বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক, বিশ্ব রাজনীতির অবিসংবাদিত নেতা, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজ ৯৯তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারের রোজনামচায় লিখেছিলেন, ‘আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই। বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটা উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস! দেখে হাসলাম। ওই জন্মদিনে সহবন্দীরা তাঁকে ফুল দিয়েছিলেন, কারাগারে কেক নিয়ে এসেছিলেন বেগম মুজিব আর তাঁদের ছেলেমেয়েরা। ছোট্ট রাসেল তাঁর বাবাকে ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন। ছোট বেলায় মা-বাবা আদর করে বঙ্গবন্ধুকে খোকা বলে ডাকতেন। তিনিও তার মা-বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। কারাগারের রোজনামচায় তিনি লিখেছেন, ‘আমার ওপর আমার মা-বাবার টান যে কত বেশি সে কথা কাহাকেও বোঝাতে পারব না। তারা আমাকে ‘খোকা’ বলে ডাকেন। মনে হয় আজও আমি তাদের ছোট্ট খোকাটি। পারলে কোলে করেই শুয়ে থাকি। এই বয়সেও আমি আমার মা-বাবার গলা ধরে আদর করি।” খোকার শৈশবকাল কাটে টুঙ্গিপাড়ায়। অল্প বয়স থেকেই তার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক প্রতিভার বিকাশ প্রকাশিত হয়। অন্যায়কে প্রতিবাদ ও রুখে দেওয়া তার স্বভাবেই দেখা যায়। ১৯২৭ সাল তখনও ব্রিটিশ শাসকের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে কারাভোগ করতে হয় তাকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান দিয়ে হরতাল করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হলেন। গোয়েন্দারা মুচলেকার বিনিময়ে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব করত তাঁকে। তিনি বলতেন, তিনি মৃত্যুবরণ করবেন, তবু বাংলার মানুষের মুক্তির প্রশ্নে আপস করবেন না। বারবার নিজের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছিলেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আপস করেননি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর ফাঁসি হতে পারত। তাঁকে গুলি করে মারার ষড়যন্ত্রও হয়েছিল। একাত্তর সালে পাকিস্তানের কারাগারে তাঁর সেলের পাশে তাঁর জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। মৃত্যুকে তিনি ভয় পাননি। বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলাদেশ আমার দেশ।’ বাঙালীর অধিকার আদায়ের দাবীতে পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসনামলে প্রায় বারো বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে ছাত্র নেতাদের দ্বারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। রাজনীতিবিদ বাষট্টির ছাত্রনেতা কাজী আরেফ আহাম্মেদ তার বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র বইতে বলেছেন- ‘১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব কর্তৃক ছয় দফা পেশ করা হয়। এই ছয় দফাকে কেন্দ্র করে শতাব্দীর সর্বপ্রথম বাঙালি জাতির সর্ববৃহৎ ঐক্য গড়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সৃষ্টি, লালন এবং বিজয়ের মুখোমুখি নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব শেখ মুজিবই দিয়েছিলেন। বাঙালির মুক্তি আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ পথযাত্রায় বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের অবদান ছিল অতুলনীয়।’ ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর জনগণের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা দেন আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭১ সালের সাতই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাঁর ডাকে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা বাংলা। ২৫ মার্চ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আরো বলেছিলেন- ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগনকে আহবান জানাইতেছি যে,যে যেখানে আছো,যাহার যা কিছু আছে,তাই নিয়ে রুখে দাড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও” । বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতিমান ব্যক্তি ও মিডিয়া তার সম্পর্কে অভিহিত করেছেন। ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তার ব্যক্তিত্ব ও নির্ভীকতা হিমালয়ের মতো। এভাবেই তার মাধ্যমে আমি হিমালয়কে দেখেছি।’ প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের মতে, ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব।’ ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বলেছে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না।’ ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলেছিল, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লাখ লাখ লোক ক্রস ধারণ করে তাকে স্মরণ করছে। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’ নিউজউইকে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেওয়া হয়, ‘পয়েট অব পলিটিকস বলে’। ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা’। জাপানি মুক্তি ফুকিউরা আজও বাঙালি দেখলে বলে বেড়ান, ‘তুমি বাংলার লোক? আমি কিন্তু তোমাদের জয় বাংলা দেখেছি। শেখ মুজিব দেখেছি। জানো এশিয়ায় তোমাদের শেখ মুজিবের মতো সিংহহৃদয় নেতার জন্ম হবে না বহুকাল।’ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, আমরা প্রায়ই বিভিন্ন সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, এটা একটি বিরল সম্মান যে, কোনো জাতির জনকের সাক্ষাৎ পাওয়া, আমি সে সাক্ষাৎ পেয়েছি; আমি শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ পেয়েছি। সেই জাতির পিতাকে সপরিবারে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করে সমাহিত করেছিল গোপালগঞ্জের নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায়। তারা ভেবেছিল এভাবে বাঙালি জাতিকে নিঃশেষ করা সম্ভব হবে। কিন্তু সেই টুঙ্গিপাড়া থেকে দুর্জয় বাঙালিকে জাতির পিতা এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগাচ্ছেন এবং যুগে যুগে প্রেরণা জুগিয়ে যাবেন । ————————#———————-
কাজী সালমা সুলতানা
লেখক এবং গণমাধ্যম কর্মী ।

 
 
 
 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading