অ্যাডভোকেট আনসার খান:ইতিহাসের স্মরণীয় এবং দুঃখজনক মহামারীর অন্যতম স্প্যানীশ ফ্লুর মারাত্মক প্রাদুর্ভাবের একশততম বার্ষিকী, যা শ্বাস-প্রশ্বাস ভিত্তিক ভাইরাসজনিত কারণে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশকে সংক্রমিত করেছিলো এবং পাঁচ থেকে দশ কোটি লোক মৃত্যবরণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়।
মানবতার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্হার অন্যতম ঐ স্প্যানিশ ফ্লু -যার উৎপত্তি হয়েছিলো ১৯১৮সালের জানুয়ারিতে এবং শেষ হয়েছিলো ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে। স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত এ মহামারী এইছ- ১ এবং এন-১ নামে পরিচিত একটা ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী -যে তীব্রতায় ও গতিতে সারা বিশ্বে আঘাত করেছিলো এবং কোটি কোটি মানুষকে সংক্রামিত করেছিলো তা সত্যিকার অর্থে অকল্পনীয় এবং বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে বিশ্ব পরিমণ্ডলে।
শতবর্ষ পরে কোভিড-১৯ নামক মহামারী স্প্যানিশ ফ্লুর ন্যায় প্রচণ্ড গতিতে আঘাত হেনেছে বিশ্বের মানুষের ওপর। তীব্র গতিতে এ মাহামারী ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পৃথিবীজুড়ে এবং এখন অবধি বিশ্বের প্রায় পচিঁশ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন কোভিড-১৯ ভাইরাসে। চীনের উহানে গেল ডিসেম্বরে এ ভাইরাসের উৎপত্তি হওয়ার পরে মাত্র সাড়ে তিন মাস সময়ের মধ্যে দু’শতাধিক দেশের এত মানুষের ওপর মহামারীর ছোবল এ ভাইরাসের তীব্রতা প্রমাণ করে।ভবিষ্যৎ দিনগুলোতে আরও কত মানুষকে সংক্রামিত করবে বা কতদিন এ মহামারী স্হায়ী হবে তা এখনই বলা অসম্ভব।
স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তিকালে এর যেমন পরিচয় জানা ছিলো না মানুষের, তেমনি তার চিকিৎসার জন্যও ছিলো না ওষুধ। মানুষ অন্ধকারের মধ্যেই বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করেছিলো এই অজানা-অচেনা এবং অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে।প্রথম দিনগুলোতে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার মতো পরামর্শ দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা,আর লকডাউনের মতো প্রতিরোধক পদক্ষেপ নিয়েছিল স্ব -স্ব দেশের সরকারগুলো।
একশ বছরের মাথায় এসে কোভিড-১৯ মহামারীর উদ্ভব, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া,তার থেকে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ ও সরকারগুলোর গৃহীত পদক্ষেপ স্প্যানিশ ফ্লুরই প্রায় অনুরূপ -এটা একটা কাকতালীয় বিষয় বটে।
একশ বছর আগে যেমন-একশ বছর পরে তেমনি এক মহামারী তাবৎ বিশ্বের ওপর আঘাত এনেছে যার পরিচয় মানুষের জানা নেই এবং নেই কোনো ওষূধও।এটা অদৃশ্য, অচেনা এক শত্রু। এ শত্রুর মোকাবিলার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সেই স্প্যানিশ ফ্লুর ন্যায়ই সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।ফলে দেশে-দেশে লকডাউন জারী করা হয়েছে মানুষকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখার জন্য,এক মানুষকে -অন্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য।কারণ এ মহামারী রোগের ওষুধ জানা না গেলেও এটা জানা গেছে যে মানুষ থেকে মানুষে এ রোগ সংক্রামিত হয়।তাই রোগের ব্যাপক ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্যই মানুষে -মানুষে দুরত্ব সৃষ্টি করার জন্য মানুষকে ঘরে বন্দি রাখার জন্য লকডাউন জারী করা হয়েছে।
এই লকডাউনের মাধ্যমেই কোভিড-১৯ নামক অদৃশ্য এবং অচেনা শত্রুর বিরুদ্ধে ভয়ংকর এক যুদ্ধে জড়িয়েছে গোটা বিশ্ববাসী।এ যুদ্ধ কনভেনশনাল কোনো যুদ্ধ নয়,এ যুদ্ধ ভিন্ন ধাঁচের এক যুদ্ধ, -যেখানে পৃথিবীর সকল জাতির মানুষেরা ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিনা অস্ত্রে,কোনো ধরণের সশস্ত্র বাহিনী ও মারণাস্ত্র ব্যতীতই অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে চলেছে।দেখার বিষয় হলো চলমান এ যুদ্ধে বোমা ফেলে বা গুলার আঘাতে কোনো ধ্বংসযজ্ঞ নেই বা নেই মানুষ হত্যার ঘটনা,অথচ অচেনা শত্রু ঐ ভাইরাসের আঘাতে মানুষ মারা পড়ছে প্রতিনিয়ত। শক্তিধর এ ভাইরাসের আঘাতে কোনো স্হাপনা,ভবন,বাড়ীঘর ধ্বংস হচ্ছে না,অথচ মানুষ লাশ হচ্ছে এবং প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্তের হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এই ভাইরাসে। এটি দৃশ্যমান শত্রু নয়, এটি হলো ভয়ংকর সংক্রামক অনুজীবী এক ভাইরাস- যার সাথে মানুষ লড়াই করে পেরে ওঠছে না এখন অবধি।
কোভিড-১৯ সংকটে মানুষের জীবন ও সমাজগুলো যেমন বিপজ্জনক অবস্হায় পতিত হয়েছে, তেমনি বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্হাগুলোর কিছু দুর্বলতাও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতাও স্পটভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী কার্যকর সহযোগিতা ও সমন্বয়ের অভাব,পর্যাপ্ত বৈশ্বিক প্রশাসনের অভাব,বিশ্ব রাজনৈতিক সংস্থাগুলোর নীতি চুড়ান্তভাবে অকার্যকর ও বিপজ্জনক বলে প্রতীয়মান হয়েছে বিধায় অদৃশ্য এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
কোভিড-১৯ মানবজাতির জন্য মারাত্মক জনস্বাস্থ্য হুমকি হয়ে ওঠার পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।এটি মানুষের জীবনজীবিকার ওপরও আঘাত তৈরি করেছে।চলাচলের চারটা স্বাধীনতা, যেমন:পণ্য,মুলধন,সেবা ও জনগণ,-এ নীতিগুলোর ওপর আঘাত দিয়েছে। মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে, ভ্রমণ ও একদেশ থেকে অন্যদেশে প্রবেশের ওপড় নিষেধাজ্ঞা আারোপ করার ফলে মানুষের মধ্যে স্ব-সহায়তার দিকটা ফুটে ওঠেছে,যা বিশ্বভাতৃত্বতার নীতিকে অবজ্ঞা করে। তবে এটাও সত্য যে, যেকোনো মহামারীতে -“জাতীয় স্ব-সহায়তা”মানুষের প্রথম মানসিকতা যা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে। চিন্তাবিদ স্টিফেন ওয়াল্ট এর মতে,”কোনোও একক তত্বই এগুলোর সমস্ত ব্যাখ্যা করে না,যখনই বিশ্বব্যাপী কোনো সংকট দেখা দেয় তখন বাস্তববাদ সর্বোত্তম একবচনীয় ব্যাখ্যামুলক অবস্হান নেয়।”
সম্প্রীতির সময়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সহজ হয়।তবে কোভিড-১৯ আমাদের দেখায় যে বাস্তবে যখন প্রয়োজন হয় তখন এধরণের সহযোগিতা করা কঠিন হয়ে পড়ে।তবে সঠিক কাজটা হলো সংকট প্রতিক্রিয়া এবং স্বাস্থ্য সেবা নীতিমালার বিশ্বজনীন সমন্বয় করা।কোভিড-১৯ এর মুখে সামিয়ক বৈশ্বিক সমন্বয়ের মাঝেই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়লাভের মুল নিহিত।
তাই বৈশ্বিক পর্যায়ে উপযুক্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অপরিহার্য। পর্যাপ্ত অবকাঠামো তৈরি করা দরকার। কোভিড-১৯ এর মতো সংকট আমাদের সাধারণ স্বার্থ, সহযোগিতার গুরুত্ব ও সাধারণ ভালোর মুল্য এবং আমাদের বিশ্বের একটা মৌলিক অ্যান্টোলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে-আমরা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং একে অপরের উপর নির্ভরশীল এবং সবকিছুর সাথে সম্পর্কিত। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে,আমরা প্রত্যেকে নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই নিরাপদ থাকতে পারি না।”কিছু করবেন না,কোনোও গোলমেলে জড়াবেন না,পড়বেন না এবং আপনি নিরাপদে থাকবেন ও আছেন”-এটা আর সত্য নয়। তাই সম্মিলিত ভাবেই কোভিড-১৯ যুদ্ধে জয়লাভের চেষ্টা করতে হবে।ইনশাআল্লাহ মানুষই জয়যুক্ত হবে।

লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading