শ্লীলতাহানির মামলা করায় গত শনিবার এক ছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার পর ফেনীর সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার নানা অপকর্মের তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। এর আগেও একাধিক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ, তিনি একেক সময় একেক ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করতেন। এ অপকর্ম করতে অধ্যক্ষ মাদ্রাসা শিক্ষকদের কার্যালয় থেকে নিজ দফতরটি আলাদা ভবনে সরিয়ে নিয়েছেন।
তিনি সাইক্লোন সেল্টারে দোতলায় দফতর করেছেন। তার এসব অপকর্মের অন্যতম সহযোগী মাদ্রাসার পিওন, কয়েকজন ছাত্র এবং স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা।
এর আগেও ওই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির লিখিত অভিযোগ দেয়া হলেও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি এবং প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এছাড়া মাদ্রাসায় অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতাসীনদের হাতে রেখে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, অধ্যক্ষ সিরাজকে এর আগে এক শিশু বলাৎকারের অভিযোগে ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের সালামতিয়া মাদ্রাসা থেকে বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে নোয়াখালীর বসুরহাটের রঙ্গমালা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে চাকরিচ্যুত করা হয় তাকে। তার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তা, প্রতারণা, নাশকতা ও চেক জালিয়াতিসহ সোনাগাজী ও ফেনী থানায় চারটি মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
চেক জালিয়াতির মামলায় ২০১৭ সালেও জেল খেটেছিলেন তিনি। জামায়াতের সাবেক রুকন অধ্যক্ষ সিরাজকে ২০১৬ সালে নৈতিক স্খলন, তহবিল তছরুপসহ নানা অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসায় যোগদানের পর সিরাজ উদ দৌলা প্রতিষ্ঠানটিকে অনিয়ম, দুর্নীতি ও যৌন হেনস্তার আখড়ায় পরিণত করেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
তার এসব অপরাধের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে অভিভাবকরা অভিযোগ জানালেও প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কমিটির কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ছয় মাস আগেও এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছিলেন মাদ্রাসার আরেক ছাত্রী।
এর আগে উম্মুল কুরা মাদ্রাসা নামে ফেনী শহরে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন সিরাজ। ওই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার হোল্ডারদের কাছ থেকে নেয়া বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠে সিরাজের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে চারজন শেয়ারহোল্ডার তার বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মামলা করেন। এ মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে একাধিক গ্রুপ সক্রিয় আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দুই দশক আগে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় ভাইস প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ পান সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদের মৃত. কলিম উল্যার ছেলে সিরাজ উদ দৌলা। যথাযথ যোগ্যতা না-থাকায় জাল কাগজপত্র বানিয়ে তিনি এ প্রতিষ্ঠানে ঢোকেন বলে এর আগেও অভিযোগ উঠেছিল।
এ নিয়ে চার বছর আগে মাদরাসার তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটির অভিভাবক সদস্য এবং সোনাগাজী পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবদুল মান্নান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট শাখার ডিজি বরাবর একটি অভিযোগ জমা দেন।
ওই অভিযোগে বলা হয়, ফাজিল মাদ্রাসায় নিয়োগ পেতে হলে আলিম মাদ্রাসায় চাকরির ন্যূনতম ১২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। অথচ সিরাজ তার আগেকার দুটি দাখিল মাদ্রাসায় চাকরি করার ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ জমা দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই মাদ্রাসায় নিয়োগ পাওয়ার পর সিরাজ সুবিধাবাদীদের সঙ্গে নিয়ে অনিয়মের মহোৎসবে মেতে ওঠেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে একাধিক গ্রুপ সক্রিয় ছিল। কিন্তু গত ছয় মাস ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন এ প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতির দায়িত্বে আছেন। অধ্যক্ষের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তার অপকর্ম ঢাকার অভিযোগ উঠেছে রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে রুহুল আমিন গণমাধ্যমকে জানান, ‘কোনো ধরনের অপরাধকে আমরা প্রশ্রয় দিই না। রাফিকে আগুন দেয়ার ঘটনায় আমি ন্যায়বিচার চাই। দোষী যে-ই হোক না কেন আমি প্রকৃত দোষীর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।’
এদিকে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ আবদুল হালিম মামুন বলেন, ‘অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তথ্য এর আগে প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ একটি গ্রুপ তাকে রক্ষা করতে সব সময় মরিয়া হয়ে অবস্থান নেন।’
সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তা ও চেক জালিয়াতিসহ তিনটি মামলা রয়েছে। এসব বিচারাধীন এসব মামলায় তিনি দফায় দফায় কারাভোগ করেছেন।
অপকর্ম করতে নিজের অফিস আলাদা করেছিল অধ্যক্ষ:
ছাত্রীদের সঙ্গে অপকর্ম করতে অধ্যক্ষ সিরাজ নিজের দফতরটি আলাদা করেছেন। সাইক্লোন সেল্টারের দোতলায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছাত্রীদের ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করতেন অধ্যক্ষ। একাধিক ছাত্রী অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা কর্তৃক যৌন হেনস্তার শিকার হলেও লোকলজ্জার ভয়ে প্রকাশ করেননি। গত ২৭ মার্চ সবশেষ যে ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেছেন তার দুই মাস আগে আরও এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেছেন। ওই ঘটনায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে অভিযোগ করা হলেও কোনো বিচার হয়নি।
এর আগেও একাধিক ছাত্রীকে পিওন দিয়ে ডেকে নিয়ে নিজ কক্ষের মধ্যে শ্লীলতহানি করতেন অধ্যক্ষ। ওইখানে অধ্যক্ষ সিরাজ খাস কামরাও তৈরি করেছেন। অধ্যক্ষ সিরাজ পিওনদের দিয়ে ডেকে নিয়ে ছাত্রীদের নানা প্রলোভনে ফেলে শ্লীলতাহানি করতেন। তার বিরুদ্ধে কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারতো না।
তার বিরুদ্ধে যাতে কেউ কোনো কথা বলতে না পারে এজন্য নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন। মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্র তার অপকর্মের সহযোগী। এছাড়া পিওনরা তার অপকর্মের অন্যতম সহযোগী।
ভুক্তভোগীদের হুমকি-ধামকি:
দগ্ধ ছাত্রীর পরিবারের সদস্যরা জানায়, সোনাগাজী খাজিদাতুল কুবরা মহিলা মাদ্রাসা থেকে এ প্লাস পেয়ে দাখিল পাস (এসএসসি) করার পর ২০১৭ সালে সোনাগাজী পৌরশহরের থানার অদূরে জেলার ঐতিহ্যবাহী সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় আলিমে ভর্তি হন দগ্ধ ছাত্রী। মেধাবী এ ছাত্রী মাদ্রাসায় ভর্তির পর থেকে সরাসরি না হলেও আকারে ইঙ্গিতে বিভিন্ন সময়ে দগ্ধ ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করত।
সর্বশেষ আলিম পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা ওই ছাত্রীকে পিওন নুরুল আমিনকে দিয়ে ডেকে নেয়। তখন ফূর্তি ও নিশান নামে দুই বান্ধবীকে নিয়ে দগ্ধ ছাত্রী প্রিন্সিপাল সিরাজউদ দৌলার কক্ষে প্রবেশ করে। সেখানে আলিম পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষার আধাঘণ্টা আগে প্রশ্ন দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ওই ছাত্রীকে কুপ্রস্তাব দেয়। তখন দগ্ধ ছাত্রীর দুই বান্ধবী ছিল প্রিন্সিপালের কক্ষের বাইরে।
এক পর্যায়ে প্রিন্সিপাল সিরাজ উদ দৌলা দগ্ধ ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি করে। ওই ছাত্রী এমন পরিস্থিতে থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত বের হয়ে আসে। এরপর বাড়ি গিয়ে তার মা ও পরিবারের সদস্যদের প্রিন্সিপালের কুকীর্তির কথা প্রকাশ করে। মেয়ের ঘটনা শুনে দগ্ধ ছাত্রীর মা ও ভাই এলাকার কাউন্সিলর ইয়াছিন মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ওইদিন প্রিন্সিপালের কাছে এসে ঘটনার বিষয়ে জানতে চান। একপর্যায়ে প্রিন্সিপাল উত্তেজিত হয়ে ওই মেয়ের ছোট ভাইকে (একই মাদ্রাসার দাখিল পরীক্ষার্থী) মারপিট করার জন্য মাদ্রাসার কিছু ছাত্রদের ডেকে নিয়ে আসে। একই সময় থানায় ফোন করে পুলিশ ডাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য। ওই সময় অধ্যক্ষ হুমকি দেয় এ ঘটনায় যদি মুখ খোলে তাহলে ছাত্রী ও ছাত্রীর পরিবারকে মেরে লাশ টুকরো টুকরো করা হবে। একপর্যায়ে সোনাগাজী থানার একজন এসআই (যিনি বর্তমানে শ্লীলতাহানির ঘটনায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা) প্রিন্সিপালের কক্ষে আসলে প্রিন্সিপাল দগ্ধ ছাত্রীর ভাই ও মাকে পুলিশে দেয়ার চেষ্টা করেন। পরে ওই কর্মকর্তা দগ্ধ ছাত্রীকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে বললে ছাত্রী এসে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে।
ওই সময় ফূর্তি ও নিশান নামে দুই বান্ধবী প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। পরবর্তীতে পুলিশ প্রিন্সিপালকে আটক করে থানায় নিয়ে গেলে দগ্ধ ছাত্রীর মা নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলার পর থেকে প্রিন্সিপালের অন্যতম সহযোগী একই মাদ্রাসার ছাত্র নুরে আলম, মাদ্রাসার ছাত্রলীগ নেতা শাহে আলম শামিম, জাবেদ ও মহিউদ্দিন শাকিলসহ কয়েকজন দগ্ধ ছাত্রী ও তার পরিবারকে অব্যাহত হুমকি দিয়ে মামলা তুলে নিতে বলে।
সর্বশেষ ঘটনার দিন মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মাদ্রাসা ছাত্রীর ভাইকে ফোন করে মামলা তুলে নিয়ে আপস করবে কিনা জানতে চায়।