বছর দুয়েক আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার বাধ্য হয়ে নিজের পরিবারের সদস্য কারা বা কত বড় গন্ডির পরিবার তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কেন তিনি সেই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন? সেটা না বললেও জনমানুষের কাছে নিশ্চয়ই বিষয়টি পরিষ্কার । কেননা শেখ পরিবারের নাম ভাঙিয়ে কত কিছুই না ঘটে! সুতরাং ধারণা করি সেই অবস্থান থেকেই মাননীয় শেখ হাসিনা তার নিজের পরিবারের গন্ডির কথা বলেছিলেন। ওনার কথা অনুযায়ী ওনার পরিবারের গন্ডি বেশি বড় তো নয়ই বরং বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষীতে একেবারেই ক্ষুদ্র । এই পরিবার সংজ্ঞার কথায় কেন বললাম, সেই কথায় একটু পরে আসি।

সাম্প্রতিক কালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জার্মানির মিউনিখে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আছেন। জার্মানির প্রখ্যাত রেডিও ডয়েচে ভেলের সাথে প্রধানমন্ত্রীর একটি সাক্ষাত্কার প্রকাশিত হয়েছে। সেই সাক্ষাত্কারে ডয়েচে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল এবং এশিয়া বিভিগেথ প্রধান দেবারতি গুহ কে  প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টতই জানিয়েছেন, ” আগামীতে তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে চান না “।  এক মাস আগেই চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা।  উনার সাক্ষাত্কারের ভাষ্যনুযায়ী , একটা সময়ে এসে সবারই বিরতি নেওয়া উচিত এবং তিনি আরো বলেন আগামীতে তরুণ প্রজন্মের জন্য জায়গা করে দিতে চান । বলতেই হয়, এটা একটা প্রধানমন্ত্রীর মতোই বক্তব্য । এখানে একটি পৃথিবী বিখ্যাত উদহারণ দেই। দীর্ঘ টানা ২৭ বছর জেল খেটে সাউথ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা দুবার দেশের প্রধান নির্বাচীত হয়েছিলেন। তিনি চাইলেই তৃতীয়বার দেশের প্রধান হওয়ার জন্য কনটেস্ট করতে পারতেন এবং শতভাগ হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। না , তিনি তা করেন নি। বরং নেলসন ম্যান্ডেলা বিদায় নিয়েছিলেন। বিদায়ের সময় পৃথিবী ময় একটি বিখ্যাত কথা প্রচলিত হয়েছিলো নেলসন ম্যান্ডেলা কে নিয়ে, ” হি ইজ্ ফর হিজ্ টাইম” । এখন সবারই জানা নেলসন ম্যান্ডেলা কেবলমাত্র সাউথ আফ্রিকার নেতাই নন, উনি পৃথিবীর সকল নেতাদের একজন বিখ্যাত উদহারণ ।

উপরের উদহারণটি দেওয়ার কারণটি বলি। এশিয়ান কন্টিনেন্টাল এ যে ধরনের গণতন্ত্রের চর্চা হয় , সেখানে আমাদের নেতাদের বিদায় নেওয়ার উদহারণ খুবই কম। এশীয় দেশগুলোতে দু-একটি উদহারণ পাওয়া যায় বটে তবে সেই চর্চা আমাদের দেশে মোটেও নেই।  তার মূলে কারণ বিভিন্ন নিহিত আছে। এর একটি প্রধান কারণ হলো পরিবারতন্ত্র রাজনীতি । আর এই পরিবারতন্ত্র রাজনীতির চর্চা বিশেষ করে আমাদের দেশে ভীষণভাবে চর্চিত । ভিন্নভাবে বলা যায় এই পরিবারতন্র রাজনীতি আমাদের দেশের কনটেন্ট এ প্রয়োজনেই রয়ে গেছে। যেহেতু আমাদের দেশে রাজনৈতিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা সেভাবে গড়ে উঠেনি , বা আমরা গড়তে পারিনি, তাই বলাই যায় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বৃহত্তর স্বার্থের প্রয়োজনের তাগিদেই এই পরিবারতন্র রাজনীতি । উদহারণ অনেক দেওয়া যাবে , সেই দিকে যাচ্ছি না, কেন ? তবে এ কথা জোর গলায় বলা যায় এই পরিবারতন্র রাজনীতি আমাদের আরো দীর্ঘদিন দেখতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এর বিপরীতে অবস্থান করেও বলছি , এই পরিবারতন্র রাজনীতির অবসান আমাদের দেশে হতে আরো বহু দূর।

একটু লক্ষ্য করে দেখুন, মনে পরে কি ২০০৮ সালের পরে কোনো একক্ষণে ( দিনটি আমার সঠিক মনে নেই ) বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি রাজনীতি থেকে (২০০৮ সালের সরকারের পরে ) বিদায় নিবেন। অথচ আমরা দেখলাম তিনি কথা রখেন নি বা সঠিক বিশ্লষণ করলে বলা যায়, তিনি কথা রাখতে পারে নি। তিনি কথা রাখতে পারেন নি, আমার এই বিশ্লষণ কে কিভাবে নেবেন জানিনা । তবে আমি মনে করি তিনি মন থেকে চেয়েও রাখতে পারেন নি। কেননা , একবার  ভাবুন তো, তিনি কার হাতে আওয়ামী লীগের মত দলের দায়িত্ব প্রদান করতেন ? কে সেই জন আওয়ামী লীগ কে পরিচালনা করতে পারতো ? সকলের নিশ্চয়ই মনে আছে, ৮০ দশকে মাননীয় শেখ হাসিনা কে এনেই আওয়ামী লীগ কে সংগঠিত রাখতে দল বাধ্য হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর পরিবার ব্যতিরেকে এই মহা দলটি পূর্বে কতভাবে টুকরো হয়েছিলো ? নিশ্চয়ই সবার মনে থাকার কথা। সুতরাং ছোট্ট করে বলাই যায় বর্তমানে দেশের গণতান্ত্রিক কনটেস্ট এ আওয়ামী লীগের মত দলকেও পরিবারতন্রের উপরেই ভরসা রাখা ছাড়া উপায় নেই। এখানে বিনি প্রয়োজনে একথাও বলে রাখি , দেশের আরেক বৃহত্তর দল বিএনপি কেও এই একি পথে দীর্ঘদিন হাটতে হবে বা উপায় নেই। বেশি বিশ্লষণে না গিয়েও বলতে পারি, এই দেশকে এই পরিবারতন্রের রাজনীতি আরো দীর্ঘদিন হজম করতেই হবে।

যদি ধরেই নেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার সত্যি সত্যি বিদায় নিবেন। আমি ওনার কথায় বিশ্বাস রাখতেই চাই। প্রশ্ন উঠবে , ভবিষ্যতে এই মহা আওয়ামী লীগ কে উনি কার হাতে দায়িত্ব দিবেন। একটু দেখার চেষ্টা করি কে কে সত্যি আছেন , এই দলের দায়িত্ব নেবার মত। শেখ হাসিনার নিজের দুই সন্তান, ” জয় এবং পুতুল ” অন্যদিকে শেখ রেহানার দুই সন্তান,” টিউলিপ এবং ববি ” । এই কয়জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে মাননীয় শেখ হাসিনার দেওয়া পরিবার ফর্মুলা অনুযায়ী ।

এদের মধ্যে শেখ রেহানা , প্রথমত তিনি কোনো দিনই রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না এবং বর্তমানেও নেই। শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ, তিনি ব্রিটিশ নাগরিক এবং ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সদস্য । অন্যজন ববি , তিনিও কখনো বাংলাদেশের রাজনীতির ধারে কাছে নেই এবং ব্রিটেনের নাগরিক । সুতরাং বলাই যায় এদের দ্বারা আওয়ামী লীগ চলবে না। শেখ হাসিনার কন্যা পুতুল, তিনিও রাজনীতির সাথে জড়িত নন। ওবে তিনি অর্টিজম নিয়ে ভালো কাজে জড়িত আছেন। ওনার পুত্র জয়, হ্যাঁ তিনি আওয়ামী লীগের একজন সদস্য । আমেরিকা প্রবাসী এবং আমেরিকান গিন্নি নিয়ে তিনি কতটুকুন এই দেশের রাজনীতির সাথে মানিয়ে নিতে পারবেন , তা বড় প্রশ্ন বটে। যদিও তিনি এখন দলকে নানান ভাবে পরামর্শ বা বুদ্ধি জোগান দিয়ে থাকেন। তবে নে রাখা ভালো যে, দল এখন ক্ষমতায় । দল যদি কখনো ক্ষমতার বাহিরে যায়, তখন সময় কথা বলবে। ক্ষমতার বাহিরে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার মত ক্ষমতা জয়ের আছে কিনা ? সেটা সময় না আসলে অগ্রিম না বলাই ভালো। তাহলে পরিবারের যে জন সত্যি শেখ হাসিনার পরিবর্তে দলের সর্বোচ্চ আসনে বসে নেতৃত্ব দিতে পারবেন বলে আপাতত মনে হচ্ছে, তিনি হয়তো বা শেখ রেহানা।

হ্যাঁ  শেখ রেহানার বয়স দলকে পরিচালনার জন্য অবশ্যই সার্পোট করে। তবে শেখ রেহানা কে অবশ্যই আগামী পাঁচ বছর বোনের সাথে সার্বক্ষণিক কাছে থেকে এবং দলের জন্য কাজ করে যাওয়া ছাড়া ভিন্ন পথ নেই। শেখ হাসিনা নিজে যে ধরনের নেতা বা ওনার চিন্তাধারা বুঝা বড়ই মুশকিল । কেননা উনি ইতিমধ্যেই অনেকবারই বড় বড় ঝুকি নিয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। প্রায় ক্ষেত্রেই কাজে এসেছে বটে। তবে মনে রাখা ভালো , সেই সকল ঝুকি উনি নিজের মত করে গুছিয়ে  নিতে পেরেছেন, নিজের দক্ষতায় । তবে বড় ঝুকি অন্যের কাঁধে তুলে দিলে , সেই কাঁধ ভার বহন করতে পারবে কিনা ? বিবেচনায় রাখা ভালো।

লেখার শেষে বলি, ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন যে , শেখ হাসিনা এবার স্পষ্টভাবেই বলেছেন , তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। এখানে কথার একটি দক্ষতা পাওয়া যায় । ধারণা থেকে বলছি, তিনি নিজেও জানেন আওয়ামী লীগের মত এত বড় দলের ভার কাউকেই বর্তমানে দেওয়ার মত নেই। সেটা বাহিরের কেউ তো নয়ই , এমনকি উনার পরিবারেরও কেউ না। তাই অগ্রিম বলা যায়, শেখ হাসিনা আরো দীর্ঘদিন দলের দায়িত্ব নিজের হাতেই রাখবেন , যতদিন না পরিবার থেকে কাউকে তৈরি করতে পারবেন। হয়তো পরের টার্মে যদি ক্ষমতায় আসেন, সেখানে প্রধানমন্ত্রীত্ব ভিন্ন কাউকে দায়িত্ব দিবেন, তবে নাইটাই, প্রয়োজনেই নিজের হাতেই রাখবেন। উপায়ই বা কি আছে? দলকে তো আর সেই পূর্বের মত খন্ডবিখণ্ড হতে দিতে পারেন না।  এখানেই আমাদের মত উন্নয়নশীল  দেশগুলোর যত ঝামেলা। সঠিক গণতন্ত্রের চর্চার অভাবে ঘি রাখার ভান্ডো বা পাত্রের ভীষণ অভাব। শুধু আশা করবো কোনো এক সময়ে এই পাত্রের কোনো অভাব হবে না। জয় হোক গণতন্ত্রের ।

20190210_195317

বুলবুল তালুকদার
সহকারী সম্পাদক, শুদ্ধস্বর ডটকম

 

Von meinem Samsung Galaxy Smartphone gesendet.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading