সহজভাবে বললে সোজা বা সিধা  পথ । এই সহজ বা সিধা  পথটিই আমাদের দেশের সকল সমস্যার মূলে । দেশে আইন আছে সকল ক্ষেত্রেই কিন্তু আইনের বরখেলাপ তারচেয়েও বেশি । ফলে সোজা পথটি আর সোজা থাকে না, হয়ে উঠে বক্রপথ। সাধারণভাবেই বক্রপথে চলাটা হয়ে উঠে ক্রমশই বিপজ্জনক ও ভয়নক ।

এই স্বাধীন দেশের ইতিহাস বলে প্রথম ক্রস ফায়ার হয়েছিলেন সিরাজ সিকদার। অতঃপর ধীরে ধীরে আজকের অবস্থান । গুম- খুন নিয়মিতই বেড়ে গিয়ে এখন চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এক সময়ে রক্ষীবাহিনীর দ্বারা এই স্বাধীন দেশেই হাজারে হাজারে আপামর জনগণকে অত্যাচার- নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিলো, সাথে দিতে হয়েছিলো প্রাণ । অত্যাচার- নির্যাতন সেই যে শুরু থামার কোনো নামগন্ধ নাই । সেই সময়ে জাসদ নামক দলটির এক চরম ভুল সিদ্ধান্তের কারনে  গণবাহীনি নামক সংগঠনটির কার্যক্রমেও ছিলো হত্যা- খুন ইত্যাদি।  ফলাফল হাজারো তরুণ- যুবকের লাশ ! তরুণ- যুবকদের রক্তের জন্য দায়ী নেতাগণেরা আজও বহাল তবিয়তেই আছেন, আজও তাদের মুখেই এই দেশকে সোনা- মোহর দিয়ে মুড়িয়ে দেবার বাক্যবাণ শুনি, অথচ একটিবারের জন্য সেই সব তরুণ- যুবকদের কথা মুখে আনেন না । তাদের ভাবলেশহীন অবস্থানে মনে হয় যেন, সেগুলো সবই স্বাভাবিক ছিলো বা নিয়তি !

দিন- কাল অনেক গড়িয়ে দেশকে রক্ষার দায়িত্বের ভার নিজ দায়িত্বেই নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে কাঁধে তুলে নিলেন স্বৈরাচারী এরশাদ।  আহ্হা কি আনন্দ আকাশে- বাতাসে । উনিও দেশকে সোনা- রুপায় মুড়িয়ে দেবার পণ করে শুরু করলেন হত্যাযজ্ঞ। সেই প্রতিজ্ঞায় ছাত্রদের উপর ট্রাক উঠিয়ে দিতেও কার্পণ্য করলেন না । এই স্বৈরাচারের হাতেও তরুণ- যুবকদের রক্তের ছাপটি ভালোই ফুঁটে উঠলো। তারপরে কত কেচ্ছা কাহিনী, কাঁটিয়ে দিলেন সাড়ে নয় বছর ক্ষমতার  মসনদে । অতঃপর যা হবার তাই হলো। জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে যখন পীঠ দেয়ালে, টানাহ্যাঁচড়া করে ক্ষমতার গদি থেকে নামালো ঠিকই।  কাজের কাজ কিছুই হলো না ।

এখানেই সেই সিরাতুল মুস্তাকিনের প্রশ্ন।  এরশাদকে  হঠানোর পরে দেশের মানুষ এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি ঠান্ডা বাতাসের প্রবাহ এলো বটে । এবার বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে । কেননা অনেকতো হলো, স্বাধীন দেশে আর কত ? অনেক জল গড়িয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রায় সবাই এখানে একসাথেই আছে, প্রতিজ্ঞাবদ্ধও মনে হলো   সুতরাং এখান থেকেই হয়তো নতুন করে শুরু হবে । না, বাঙালির আশায় গুড়ে বালি  ।

যে যত কথাই বলুক, সেই সময়ের নতুন উৎপত্তি তথাকথিত তত্বাবধোক সরকারে সাবেক বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে যে নির্বাচনটি হলো, সেটাই ছিলো এই স্বাধীন দেশের একমাত্র কম সমালোচিত সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।  আমরাও পেলাম একটি সঠিক নির্বাচিত সরকার। দেশ এবার নিশ্চয়ই নতুন করে শুরু করবে। এই বঙ্গভূমির ভাগ্যেটাই খারাপ। আসলে ভাগ্য নয়, ক্ষমতাটাই খারাপ। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের প্রথম চাওয়াটাই ক্ষমতা । বেশ ক্ষমতা চাই । এরশাদ গ্রেফতার , সরকারী- বিরোধী দল সংসদে, সবই চললো । শুরু হলো নতুন করে কাহিনী।  বিরোধী দলের সরাসরি ঘোষণা, একদিনের জন্যও ক্ষমতায় শান্তিতে থাকতে দেবো না । যেমন বলা তেমন কাজ । অতঃপর আবার ক্ষমতার পালাবদল ।

এবার জনগণ বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচার পথ খুঁজতে থাকলো । যেহেতু স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারি দল নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায়, সুতরাং এবার নিশ্চয়ই হবে। বাংলায় বলে যে লাউ সেই কদু । কাজের কাজ কাঁচকলা পেলো বাঙালি।  দেশ জুড়ে নতুন এক উৎপাত শুরু হলো গডফাদার নামক তথাকথিত বড় বড় গুন্ডাদের । সমগ্র দেশ জুড়েই তখন গডফাদারদের সে কি বাহার। উনারাই দেশের হর্তাকর্তা, উনাদের হুকুমতই সর্বে সর্বা। মানুষ আবার অতিষ্ঠ, ত্যক্ত, বিরক্ত।  মাঝে আবার উড়ে এসে জুড়ে বসলো মারোয়াড়ি গোষ্ঠী।  সাধারণ জনগণকে ফুতুর করে শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে চম্পট। জনগণের সহ্যের সীমা ছাড়া।  নতুন কাউকে চাই ।

ঘুরেফিরে আবার সেই তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলোয় ঝাঁপ।  এবার নতুন আঙ্গিকের সরকার। একেবারে স্বাধীনতা বিরোধীদের বগলতলায় করে নিয়ে এসে ক্ষমতার চেয়ারে ! বীর বাঙালি এবার রাজাকার/ আলবদরদের বত্রিশ দাঁতের অট্টহাসির ক্ষমতার সাধ পেলো । দেশ জুড়ে কোথাও নেই শান্তি।  চারিদিকেই গুন্ডামি আর ভণ্ডামি।  সরকার নিজেও বেশ বেকায়দায় পরে কঠিনহস্তে দমনের সিদ্ধান্তে দেশজুড়ে শুরু হলো সরাসরি হত্যা, অপারেশন ক্লিনহার্ট । যদিও সরকারী দলের বেশিরভাগের ভাগ্যেই খারাপ ছিলো । কতগুলো কমিশনার নামের বড় বড় গুন্ডাদের ভাগ্য মিললো হার্ট অ্যাটাকের কল্পকাহিনী।  দেশে নতুন করে গুম- খুন সরকারীভাবে শুরু। আইনকে তার সোজা পথে চালাতে অক্ষম সরকার পা বাড়ালো হত্যার দিকে । জনমানুষেরা বুঝুক আর না বুঝুক, এতদিনের অতিষ্ঠতায় সেই সরকারী হত্যাকে বেশ সাদরেই গ্রহণ করে বসে । আইন বহির্ভূত হত্যা কখনোই একটি দেশের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না, সরকার বাহাদুরও কিছুদিন যেতেই টের পায়। নিজেদের রক্ষাকবচ হিসেবে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, পবিত্র সংসদে বসে, এই সকল আইন বহির্ভূত হত্যাকে জায়েজ  করাতে, ইনডেমনিটি দিতে বাধ্য হলো । প্রকাশ হলো সরকারের দূর্বলতা।  লাভের গুর পিঁপড়ের ভাগ্যে।

এবার সুযোগ বুঝে দেশপ্রেমিক সেনা বাহিনী আর বসে থাকবে কেন ! রাজনৈতিক নেতারা যখন সেই এরশাদ পতনের পরেও শুদ্ধ হতে পারেনি, তাহলে এবার রাজনৈতিক নেতাদের বারো হাত দেখাও । শুরু হলো দেশ নাটকের ভিন্ন পর্ব । একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মানীতদের জেলে পুরে । সাথে বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের এমন ঘোলা জলে চুবানো, নাকানিচোবানি, যারপর নেই । একে একে নেতাদের মুখ থেকে কি কি সব সত্য কথা বাজারে আসা শুরু । পাবলিক সেগুলো দেখে খুশি হয় আর মনে মনে সেনা বাহিনীর প্রতিই সমর্থন দিতে থাকে । পাবলিকের দোষ দিয়েও লাভ নেই । সব কিছুর জন্য যে রাজনীতিকরাই শতভাগ দায়ী ।  জনগণের সাপোর্ট যেহেতু সাথে আছে, সেনাদের আর থামায় কে ? তত্ত্বাবধায়কের বেড়াজালে নতুন করে সেনা শাসিত তত্বাবধোক সরকার জনগণ নতুন করে উপহার পেলো। কাজের কাজ কিছুই হলো না, কিছু রাজনৈতিক নেতাদের হয়রানি  ছাড়া । এই দেশের জনগণ আর যাই মানুক, সেনাদের অল্প কিছুদিনের জন্য মাথায় তুলে রাখলেও, বেশিদিন ক্ষমতায় দেখতে নারাজ। এই উপলব্ধিটি সেনারা মোটেও বুঝলো না । শেষ অব্দি যেতে হলো বটে, তবে একেবারেই দেশান্তর হয়েই ।

নির্বাচন হলো, সেনারা দেশান্তরী হলো । জনগণ আবার পেলো স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারি সরকারকে । শুরু হলো নতুন পর্ব । প্রথম পর্যায়ে সব কিছুই ঠিকঠাক মনে হলেও, সেনাদের নিরাপদ প্রস্থানে উঠলো প্রশ্ন। কেননা নির্বচিত সরকারের অতীত প্রতিশ্রুতি সামনে চলে এলো। যেহেতু অতীত প্রতিশ্রুতির কল্যাণেই সেনাদের নিরাপদ প্রস্থান, সুতরাং  সন্দিহান হবার শত কারণ রয়েই যায়। বিরোধী দলতো আর কম যাবে না । ক্ষমতা বলে কথা । ক্ষমতাই নেতাদের একমাত্র আদর্শ  ( সকল রাজনৈতিক দলের )।

এদিকে আবার ঘুরেফিরে নির্বাচনের আরেক ধাপ চলে এলো । মাঝে আবার কি কি কাহিনী করে জনগণের শেয়ারবাজারের শতভাগ ধ্বস নামিয়ে সব লুটেরাদের সিন্দুকে । দেশজুড়ে আবার শুরু একে একে গুম- খুন । প্রতিদিন এক কাহিনী ঢাকতে নতুন কাহিনীর উৎপত্তি।  এমন কোনো দিন নাই, নতুন কাহিনী দেশের জনগণের ভাগ্যে মিলেনি । সরকার এবার আলোচনার নামে টালবাহানা করে, সকলের মতামতকে এক ঝাঁটায় উপেক্ষা করে তথাকথিত তত্বাবধোক সরকারকে এক কোঁপে কাতেল বানিয়ে, নির্বাচনে।  বিরোধী দল কি আর মানার পাত্র! দেশে এলো নতুন করে পেট্রল বোমার ঝলকানি।  নির্বাচন বয়কট। শত শত মানুষের লাশ । সরকারও অনড় । এই প্রথম স্বাধীন দেশে বিনা ভোটের সরকার।  তাও আবার পাশের দেশের সরাসরি হস্তক্ষেপে । জনগণ এবার স্বাধীন দেশের সংজ্ঞা নতুন করে শিখলো । কিন্তু করার কিছুই থাকলো না ।

গুম- খুন আরো বেড়ে দ্বিগুণ হলো । সাথে এলো নতুন ঝড়, সমান তালে দুর্নীতি । পূর্বের সরকারের খাম্বা মার্কা বা হাওয়া ভবন দূর্ণীতি সব কিছুই একেবারেই মলিন হয়ে গেলো । সাথে এলো পূর্বের গডফাদারদের পরিবর্তে সরকারী গডফাদারদের দৌড়াত্ব। এবার জনগণের মাথা ব্যথার সাথে রাজনৈতিক বিরোধী দলের মাথা ব্যথা, সাথে নাড়িভুঁড়ির ব্যথারও শুরু । মাঝে আবার নির্বাচনে নতুনত্ব ! বিনা ভোটের অধিকার ছেড়ে এবার নৈশভোটের আগমন। যাই ঘটুক, বর্তমানে দেশে সংসদ আছে, বিরোধী দলও সংসদে  আছে, দেশও চলছে !

সো, উপরে সংক্ষেপে কিছুটা ইতিহাস স্মরণ করার কারণে বলাই যায় কোনো কিছুরই পরিবর্তন হয়নি । নির্বাচিত (!) সরকার দেশে বহাল আছে। গুম- খুন বহাল আছে । দুর্নীতিও বহাল আছে । সরকারও চলছে ! আমরা যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি । যুদ্ধ জয়ী স্বাধীন দেশ চলছে।  তবে সমস্যা সেই একটাই । সিরাতুল মুস্তাকিন, সোজা  পথে আজকেও দেশ এলো না । সুতরাং যা হবার তাই হচ্ছে এবং আরো দীর্ঘদিন এভাবেই চলবে বললেও তেমন বড় কোনো ভুল বলা হবে না নিশ্চয়ই।

20190210_195317

বুলবুল তালুকদার 

যুগ্ম সম্পাদক শুদ্ধস্বর ডটকম

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading