অ্যাডভোকেট আনসার খান : বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে আলোচিত, নন্দিত,বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা হিসেবে প্রশংসিত জাতীয় নেতা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনবিদ ড.কামাল হোসেন, আমাদের জাতির একজন গর্বিত সন্তান।
ড.কামাল হোসেন বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী। তাঁকে নিয়ে বহুমূখি আলোচনার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। তিনি একজন সফল ও কৃতি ছাত্র ছিলেন।বিশ্বের সেরাসব উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিনি শিক্ষার্থী ছিলেন।বিশ্ববিদ্যালয়ে করেছেন অধ্যাপনা।দেশে এবং বিদেশের আইন অঙ্গনে সফল ও জগৎ বিখ্যাত আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অন্যতম একজন আইনজ্ঞ হলেন ড.কামাল হোসেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর সফল পদচারণা অস্বীকার করার কোনো সূযোগ নেই।বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত ও একান্ত আস্হাভাজন ব্যক্তিত্ব ড.কামাল হোসেনের ওপরই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন জাতিরজনক।তখন ড.কামালের বয়স ছিলো মাত্র ৩৫ বছর।
মাত্র নয় মাসে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সংবিধানগুলোর মধ্যে অন্যতম গণতান্ত্রিক একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন ড.কামাল হোসেন। সেকারণে, বাংলাদেশের গণমানুষ বাঙালির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হিসেবে ড.কামালের মুসাবিদায় প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধান হুবহুভাবে পূনস্হাপনের জন্য দাবি করে আসছেন।
একটি নবস্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের সংবিধান প্রণয়নে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা যে, কতটুকু গৌরবের, একজন রাজনীতিকের জীবনের জন্য কতটুকু সাফল্যের চিহ্ন বহন করে তা কী ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অবকাশ রাখে।
এটি বলতেই হয় যে,একটি পরাধীন জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেবার কৃতিত্ব যেমন সকল রাজনীতিকের ভাগ্যে জোটে না,তেমনি একটি নবস্বাধীনতা প্রাপ্ত জাতিকে একটি সর্বোত্তম সংবিধান উপহার দেবার সৌভাগ্যও সকল রাজনীতিকের ভাগ্যে জোটে না।
বঙ্গবন্ধু যেমন তাঁর সমকালীন রাজনীতিকদের টপকে গিয়ে পরাধীন বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেবার বিরল সৌভাগ্য ও গৌরব অর্জন করে জাতির ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন,ঠিক তেমনি নবস্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জন্য বিশ্বের অন্যতম সর্বোত্তম গণতান্ত্রিক একটি সংবিধান প্রণয়নে নেতৃত্ব দিয়ে ড.কামাল হোসেন বাঙালির ইতিহাসে স্হান করে নিয়েছেন,যা অমোচনীয় হয়ে জ্বলজ্বল করবে।এটিই হলো ড.কামাল হোসেনের রাজনৈতিক জীবনের বড় সফলতা এবং জাতিসংঘের সদর দপ্তরে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী হিসেবেও একজন সফল রাজনীতিকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন তিনি।তবে,যারা অন্ধ ও জ্ঞানপাপী, তারাই কেবল রাজনীতির ইতিহাসে ড.কামালের কোনো সফলতা দেখতে পান না।
রাজনীতিতে মন্ত্রী হওয়া যদি হয় সফলতার মাপকাঠি, সেক্ষেত্রেও ড.কামাল সফল।তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভায় সফল ও দক্ষ আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জ্বালানীমন্ত্রী ছিলেন।পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি জাতিসংঘসহ বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য।তাঁর প্রাজ্ঞ কূটনৈতিক দক্ষতা দ্বারা অল্পদিনের মধ্যেই বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ এনে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সত্যকথনে বলতে হয়,ড.কামাল হোসেনের জীবনটাই হলো একটি ইতিহাস এবং সে ইতিহাস হলো একজন সফল মানুষের সফল জীবনের গৌরবগাঁথার ইতিহাস।
প্রবীণ রাজনীতিক ড.কামাল কখনো ক্ষমতার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে বা অন্য কোনো প্রকারের লোভের বশে নিজের আজীবনের বিশ্বাস,আদর্শ ও নীতি বিসর্জন দেননি। আজীবন উদারনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এই মানুষটি যৌবনের প্রারম্ভে সকল প্রকার ভয়ভীতি ও আরাম আয়েশের অপার সম্ভাবনা পায়ে ঠেলে দিযে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার লক্ষ্যে,বাঙালি জনগণের মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নেবার জন্য বঙ্গবন্ধুর আহবানে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন।তাঁর মেধা, যোগ্যতা এবং প্রশ্নাতীত দেশপ্রেম ও সততায় অভিভূত বঙ্গবন্ধু ড.কামালকে তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত সহকর্মীদের মধ্যে স্হান দিয়েছিলেন।ড.কামাল হয়ে ওঠেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর,যেকারণে, ১৯৭১ সালের গভীর রাজনৈতিক সংকটের দিনগুলোতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে সংকট নিরসনের আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর সাথে সবচেয়ে কম বয়সী একজন উপদেষ্টা আলোচক ছিলেন ড.কামাল।মূলত:তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একজন ছায়াসঙ্গী।
পেশাগত জীবনে ড.কামাল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনামধন্য।জ্বালানী খাতের আইনজীবী হিসেবে আন্তর্জাতিক ভাবে তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেছেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে, একজন আইন বিশারদ হিসেবে বিশ্বের অনেক দেশের নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও নতুন আইন তৈরি করে দিয়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি।
১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল সময়কালের মধ্যে ড.কামাল হোসেন সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার সুইডেন,ডেনমার্ক, চীন,মোজাম্বিক, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইন্সের টেলিযোগাযোগ ও জ্বালানী তেল সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন প্রণয়নে ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মধ্যেকার সাগর ভরাট মামলায় তিনি ছিলেন সালিশ সমঝোতাকারী।গায়েনা বনাম সুরিনাম সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত মামলায় তিনি ছিলেন অন্যতম বিচারক।
জাতিসংঘের রাপোর্টিয়ার জেনারেল হিসেবে আফগানিস্তানের সংকট সমাধান ও সংবিধান প্রণয়ন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও নতুন সংবিধান প্রণয়নে দায়িত্ব পালন করেছেন ড.কামাল।
বাংলাদেশে অদ্যাবধি তিনি উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে গণতন্ত্র রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে চলেছেন।দুঃশাসন, রুগ্ন রাজনীতি,কালো টাকা,সন্ত্রাস, মিথ্যাচার আর চাটুকারিতার বিরুদ্ধে কথা বলে চলেছেন তিনি।এসব কারণে,তিনি জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।