নোভেল করোনা ভাইরাসনিঃসন্দেহে শতাব্দীতে গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম। কোনও ধরণের সামরিক যুদ্ধ নয়, নয় কোনও ধরণের পারণবিক অস্ত্র কিংবা নয় কোনও কোনও ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ; সামান্য কয়েক ন্যানোমিটারের ক্ষুদ্র এক মাইক্রোঅর্গানিজমের কাছে আজ গোটা পৃথিবী অসহায়। খালি চোখে দেখা যায় না অথচ কোনও এক অদৃশ্য শক্তি রূপেই গোটা পৃথিবীকে সে অচল করে দিচ্ছে এবং বিশ্বের প্রায় সকল দেশ এক হয়েও রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে ক্ষুদ্র অণুজীবটির কাছে, সমগ্র পৃথিবী যেনও আজ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে শুধু মাত্র এই একটি ভাইরাসের কারণে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হওয়া ভাইরাসটি আজ অ্যান্টার্টিকা ছাড়া গোটা পৃথিবীতেই বিস্তার লাভ করেছে এবং প্রতিনিয়ত মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে যাচ্ছে।

কী সেই নোভেল করোনা ভাইরাস যা আসলে মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে? করোনা শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দক্রনিকথেকে, যার সরল বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় দীর্ঘস্থায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাস্টিকসের পরিভাষায় ক্রনিক বলতে সেই সকল রোগকে বোঝায় যার প্রভাবে কোনও একজন রোগী দীর্ঘ মেয়াদে (ন্যূনতম) কোনও ধরণের শারীরিক জটিলতা ভোগ করে থাকেন কিন্তু আদৌতে তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়ও না। ক্রনিক ডিজিস প্রতিরোধে কোনও ধরণের ভ্যাক্সিনও নেই। উদাহরণস্বরূপ আর্থ্রাইটিসকে আমরা ক্রনিক ডিজিসের সাথে তুলনা করতে পারি কেননা আর্থ্রাইটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এবং এখন পর্যন্ত সে অর্থে আর্থ্রাইটিসের সে রকম কার্যকরী চিকিৎসাও নেই কিন্তু করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিষয়টি ভিন্ন। করোনা ভাইরাস মানুষের শরীরে সংক্রমণের সাথে সাথে খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং মানুষের শরীরের ফুসফুস এবং অনেক সময় পাকস্থলিতেও বিশেষ ধরণের প্রদাহ সৃষ্টি করে। করোনা ভাইরাসে সংক্রমণে সৃষ্ট রোগের নাম কোভিড১৯ যার সঠিক চিকিৎসা হয় তো বা এখন পর্যন্ত বের করা সম্ভব হয় নি। এমনকি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোনও ভ্যাক্সিনও আবিষ্কৃত হয় নি। তাই কোভিড১৯ কে আমরা বিশেষ ধরণের করোনিক ডিজিস বলতে পারি যা খুব দ্রুত সংক্রমিত হয়। যেহেতু ভাইরাস টাইপটি আমাদের সকলের কাছে নতুন তাই ভাইরাসকেনোভেল করোনা ভাইরাসঅভিহিত করা হয়। আবার যেহেতু ভাইরাসটি মানুষের শরীরের শ্বাসতন্ত্রে তীব্রভাবে প্রদাহের সৃষ্টি করে তাই অনেককে একে “Severe Acute Respiratory Syndrome“ বা সংক্ষেপে সার্স ভাইরাস নামে অভিহিত করে থাকেন। অন্যভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে করোনা ভাইরাসের নামকরণ করা হয়েছে ইংরেজি শব্দক্রাউনথেকে যার বাংলা প্রতিশব্দমুকুট ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে ভাইরাসটি অনেকটা মুকুটের মতো দেখায় বলে এরকম নামকরণ করা হয়েছে বলে অনেকে দাবি করে থাকেন।

আমাদের শরীরে যখন জ্বর আসে তখনই আমরা ধরে নি যে আমাদের শরীরে কোনও একটি ইনফেকশন ধরা পড়েছে এবং তাই সাধারণভাবে ভাইরাসও যখন মানুষের শরীরে আক্রমণ করে তখন জ্বর আসাটা স্বাভাবিক এবং একই সাথে সর্দি কাশির উপসর্গও দেখা যায়। কারণে অনেকে নোভেল করোনা ভাইরাসকে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সাথে তুলনা করেন কিন্তু বাস্তবিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে সাধারণ কোনও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস যদি সর্বোচ্চ মানের ছোঁয়াচেও হয় তাই এক জন মানুষ থেকে সর্বোচ্চ বারো জন সংক্রমিত হতে পারে কিন্তু নোভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি এক সাথে ২৭ কিংবা ২৮ এমনকি একসাথে ৫৭ জনকেও সংক্রমিত করতে পারেন। জার্মানির একটি বিখ্যাত ইউটিউব চ্যানেলকুর্জটজগেসাগটইন অ্যা নাটশেলযাঁরা মূলতঃ বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন ভিডিও সম্প্রচার করে তাঁদের প্রকাশিত ভিডিও অনুযায়ী করোনা ভাইরাস মূলতঃ ছড়ায় হাঁচিকাশি অথবা পারস্পরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে। কোনও পৃষ্ঠতলে ভাইরাস কতোক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে না পারলেও কিংবা বায়ুবাহিত কোনও মাধ্যমে ভাইরাসের জীবনকাল সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা সঠিকভাবে কোনও তথ্য না দিলেও ধারণা করা হয় যে আমাদের নাসিকা রন্ধ্রের ভেতর দিয়ে ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। পাশাপাশি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত কোনও রোগীর সংস্পর্শে আসার পর যদি আমরা আমাদের শরীরের কোনও অংশ বিশেষ করে চোখ কিংবা নাক অথবা আমাদের মুখ স্পর্শ করি। করোনা ভাইরাস মূলতঃ আমাদের শরীরের শ্বাসতন্ত্র বিশেষ করে অন্ত্র, প্লীহা কিংবা ফুসফুসের ওপর বিশেষভাবে সংবেদনশীল তবে সম্প্রতি অস্ট্রিয়ার গ্রাজে এক মেডিকেল ইনস্টিটিউশনের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ভাইরাস আমাদের পাকস্থলিকে সংক্রমিত করতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে জ্বর কিংবা সর্দিকাশি ধরণের কোনও উপসর্গ ছাড়াই আক্রান্ত ব্যক্তি সরাসরি পেটে ব্যথা এবং পরিপাকজনিত জটিলতার শিকার হতে পারেন। নির্দিষ্ট পোষকদেহের বাহিরে ভাইরাস জড় এবং নিষ্ক্রিয়।তাই কেবলমাত্র একটি জীবিত কোষে প্রবেশ করলেই ভাইরাস সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে।আমাদের ফুসফুস কয়েক মিলিয়ন অ্যাপিথিলিয়াল কোষ দ্বারা গঠিত, অ্যাপিথিলিয়াল কোষ মূলতঃ আমাদের শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ মিউকাসের বহিরাবরণ হিসেবে কাজ করে।করোনা ভাইরাস এই আবরণের একটি নির্দিষ্ট গ্রাহক কোষের সাথে যুক্ত হয়  এবং অন্যান্য ভাইরাসের মতো গতানুগতিক ধারায় তাঁর জেনেটিক উপাদান প্রবেশ করায় যার প্রভাবে কোষটির অভ্যন্তরে জেনেটিক উপাদানের অনুলিপি সৃষ্টি হয় তা পূর্নবিন্যাসিত হতে থাকে। অচিরেই কোষটি মূল ভাইরাসের অসংখ্য অনুলিপিতে ভরে উঠে এবং অচিরেই তা একটি ক্রান্তি পর্যায়ে এসে মূল কোষকে বিদীর্ণ করে বাহিরে বের হয়ে আসে এবং আশেপাশের কোষগুলোকে একইভাবে আক্রান্ত করে। প্রক্রিয়াকে রেপ্লিকেশন প্রক্রিয়া বলা হয়। আক্রান্ত কোষের   সংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। দেখা যায় যে এক সপ্তাহ কিংবা দশ দিনেই ভাইরাস আমাদের ফুসফুসের কয়েক মিলিয়ন কোষকে আক্রান্ত করতে পারে যার প্রভাবে আমাদের ফুসফুস কয়েক কোটি ভাইরাসে পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যদিও অনেক সময় মুহূর্তে এসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ্য বলে মনে হতে পারে কিন্তু তা তাঁর ইউমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে।যখন আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক কোষগুলো কিংবা আমাদের রক্তে থাকা লিম্ফোসাইট আমাদের শরীরের ফুসফুসে এসে পৌঁছায় তখন করোনা ভাইরাস সকল কিছু কোষকে সংক্রমিত করতে পারে।গোটা পৃথিবী যেমনিভাবে ইন্টারনেট দ্বারা একেঅপরের সাথে সংযুক্ত ঠিক তেমনি আমাদের শরীরের বিভিন্ন কোষগুলোও সাইটোকাইনস নামক এক ক্ষুদ্র প্রোটিনের মাধ্যমে একেঅপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। তাই প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়াই এর প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে আমাদের রোগপ্রতিরোধ কোষগুলো অতিপ্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকে। ফলে কোষগুলোর মাঝে অতিরিক্ত উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় যা আমাদের রোগপ্রতিরোধ কোষগুলোকে লড়াইয়ের উন্মাদনায় ফেলে দেয়। কিছু কিছু বিজ্ঞানীদের মতে উন্মাদনার ফলে মানব মস্তিষ্কের তাপ নিয়ন্ত্রণকারী অংশটি অর্থাৎ হাইপোথ্যালামাস অংশটি উদ্দীপ্ত হয় যার প্রভাবে জ্বর আসে। দুই ধরণের কোষ ধরণের প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যথাঃনিউট্রোফিলস যারা মূলতঃ একই সাথে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আক্রান্ত কোষের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং এক ধরণের এনজাইম নিঃসরণ করে। এনজাইমের প্রভাবে আক্রান্ত কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায় যদিও কিছু সুস্থ্য কোষও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরেক ধরণের প্রতিরক্ষা কোষ হচ্ছে কিলার টিসেল যারা মূলত অটোফেগি প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রিতভাবে আক্রান্ত কোষগুলোকে ধ্বংস হওয়ার নির্দেশ দেয় কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে এরা এতো বেশী উত্তেজিত হয়ে দাঁড়ায় যে তারা আশেপাশের সুস্থ্য কোষগুলোকেও আত্মহত্যার জন্য নির্দেশ দেয়।যতো বেশী প্রতিরোধক কোষ ছুটে আসে, ক্ষতির পরিমাণ ততোই বৃদ্ধি পায় আর ততো বেশী সুস্থ্য ফুসফুস টিস্যু তারা মেরে ফেলে। প্রক্রিয়াটি এতোটাই গুরুতর হতে পারে যে মাঝেমধ্যে ফুসফুসে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে যা ফাইব্রোসিস নামে পরিচিত। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ আবার তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ফিরে পেতে আরম্ভ করে যার প্রভাবে সংক্রমিত কোষগুলো মারা যেতে থাকে এবং ভাইরাসের নতুন করে সংক্রমণের সম্ভাবনা নস্যাৎ হতে শুরু করে।যাঁদের ইমিউন সিস্টেম অত্যন্ত শক্তিশালী তাঁদের অনেকে পর্যায়ে এসে সুস্থ্য হয়ে গেলেও যাঁদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম বিশেষ করে কারও যদি ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকে অথবা কারও যদি শ্বাসজনিত কোনও সমস্যা থাকে তাঁদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করে। তখন লক্ষ লক্ষ অ্যাপিথেলিয়াল কোষ মারা যায় এবং একই সাথে ফুসফুসের সুরক্ষাকারী আস্তরণটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে অ্যালভিওলাই অর্থাৎ বাতাসের যে থলির মাধ্যমে আমরা শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করে থাকি তা বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়। এতে রোগীরা নিউমোনিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং তাঁদের শ্বাসকার্যে বিভিন্ন ধরণের জটিলতার সৃষ্টি হয়।অনেক সময় শ্বাসকার্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং তখন কৃত্ৰিম শ্বাসপ্রশ্বাস বা ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। ইতোমধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর হাজার হাজার ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত, এমন সময় লাখো ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বংশবিস্তার তাঁর শরীরে নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি করে। অনেক সময় সকল ব্যাকটেরিয়া ফুসফুসের প্রাচীরকে ছিন্ন করে রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে। এমনটি ঘটলে মৃত্যু অনেকটাই অনিবার্য।

অস্ট্রিয়ার গ্রাজে অবস্থিত এক মেডিকেল ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী কোনও কোনও সময় ফুসফুসের কোষে ভাইরাসটি কাঙ্খিতভাবে বংশবিস্তার ঘটাতে না পারলে তাঁরা পাকস্থলিতে চলে আসে এবং পাকস্থলি কোষে একই ভাবে সংক্রমণ ঘটায় যার প্রভাবে ডায়ারিয়া কিংবা পাকস্থলিতে বড় কোনও ধরণের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই অনেক সময় কোনও ধরণের জ্বর, গলাব্যথা কিংবা সর্দিকাশি ছাড়াই সরাসরি ডায়ারিয়া কিংবা পাকস্থলির কোনও জটিলতাও হতে পারে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের লক্ষণ।

সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ক্ষেত্রে জ্বর, সর্দিকাশি কিংবা গলাব্যথার পাশাপাশি অন্য কোনও উপসর্গ তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয় না।

আর করোনা ভাইরাস যেহেতু একটি আরএনএ ভাইরাস তাই এর মিউটেশনের হারও অনেক বেশী, কারণে ভাইরাসটি দ্রুত তার টাইপ পরিবর্তন করতে পারে যদিও সব সময়ই যে মিউটেশন অর্থাৎ আরএনএ এর জিনোমের সিক্যুয়েন্সের পরিবর্তন আমাদের জন্য ক্ষতিকারক হবে তেমনটি নয়। আর যেহেতু ভাইরাসটি আমাদের সকলের নিকট নতুন তাই এজন্য ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোনও ওষুধ তৈরী করা যায় নি। যদিও অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসের দেহে কোনও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না তবুও অনেকে কোভিড১৯ এর চিকিৎসায় অ্যাজিথ্রোমাইসিনের কথা বললেও সুনির্দিষ্টভাবে এক্ষেত্রে এর কার্যকরিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যেহেতু কোভিড১৯ এর সংক্রমণের সাথে ব্যাকটেরিয়াঘটিত নিউমোনিয়া তাই সেকেন্ডারি হিসেবে অ্যাজিথ্রোমাইসিন ব্যবহার করা গেলেও একটা ঝুঁকি থেকেই যায় কেননা অ্যাজিথ্রোমাইসিন অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক এবং অনেকের শরীরই ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে সক্ষম নয়। ক্লোরোকুইনিনের কার্যকারিতা নিয়ে এখনও বিজ্ঞানীরা দ্বিধাবিভক্ত।

করোনা ভাইরাস নিয়ে আমাদের সমাজে বেশ কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। যেমনঃ অনেকেই বলে থাকেন যে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম কয়েক দিন্ ভাইরাস কেবলমাত্র কন্ঠনালী কিংবা গলায় আক্রমণ করে এবং সময় লেবুর রস, ভিনেগারসহ অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করতে পারে কিন্তু ধারণাটি ভুল। এটি ঠিক যে লেবুর রস কিংবা ভিনেগারের জীবাণুনাশক ক্ষমতা রয়েছে কিন্তু ভাইরাসের লক্ষ্য হলো বংশবৃদ্ধি করা আর সে কারণে সে চাইবে তাঁর বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত মাধ্যম অর্থাৎ করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে যদি বলি তাহলে ফুসফুস, প্লীহা কিংবা অন্ত্রে যতোটা দ্রুত সম্ভব সংক্রমণ ঘটানো। আবার অনেকে ধারণা করে থাকেন যে ৮০. ডিগ্রি ফারেনহাইট ওপরে ভাইরাসটি জীবিত থাকতে পারে নি কিন্তু ধারণাটি ভুল। মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮. ডিগ্রি ফারেনহাইট। যদি তাঁদের দাবি ধারণা  হতো তাহলে কোনও মানুষই করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতো না। পাশাপাশি আরও একটি ধারণা আমাদের অনেকের মাঝে প্রচলিত রয়েছে যে কেবলমাত্র ষাট কিংবা সত্তরের ঊর্ধ্বদেরই ভাইরাসে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশী। স্লোভেনিয়াতে গতকাল ২৫ শে মার্চ স্থানীয় সময় দুপুর দুইটা পর্যন্ত স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত  রোগীর সংখ্যা ৫২৮ জন এবং এদের একটি বড় অংশের মানুষের বয়স ২৫ থেকে ৩০। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাইরাসের সংক্রমণে যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের একটা অংশের মানুষও মাঝ বয়সী। কারও শরীরে কোভিড১৯ ধরা পড়লে তাঁকে নিয়মিত পরীক্ষা করার কোনও প্রয়োজন নেই তবে যেটি করা যেতে পারে সেটি হলো নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাঁর শরীরে লিম্ফোসাইট এবং ইএসআর পরীক্ষা করা কেননা কোনও ব্যক্তি কোনও ধরণের ইনফেকশন দ্বারা আক্রান্ত হলে তাঁর শরীরে এমনিতে লিম্ফোসাইট এবং ইএসআর অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এরপর যখন আবার তাঁর শরীরে লিম্ফোসাইট এবং ইএসআরের মাত্রা স্বাভাবিক রেঞ্জে নেমে আসবে সে সময় হয় তো বা আবারও তাঁকে কোভিড১৯ এর জন্য পরীক্ষা করা যেতে পারে। কোভিড১৯ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে শুরু করে একজন রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণা দাবি করছে। যেমনঃ স্লোভেনিয়াতে প্রথম কোভিড১৯ রোগী শনাক্ত করা হয় মাসের চার তারিখে কিন্তু আজকে ২৬ তারিখ অর্থাৎ পর্যন্ত এখনও কেউ সুস্থ্য হয়ে বাসায় ফিরেছেন তেমনটি কিন্তু নিশ্চিত করে বলা হয় নি কোনও সূত্রে। একই চিত্র পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র অস্ট্রিয়া কিংবা ইতালির দিকে লক্ষ্য করেন তাহলে বিষয়ে আরও স্পষ্ট প্রমাণ পাবেন যদি আপনি লক্ষ্য করেন যে দেশ দুইটিতে প্রথম কবে কোভিড১৯ এর রোগী শনাক্ত করা হয়েছিলো এবং পাশাপাশি প্রত্যেক দিন্ নতুন করে কতোজন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং কতো জনকে বা পূর্ণাঙ্গভাবে সুস্থ্য ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে দীর্ঘ সময় যেহেতু আমাদের শরীরের অ্যান্টিবডি ভাইরাস এবং সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়ার সাথে লড়াই করার ফলে আমাদের শরীর অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়ে, তাই আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ্য মনে হওয়ার পরেও একটি লম্বা সময় পর্যন্ত তাঁকে অন্য কোনও ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ কিংবা দ্বিতীয়বার করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

আমরা জানি যে কোনো ভাইরাসের বহিরাবরণ ক্যাপসিড লিপিড এবং প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত যৌগ লিপোপ্রোটিন দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে যা মূলতঃ একটি অ্যাসিডিক যৌগ। তাই ধরণের ভাইরাসের মোকাবেলায় সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত পরিষ্কার করা একটি কার্যকরী সমাধান হতে পারে। সাবান হচ্ছে উচ্চতর ফ্যাটি অ্যাসিডের সোডিয়াম বা পটাশিয়াম লবণ যা সহজে ভাইরাসের বহিরাবরণকে ধ্বংস করে দিতে পারে। পাশাপাশি কোনও ব্যক্তি যদি মনে করেন যে তিনি করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত তাঁকে তৎক্ষণাৎ যতো দ্রুত সম্ভব নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে এবং বেশী করে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার ভিনেগার গ্রহণ করতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ সময় আমাদের সকলকে সঙ্গে রাখতে হবে যেমনঃ প্যারাসিটামল অথবা কারও যদি শ্বাসপ্রশ্বাসে কোনও সমস্যা থাকে তাহলে সব সময় তাঁর সাথে নেবুলাইজার রাখতে হবে। খুব বেশী জরুরি প্রয়োজন না থাকলে সময় কারও বাসা থেকে বাহিরে বের না হওয়া উত্তম এবং যেহেতু ভাইরাস হাঁচিকাশি কিংবা বায়ুবাহিত মাধ্যমে সবচেয়ে বেশী ছড়ায় তাই বাহিরে গেলে সব সময় মাস্ক পরিধান করতে হবে। সদা পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে হবে। পরিস্থিতি যদি খারাপের দিকে যায় তখন নিকটস্থ হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত হ্যান্ড গ্লাভস পড়ার অভ্যাস করতে হবে। কেননা অনেক সময় কোনও বস্তুর পৃষ্ঠতল স্পর্শ করলে তার মাধ্যমেও ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা যখন গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছায় এবং রোগী নিজের থেকে নিঃশ্বাস গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন কৃত্রিম শ্বাস অথবা ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয় কিন্তু যে হারে ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পরে সে হারে কোনও দেশে আইসিউ কিংবা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকে না। এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে জার্মানির মতো দেশ যেখানে প্রায় আট কোটির মতো লোক বসবাস করে সেখানে সব মিলিয়ে ভ্যান্টিলেশনের ব্যবস্থা রয়েছে ৪৮,০০০ এর মতো, অস্ট্রিয়াতে সংখ্যাটি ,০০০ এর কাছাকাছি। অর্থাৎ প্রয়োজন অনুপাতে আইসিউ কিংবা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা কোনও দেশে নেই। কারণে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ্পে কন্তেকে বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছে যে সকল রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর দেশের নেই।

একমাত্র সচেতনতাই পারে আমাদের সকলকে রোগের বিস্তার থেকে রক্ষা করতে। তাই আমাদেরকে সচেতন হতে হবে এবং পাশাপাশি অন্যদেরকেও ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সবাইকে সব সময় সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।

রাকিব হাসান / শুদ্ধস্বর ডটকমের স্লভোনিয়া প্রতিনিধি ।

ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স,
ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা,
স্লোভেনিয়া!!!

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading