যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি চ্যানেল টাইম টেলিভিশনের টকশোতে অংশ নিয়ে সোমবার বাংলাদেশের প্রখ্যাত ফটোসাংবাদিক ড. শহিদুল আলম নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। ‘টাইম পলিটিকস’ শিরোনামের ওই টকশোতে তিনি কিভাবে গ্রেপ্তার হয়েছেন, গ্রেপ্তারের প্রেক্ষাপট, অতীত ও বর্তমানের নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তার কথায় তুলনামূলকভাবে উঠে এসেছে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারসহ পরবর্তী সব সরকারের কর্মকাণ্ড।

গত বছর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় শহিদুল আলমের একটি সাক্ষাতকার নেয় কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরা। ওই সাক্ষাতকারে তিনি সড়ক আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে সরকারের সমালোচনা করেন। এরপর নিজের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। ওই সময় বাসায় তিনি একাই অবস্থান করছিলেন।

টাইম টেলিভিশনের টকশোতে শহিদুল আলম বলেন, যখন গ্রেপ্তার করতে গেছে তখনই তো আমি বুঝেছি পরিস্থিতি কি।

যেহেতু আমি জানি কি হয়, তাই ভেবেছি, এই সময় আমাকে নিয়ে গেলে কেউ জানবে না, তাহলে তো বিপদের বিষয়। তাহলে ফাঁকা বাড়িতে এসে (কেউ) হয়তো ভাববে শহিদুল কোথাও গেছে। কাজেই তখন থেকে আমি যতটা পারি আওয়াজ করি, যতটা পারি ওদের দেরি করাতে চেষ্টা করি।

তিনি বলেন, আমি প্রচণ্ডভাবে চিৎকার করেছি। শারীরিকভাবে আমি যতটা পারি রোধ করতে চেষ্টা করেছি। দরজা বন্ধ করার সুযোগ পাইনি। কিন্তু তারা তো একেবারে আমাকে… আমি যাবো না বলে ধরে রাখছিলাম যেটা। ৫-৬ জন আমাকে ধরেছে। আমাকে নিয়ে যাবে এবং একেবারে তুলে নিয়েছে। আমি একা, সম্ভব তো না। ওরা এতগুলি মানুষ। অনেকগুলি গাড়ি নিয়ে তারা এসেছিলো।
শহিদুল আলম বলেন, বাড়িতে আমি একা ছিলাম। কম্পিউটারে কাজ করছিলাম। ফোন এসেছিলো, ফোনে কথা বলছিলাম। যেহেতু বাড়িতে একা ছিলাম, আমি চলে গেলে কেউ এসে কিছু যে একটা হয়েছে, সেটাও বুঝবে না। তখন আমি সেটাই চেষ্টা করছিলাম।
তারপরে সত্যিকার অর্থে কি হয়েছে আমি জানি না। সত্যিকার অর্থে কেউ জেনেছে কিনা, সেটাও আমি জানি না। আমার হাত বাঁধা হলো পেছনে। আমার চোখ বাঁধা হলো। কোথায় নিয়ে গেছে, সেটা তো জানি না। পরে ঘটনাগুলি তো আপনারা শুনেছেনÑ  আমার ওপর যে আক্রমণ করা হয়, অত্যাচার করা হয়।

কিন্তু পরেরদিন যখন আমাকে কোর্টে নিয়ে যাচ্ছে, তখন আমি আমার সহকর্মীদের রাস্তায় দেখি এবং তাতে আমি আশ^স্ত হই, তারা তো জানতে পেরেছে- আমি কোথায় আছি এবং আমি তো জীবিত আছি। এই দু’টো জিনিস তারা জেনেছে। তারপরে পুলিশের হেড অফিসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে আমাকে বলা হয় যে, যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, আমরা সব ভুলে যাবো, আপনাকে বাড়ি নিয়ে যাবো। কোন সমস্যা হবে না। তুমি চুপ থেকো।

তিনি বলেন, মূলত: জিনিসটা হচ্ছে, আমার শারীরিক স্বাধীনতা দেবে, আমার বাকস্বাধীনতা রোধ করে। সেই শর্তে আমি রাজি হইনি। তারা অনেক চাপাচাপি করলো। তখন তারা বললো, তাহলে কিন্তু ভালো হবে না। তারপরে কোর্টে গেলাম। কোর্টে গিয়ে আমি তখন বললাম- কি হয়েছে। কোর্টে অবশ্য আমার আইনজীবীরা ছিলেন। আমাদের যেটা নিয়ম, কেউ যদি বলে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন হয়েছে তাহলে তাকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। আমাদের আইনজীবী সেটা বললো। বিষয়টিকে উপেক্ষা করে আমাকে রিমান্ডে দিলো। রিমান্ডে ৭ দিন থাকার কথা, ৬ দিনের মাথায় আমাকে, প্রথমে কোর্ট প্রাঙ্গণে গেলাম। কিন্তু আমি কিন্তু কোর্টে যাইনি। তাদের গাড়ি করে সেখান থেকে কেরানীগঞ্জে নিয়ে গেলো।

সো আপনাকে যে বললো, তুমি চুপ করো, কোন অসুবিধা হবে না। আপনি কি খুব সোচ্চার ছিলেন সরকারের বিরুদ্ধে? আপনার কি সরকার বিরোধী কোন অবস্থান ছিলো?- অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে প্রখ্যাত এই ফটোসাংবাদিক বলেন, আমি বহু বছর ধরে সাংবাদিকতা করি, এরশাদ আমলে করেছি, বিএনপি আমলে করেছি, এই আমলে করেছি এবং প্রত্যেক সময় আমার যেখানে মনে হয়েছে অন্যায় হয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। সেটা আমি এখনও বলি।

গ্রেপ্তারের প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তখন ছাত্র আন্দোলনের সময় যেটা বলেছি সব্বাই জানে। আল জাজিরা আমাকে প্রশ্ন করেছিলো যে, নিরাপদ সড়ক আন্দালন নিয়ে এত বড় কিছু হলো কেন? এর পেছনে আরও কিছু আছে কি না? তখন উত্তরে আমি বলেছিলাম, সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মধ্যে একটা ক্ষোভ রয়েছে, আক্ষেপ রয়েছে সেটার বহিঃপ্রকাশ এটা। যেখানে মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে এবং চলমান অবস্থায় যা যা হচ্ছে, ব্যাংক লুটের কথা বলেছি, গুম হচ্ছে সেগুলো বলেছি। অনিয়ম যেগুলো হচ্ছে সেগুলো বলেছি। এটাও বলেছি, এটাতো নির্বাচিত সরকার না। এই কথাগুলি সবাই জানে ঠিকই, সবাই হয়তো বলে না। ওইখানে আন্তর্জাতিক মহলে বলাটা নিশ্চয় আমার জন্য বড় জোর।

তারপর অবশ্য তারা বলেছে, সেটার জন্য আমাকে ধরা হয়নি। কিন্তু যে পুলিশ অফিসার আমাকে ধরেছে তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে, আল জাজিরার সাক্ষাতকারের পর আমাকে ধরার পরে।
দীর্ঘ ওই টকশোতে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারকে হটানো, তারপর বিভিন্ন সরকারের সময়কার চিত্র তুলে ধরেছেন। পরবর্তী সরকারগুলোর কর্মকান্ড ও চরিত্র নিয়ে টাইম টেলিভিশনের টকশোতে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading