয়ে ওঠে। জনগণও গণতন্ত্রের আশায় বিরোধী দলকে সমর্থন দিতে থাকে। এ পর্যায়ে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ দিন নূর হোসেন শহীদ হন। শুরু হয় লাগাতার হরতাল। এরশাদও মরিয়া হয়ে ওঠেন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। আন্দোলনকারীদের দমনে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেন তিনি। লাগাতার আন্দোলনের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের সংসদ সদস্য পদত্যাগ করলে সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়ে। তখন আবারও সংসদ ভেঙে দিয়ে এরশাদ ১৯৮৮ সালের ৮ জানুয়ারি নির্বাচন ঘোষণা করেন। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দল নির্বাচন বর্জন করে। ৭৩ দল নিয়ে কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি বা ‘কপ’ গঠন করেন এরশাদের সে সময়ের দোসর জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রব। আ স ম রব এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু জনগণ সম্মিলিতভাবে এ নির্বাচন বর্জন করে। ফলে নির্বাচনে শতকরা তিন ভাগ ভোটারও ভোট দেননি। অনেক কেন্দ্রে কোনো ভোটার যাননি। ফলে এ নির্বাচনও আর গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। লাগাতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির ব্যতীত সব ছাত্রসংগঠন এক মঞ্চে দাঁড়ায়। গড়ে ওঠে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য গঠনের পর আন্দোলন প্রচণ্ড তীব্রতা পায়। এ সময় এরশাদের পদত্যাগ বিষয়ে তিন জোটের লিয়াজোঁ কমিটি একটি রূপরেখাও প্রণয়ন করে। সে রূপরেখা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। উত্তাল আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যায় ৯০-এর ডিসেম্বরে, আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন এবং তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯০-এর ৪ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ যখন পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন, তখন সারা দেশে রাস্তায় রাস্তায় নেমে আসে লাখো মানুষের ঢল। ১৯৯১-এর ফেব্রুয়ারিতে সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়। এ সরকার ১৯৯১-এর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন করে। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতায় পতিত স্বৈরশাসক ও তার দল পুনর্গঠিত হয় এবং এরশাদের মৃত্যু পর্যন্ত বহাল তবিয়তে রাজনীতি করছে যা গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এক নেতিবাচক দৃষ্টান্ত। শুধু তাই নয় স্বৈরাচারী একনায়ক এরশাদের মৃত্যুর পর তাকে সফল রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে উল্লেখ করে জাতীয় সংসদে আনা শোকপ্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
এরশাদ সরকার পতনের পরও তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতার কাছা কাছি অবস্থান করে, গণতন্ত্রের জন্য এরশাদকে ব্যবহার করা হয়, তখন কি আমাদের বিবেক একবারো বলে না আমাদের দেউলিয়াত্ব আজ কোথায়? স্বপ্ন ছিল দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করবে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। গণতন্ত্র সুদৃঢ় ভিত্তি পাবে। আজো সে আশা পূর্ণ হয় নাই। তাই আজকের দিনে স্বৈরশাসকের শাসনামলে সকল শহীদের কাছে বিনম্রচিত্তে ক্ষমা চাই ।
কাজী সালমা সুলতানা , লেখক এবং গণমাধ্যম কর্মী ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading