জানতাম সে মরে যাবে। ৭০/৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া দেহ নিয়ে কেউ বাঁচে না, বাঁচে নি কোন দিনে। যে কয়েকদিন বেঁচে থাকে ভোগ করতে হয় অসহ্যকর বেদনা। বেঁচে থাকার ইচ্ছে থেকে বেড়িয়ে এসে এমন অবস্থায় সবাই মরতে চায়। তবুও নুসরাত জাহান রাফি বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলো। কিন্তু সে তো মরেই যাবে, তাই প্রথম দিনই বিধাতার কাছে আকুল আর্জি ফেলেছিলাম, ‘নুসরাত কে যত দ্রুত পারো মুক্তি দাও, তাকে দগ্ধ দেহের এমন যন্ত্রণা থেকে দ্রুত মুক্তি দাও হে বিধাতা। ‘
নুসরাতের এমন পরিস্থিতি যারা করেছে, সেই ঘাতকদল, পাষন্ডের দল, হিংস্রের দল শাস্তি পাবে কি পাবে না বা কি ধরনের শাস্তি পেলে মন শান্তি পাবে এসব না ভেবে শুধু একটা কথাই ভেবেছিলাম নুসরাত তার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাক, তাড়াতাড়ি মুক্তি পাক, এই অগ্নিদগ্ধ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাক।
সেই আর্জি কবুল হলো পাঁচ দিন পর গতকাল। নুসরাত মুক্তি পেলো, চিরতরে মুক্তি পেলো তবুও পাঁচ দিন যন্ত্রণা ভোগ করে সবাইকে কাঁদিয়ে, বিবেকের ঘরে লাথি মেরে, মনুষ্যত্বের মুখে থুথু ছিটিয়ে চলে গেলো অসহায়ত্ব বরণ করে।
আসলে, নুসরাত সম্পর্কে লিখতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছি। কেন কাঁপছি? জানি না। তবে এটা জানি নুসরাত এক করুণ দুঃখের নাম হয়ে বাংলাদেশে বেঁচে থাকলো।
সেদিন নুসরাতকে জানার আগে প্রথম জানতে পারি সিরাজ উদ দৌলা কে। অনেকে ফেসবুকে তার ফটো দিয়ে লিখেছে, তাকে যেন রাস্তায় প্রকাশ্যে গায়ে আগুন দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। ঘটনা কিছুই বুঝলাম না, পত্রিকার পাতায় দৃষ্টি রাখলাম ঘটনা জানার জন্য। যা জানলাম তাতে শতবার মরে যাওয়ার ইচ্ছে হলো।
সিরাজ উদ-দৌলা নামে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামীয়া সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার এক অধ্যক্ষ নুসরাতের শ্লীলতাহানি বা তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলো। নুসরাত ঐ প্রতিষ্ঠানেরই নিয়মিত ছাত্রী। তার শিক্ষাগুরুর এমন আচরণ, কুপ্রস্তাবে রাজি না হয়ে উঠে প্রতিবাদী। (অন্তস্তল থেকে শত স্যালুট জানাই।)
যাক, সেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় নুসরাতের এই পরিনতি। নুসরাত বিষয়টি তার পরিবারকে অবগত করলে; গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন নুসরাতের মা এবং সেই মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
কী আশ্চর্য! অপরাধীরা এদেশে আজ কত শক্তিশালী। অধ্যক্ষের পক্ষ থেকে নুসরাত ও তার পরিবারকে দেওয়া হয় মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার চাপ। মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় কারাগারে থেকেই পরিকল্পনা করে নুসরাতকে হত্যা করার। বলা যায় অধ্যক্ষের নির্দেশে বা নির্দেশনায় গত ৬ এপ্রিল, শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নুসরাত আরবী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে আসলে নুসরাতকে কৌশলে ডেকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের ছাদে এবং হাত বেঁধে গায়ে দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় সেই অধ্যক্ষের পোষা দুর্বৃত্তরা। সেই মেয়েটি মৃত্যুর সাথে পাঁচ দিন লড়ে বাঁচার আকুতি রেখে চিরমুক্তির সনদ নিয়ে চলে গেলো গতকাল (১০/০৪/১৯ইং) রাত নয়টায়।
আরো আশ্চর্যের কথা- কোন ছাত্রসংগঠন, সমাজসেবী সংগঠন, নারীবাদী সংগঠন, সুজন কিংবা সুশীল সমাজ নুসরাতের জন্য পথে নামে নি, বিচারের দাবী নিয়ে সড়ক অবরোধ করে নি, শাহবাগ দখল করে মাইকে আওয়াজ তুলে নি কোন প্রগতিশীল শক্তি বা স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী সমাজ। কারণ কি? যারা একজন বেশ্যার ইজ্জতের জন্যেও গোটা দেশ কাঁপিয়ে তুলতো তারা নিরবতা পালন করলো কেন? এমনকি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সরকারী- বেসরকারি কোন মানবাধিকার সংস্থাকেও প্রতিবাদ করতে দেখি নি। তাহলে কি ধরে নেবো- নুসরাত একজন মাদ্রাসার ছাত্রী, বোরকা পরিহিত বলে সবাই চুপচাপ! ছি! ছি!
আবার কোন ইসলামী জোট বা মোল্লা মৌলবীর দলের কেউ ফতোয়া দিলো না যে, সিরাজ উদ-দৌলাকে ‘দোররা’ মারা হোক। উল্টো দেখলাম কি! কিছু কিছু ছোট বাচ্চাদের রাস্তায় নামানো হয়েছে সিরাজ উদ-দৌলার মুক্তি দাবীতে; আমার চরম হাসি গো। সাথে মনে প্রশ্ন জাগে কোন অপশক্তির জোরে এসব জারজ সন্তানেরা টিকে আছে?
এর চেয়ে আরো অবাক করার মতো ব্যাপার হলো; ঘটনাকে অন্য খাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এমনকি এই বিষয়টাকে নিয়ে একপ্রকার রাজনীতিও শুরু হয়ে গেছে তলে তলে, হয়তো দুয়েক দিনের মধ্যেই পুরো ব্যাপারটা অন্য মোড়কে জ্বলে উঠতো। কিন্তু গতকাল নুসরাতের মৃত্যু হয়ে যাওয়ায় সে সুযোগ আর যে রইলো না তাও বলার সাহস পাচ্ছি না। কারণ, এদেশে আজ অপরাধীদের হাত যেন আইনের হাত থেকেও শক্তিশালী।
ধিক্কার জানাই আমাদের মানসিকতাকে। আমি বুঝিনা কোন শিক্ষাগুরু, রাজনৈতিক, সমাজসেবী, প্রভাবশালী, হুজুর, মোল্লা-মৌলবী, পুরোহিত- পন্ডিত, কবি-সাহিত্যিক, আমার চোখে অপরাধী শুধুই অপরাধী হিসেবে পরিচিত, ঘৃণিত, তাদের বিচার হওয়া চাই-ই, চরম দৃষ্টান্ত স্বরূপ বিচার। এবং যারা নিরব থাকলো তাদেরও বিচাই হোক। তা না হলে আগামীকাল আমার বা আমাদের সন্তানেরা, মা-বোনেরাও এমনি ভাবে মুছে যাবে চিরতরে।
কতকাল আর চলবে এভাবে? কতজন আর মরবে এভাবে? আজ নুসরাতের দাফন কাফন হয়ে গেলো। ফেসবুকের মাধ্যমে দেখলাম, আজ তার হত্যাকারীর বিচারের দাবীতে দুয়েকটা মানব বন্ধন হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। হায় হতভাগী নুসরাত! দেখে যেতে পারলো না তার হত্যাকারীর সুষ্ঠু বিচার। এটাও সত্য, অস্বীকার করারও সাহস আমাদের নেই- দু তিন দিন পর আমরা ভুলেই যাবো এই ঘটনা; যেমন করে ভুলে গেছি অতীতের ঘটনাগুলো। যাদের আত্মাগুলো ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আর আইন! তার গতি তো স্বয়ং ঈশ্বরও বাড়াতে পারে না।
নুসরাত, বোন আমার; কখনো ক্ষমা করিও না আমাদের। নুসরাত উপরে গিয়ে ভালো থাকো আর অভিশাপ দাও আমাদের, তোমার অভিশাপে যদি মানুষ হতে পারি কখনো!
——————
১১/০৪/১৯ইং
এস.আই.তানভী