ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া নিবন্ধঃ মানুষের সাহিত্য সাহিত্যের মানুষ

ট্র্যজেডির লেখকরা মানুষের এই যন্ত্রণার সঙ্গে  আমাদের যুক্ত করেন পরম  মুন্সিয়ানায়। তাঁদের নায়কেরা ক্রমাগত নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েলেও   তারা  নিঃসঙ্গ হতে চায় না। শেকস্পীয়রের ট্র্যাজিক নাটক  ‘হ্যামলেট’-এ দুঃসহ যন্ত্রণায় নায়ক  আত্মহত্যা করবার কথা ভাবে।  কিন্তু তার আত্মসচেতনতা তাকে নিবৃত্ত করেঅবশেষে লেয়ার্তেস  বিষ মিশ্রিত তলোয়ারের আঘাতে  হ্যামলেটের  মৃত্যু ঘটে।  তার একমাত্র প্রিয় বন্ধু হোরেশিও  হ্যামলেটের  অবর্তমানে বেঁচে থাকা নিতান্ত অর্থহীন  মনে করে।  গারট্রুডের বিষাক্ত  পানপাত্রের অবশিষ্টাংশ পান করে  হোরেশিও    উদ্যত হয় বন্ধুর অনুগামী হতে। হ্যামলেট তাকে নিবৃত্ত করে  এই বলে  যে, তার বেঁচে থাকা দরকার; বেঁচে থাকলে সে হ্যামলেটের কাহিনী অন্যদেরকে জানাতে পারবে। মৃত্যুর পরও হ্যামলেট বেঁচে থাকতে চায় জীবিত মানুষের সঙ্গে যুক্ত  থাকবার মধ্য দিয়ে — Things standing thus unknown, shall live behind me!/ If thou didst ever hold me in thy heart/ Absent thee from felicity awhile/And in this harsh world draw thy breath in pain/To tell my story.”

 

ইংরেজ  রোমান্টিক কবি  স্যামুয়েল  টেইলর কোলরিজ তাঁর ‘দ্য রাইম অব দি এন্সিয়েন্ট  ম্যারিনার’  শিরোনামের  অতিপ্রাকৃত  কবিতায় এমন একজন প্রাচীন  নাবিকের পাপের দুঃসহ দহন-কাতরতাকে চিত্রিত করেছেন  যে-কিনা  অকারণে প্রকৃতির ‘পবিত্র আত্মা’ একটা এলবাট্রস পাখিকে হত্যা করে।  এই  পাপের ফলে  বায়ু  প্রবাহ থেমে  যায়,  পাল পড়ে যায় ,  দিনের পর দিন  জাহাজ  আটকে  থাকে  সাগরে–অনড়, নিশ্চল।  চারিদিকে  পানি আর পানি। কিন্তু পানযোগ্য এক কাতরা জল নেই  জলের  সমুদ্রে।  এ যেন  ‘আমি জলের উপরে বাস  করি,  তবু তৃষায় শুকায়ে  মরি।’  মৃত  এলবাট্রসকে ঝুলিয়ে দেয়া হলো  প্রাচীন  নাবিকের গলায়।  একে একে সকল সহনাবিকের ঘটে অকাল মরণ।  পচে-গলে ডেকে পড়ে থাকে  নাবিকদের মরদেহ।  সামুদ্রিক ঝড়- ঝঞ্ঝায় লণ্ডভণ্ড তার জাহাজ। প্রাণ ওষ্ঠাগত।  কেবল তার পাপের  কারণে আরো কঠিন শাস্তিভোগের জন্য প্রাচীন  নাবিক বেঁচে থাকে একাকী নির্জন বিশাল সমুদ্রে। যেহেতু সে স্রষ্টার সৃষ্টিকে হত্যা করে স্রষ্টার প্রতিও অবমাননা করেছে, তাই সে স্রষ্টা ও তার সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েতখন হতাশ নিঃসঙ্গ মেরিনার বলে,“Alone, alone, all, all alone,/Alone on a wide wide sea!/And never a saint took pity on/My soul in agony.”  সব  যন্ত্রণার প্রাথমিক অবসান  ঘটে  তখন  যখন দৃশ্যপটে  আবির্ভূত  এক  পুণ্যাত্মা  সাধুর কাছে সে তার দুঃসহ দহনের  কাহিনী বর্ণনা করে।  বৃদ্ধ নাবিক তার নিজের দেশে ফিরে আসে এবং সে  পবিত্র সাধুর কাছে তার অপরাধ স্বীকার করে তার অন্তরের অনুশোচনা থেকে মুক্তি চায়। তখন সেই সাধক তাকে তার এই ঘটনা প্রত্যেক জীবিত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বলে। যখনই বৃদ্ধ নাবিক  নিজের অনুশোচনায় কষ্ট পেতে থাকে তখনই   জীবহত্যার  পাপ,  অন্তর্দহন,  প্রায়শ্চিত্ত এবং  পাপমুক্তির  সেই কাহিনী  কোন ব্যক্তিকে  শোনায়। তাতেই তার বুকে  জমাট বাঁধা  কষ্ট লাঘব হয়,  বিকারগ্রস্ততা  দূর  হয়। এই  প্রক্রিয়ায়  কোলরিজ অতিপ্রাকৃতকে প্রাকৃত রূপায়নে কবিতার মানুষকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত করেছেন সুনিপুণ কাব্যিক  দক্ষতায়।  

 

 ইতালীয় ইহুদি চিত্রশিল্পী এমেডিও মোদিগলিয়ানি  তার  আলোড়ন সৃষ্টিকারী চিত্রকর্মের মডেল হিসেবে বেছে নিতেন নামপরিচয়হীন লোকদের, রাস্তার ছেলেমেয়ে, উদ্বাস্তু, গৃহকর্মী, ক্ষুদ্র কৃষক আর তরুণ শিক্ষানবিসদের। তুলির মমতার আঁচড়ে তিনি তাদের মূর্তমান করেছেন গভীর ঐকান্তিকতায়। তাদের রূপায়িত করেছেন  তাদের গোবেচারা চেহারার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা লাবন্য  ও  মহত্ত্বকে। ঔপন্যাসিক তার সাহিত্যকর্মের অভিযাত্রায় বাস্তবতার কোনো বিকৃতি না ঘটিয়েই এর গভীর তলদেশ থেকে মূলত: তুলে আনেন সেই প্রকৃত বাস্তবকেই অবলোহিত  শক্তিবলে তিনি তাদের বাহ্যিক চেহারার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা লালিত্যকে বের করে আনেন  অন্তর্দৃষ্টিমান কিংবা দৃকশক্তিমান স্বপ্নদর্শীর মতো সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে।

 

 যাঁদের লেখায় মানবিকতা আহুত, জাগ্রত আদৃত হয়েছে তাদের অন্যতম পথিকৃৎ এডগার অ্যালেন পো। তাঁর ‘দি ম্যান অব দি ক্রাউড’ ছোটগল্পে একটি রেস্তোরাঁর জানালা দিয়ে ফুটপাত ধরে লোকজনকে অন্তহীন যাত্রায় অবিরাম চলতে দেখেছেন। বেদস্তুর  চেহারার একজনকে নির্দিষ্ট করে তার সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত জানবার আগ্রহে রাতভর তাকে লন্ডনের আনাচে কানাচে অনুসরণ করেছেন। কিন্তু সেই অজানাঅচেনা লোকটি হলো জনতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো সাধারণ মানুষ। এমন লোকের পিছু নেয়া নিরর্থক। কারণ সে চিরদিনই নামপরিচয়হীন থেকে যায় এবং তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার কোনো আত্মপরিচয় থাকে না, থাকে না কোনো স্বকীয় অস্তিত্ব। সে সাধারণ লোকের ভিড়ের অন্যতম পথিকের মতো ঠেলাঠেলি, ঘেঁষাঘেঁষি, ধাক্কাধাক্কি করে জনস্রোতে চলতে চলতে যথারীতি পথের মাঝেই হারিয়ে যায়। কিন্তু দেখা যায়,  মানুষের সঙ্গে যুক্ত হবার ক্ষেত্রে  ব্যক্তির সামাজিক  মর্যাদার  তুচ্ছতা  লেখকের জন্য কোনোই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি।  

 

ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুশো উপন্যাসে  ক্রুশো  জাহাজডুবির কারণে  নির্জন  দ্বীপে নিক্ষিপ্ত হয়ে সেখানে একনাগাড়ে চব্বিশ বছর কাটিয়েছে। কিন্তু মানুষ  থেকে  তার  বিযুক্তিতে  সে উন্মাদ হয়ে যায় নি কারণ তার সঙ্গে ছিল একটা বই যখনই নির্জনতার যন্ত্রণা তাকে আচ্ছন্ন করতে চাইতো তখনই  সে চলে যেতো ওই বইটির কাছে। বইটি ধর্মগ্রন্থ বাইবেল। কিন্তু তাতে কি? ধর্মগ্রন্থেও সাহিত্য থাকে, বাইবেলও এর ব্যতিক্রম নয় রবিনসন ক্রুশোর জন্য বাইবেল  পাঠ সাহিত্যপাঠই ছিল।  তার  বিচ্ছিন্নতা,  একাকিত্ব,  নিঃসঙ্গতা  ঘুচিয়েছে  সেই  সাহিত্য। আর এভাবেই  সে  যুক্ত থেকেছে তার  বিযুক্ত  পৃথিবীর  সঙ্গে।

 

আত্মমগ্নতা সাহিত্যের শত্রু গ্রীক পুরাণের অসামান্য সুন্দর কান্তিমান যুবক  নার্সিসাসসের আত্মমগ্নতা  আত্মপ্রেমের কিহিনি সকলেরই  জানা। চূড়ান্তরূপে আত্মমগ্নতা বা আত্মমুগ্ধতাকেই এককথায় বলে দেয়া যায়  নার্সিসিজমবা নার্সিসাস কমপ্লেক্স’– যা  ব্যবহার করা হচ্ছে ১৯৬৮ সাল থেকে। নার্সিসিস্টিক ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য হলো আত্মপ্রেম আত্মমগ্নতা, নিজের গুণ সম্বন্ধে অতিরঞ্জিত ধারণা পোষণ করা, নিজেকে এতোটাই গুরুত্ব দেয়া যে, জীবনে অন্য কাউকে গুরুত্ব দেবার বিন্দুমাত্র দায় অনুভব করে না। নার্সিসিস্ট ব্যক্তির জগত শুধু তাকে ঘিরেই।  এটি মূলত: একটি  সামাজিক সমস্যা নার্সিসিজমের সাথে সফলতার একটি যোগসূত্র দেখা যায়। নার্সিসিজম ব্যক্তিকে চূড়ান্ত স্বার্থপর করে তোলায় তিনি ভেবেই নেন যে, সফলতার প্রথম স্থানটি তার হবে। সে সমাজে কবিগুরুর  তালগাছ।  নিজেকে সবচেয়ে বিশেষ ভাববার কারণে সফলতার প্রতি তার অভব্য  ঝোঁকও বেশি হয়ে থাকে যেনে অবাক হবেন না যেপৃথিবীর ইতিহাসে সফল(!) স্বৈরাচারী শাসকরা কোনো না কোন দিক থেকে  সকলেই ছিলেন  নার্সিসিস্ট

 

সাহিত্যের প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতা  আর বিচ্ছিন্নতা। কারণ  সাহিত্যের  পরম  যাচ্ঞার নাম  সংযোগ।  সাহিত্য  নান্দনিকতা  এবং  দার্শনিকতার  জাদুমন্ত্রে  চৈতন্যকে জাগিয়ে  মননে মুগ্ধতা সঞ্চার করে মানুষের একাকিত্ব  দূর করা সাহিত্যের প্রধান দায়। সংলগ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক  একাকিত্ব নিতান্তই কৃত্রিম কিন্তু সংলগ্ন থাকাটা মানুষের  পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ে  নানান অভিঘাতে। বিচ্ছিন্নতা এসে ভর করে নানান  পথে।  আর সে জন্যই সে দায় সাহিত্যেকেই নিতে হয় কারণ  সাহিত্য জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয় বরং জীবনেরই সম্প্রসারণ।  যুক্ত করার মাঝেই সাহিত্যের সার্থকতা আর বিচ্ছিন্নতায়  সাহিত্য  মূল্যহীনরবীন্রনাথ একটি  উপমার  আশ্রয়ে ব্যক্ত করেন,  গাছে ফল যে-ক’টা ফলিয়া উঠে তাহাদের এই দরবার হয় যে, ডালের মধ্যে বাঁধা থাকিলেই আমাদের চলিবে না; আমরা পাকিয়া, রসে ভরিয়া, রঙে রঙিয়া, গন্ধে মাতিয়া, আঁটিতে শক্ত হইয়া, গাছ ছাড়িয়া বাহিরে যাইব—সেই বাহিরের জমিতে ঠিক অবস্থায় না পড়িতে পাইলে আমাদের সার্থকতা নাইসাহিত্যের পরম লক্ষ্যও  ওই ফলের  মতো। ভাব জ্ঞানাতীত।  তাই তাকে কেবলমাত্র শৈল্পিক  রূপায়নে সৃষ্টি করে তুললেই হয়  না বরং  তাকে  মানুষের  সঙ্গে  সংলগ্ন  হতে হয়, যুক্ত হতে  হয়  পরম   বিশ্বস্ততায়।
এ কথা সত্য  যে,  সাহিত্য গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।’ তাই বলে  এর  যুক্ত  হবার  পরিক্রমায়  ছেদ  পড়েনি।  মানুষের  সঙ্গ-লাভের  অভিযাত্রা  চির  চলমান। যেখানেই মানুষ, সেখানেই সাহিত্য। তাই মানুষের সঙ্গে সাহিত্যের বিচ্ছিন্নতা রহিত। সাহিত্যে  আমিত্ব নির্বাসিত। বহুত্ব  আদৃত।  সাহিত্য বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে সম্পৃক্ততার নান্দনিক  চর্চায় নিবেদিত।  সাহিত্য যেমন মানুষের  সুখের দিনের  সখা,  তেমনি  দুঃখের  দিনের  দোসর। গণমানুষের কণ্ঠ হয়ে গণমানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে  গণমানুষের  জয়গান গাইবার অব্যাহত ধারা নিরন্তর  প্রবহমান  থাকবে অনাগত কালান্তরে—‘যে আছে মাটির কাছাকাছি, সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।’  তাই  নন্দিত  শিল্প-সাহিত্যের  শাশ্বত  প্রার্থনা,  “অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে/  নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে/…  যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ/  সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।’

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading