ডাঃ অর্জুন দে : নব্বই এর দশকের গোড়ার দিকের কথা। আমরা ফার্স্ট প্রফ পরীক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ সমাপনী পরীক্ষা। মেডিকেল ছাত্রের জীবনে মহা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই ধাপের পরই রোগীর সাথে হাতে কলমে প্রকৃত ডাক্তারি শিক্ষা শুরু!
এনাটমি বিভাগের প্রধান আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। শুনেছি ছাত্র জীবনে অনেক বিষয়ে অনার্স পাওয়া ছাত্র ছিলেন। সেই আমলের বিবেচনায় এনাটমির শিক্ষক হওয়া ছিল অতি সম্মানের ব্যাপার, তাই হয়তো তিনিও এসেছিলেন এই বিষয়ে। স্যার আমাদের বন্ধু কমল এর আপন মামা। আমরা জানতাম এনাটমি তে যদি একজনও পাশ করে, কমল ছাড়া আর কে?
পরীক্ষা হয়ে গেল, এনাটমি আর ফিজিওলজি, সাথে ছোট ছোট শাখা, যেমন হিস্টোলোজি, বায়োকেমিস্ট্রি ইত্যাদি বিষয় সহ। মেডিকেল জীবনের প্রথম বৃহৎ পরীক্ষা শেষ, এ যেন মাথার উপর থেকে কয়েক মন ওজনের ভার নামলো।
ঘোরের মধ্যেই কেটে গেল কয়েকটা সপ্তাহ। এবার আবার টেনশন শুরু, নিদ্রা দেবী বিদায় নিয়েছে দুচোখ থেকে, ঘুমালেও স্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায়। স্বপ্ন তো নয় দুঃস্বপ্ন, শুধু ফেল এর ছবি!
এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ফল প্রকাশের দিন। সাত সকালে নাওয়া সেরে, খাওয়া না সেরে (!) ক্যাম্পাসে হাজির হয়ে গেলাম। প্রতি মুহূর্তেই মনে হল, এই বুঝি পিওন সাহেব রেজাল্ট এর কাগজ নিয়ে বের হবে। আমাদের ‘সময় যেন কাটে না’।
শেষ পর্যন্ত দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, হঠাৎ কোলাহল, জটলা, রেজাল্ট বের হয়েছে! ভয়ে, টেনশনে, উত্তেজনায় নোটিস বোর্ডে যেতেই পারছি না, নির্ঘাত ফেল। শেষমেশ রেজাল্ট পেলাম, একি, আমি উভয় বিষয়ে পাশ!
উত্তেজনার তপ্ত পারদ যখন চকিতে শীতল হয়ে পড়ল, হেসেছি না কেঁদেছি মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, একজন নিশ্চিত হাসছে না। সে আমাদের কমল! হৈ হল্লা যখন কমে আসলো, আবিষ্কার করলাম, একটু দূরে বিনয়ী বন্ধুটি চুপচাপ বসে। মুখে রাজ্যের অন্ধকার, লাল টকটকে দুটো চোখ। ততক্ষণে বাজারে রটে গেছে, ও মামার হাতে এনাটমি পাশ করে নি!
কমল জানাল, পরীক্ষা একটু খারাপ হয়েছে বটে, তবে ফল এতটা খারাপ কখনও ভাবনায় ছিলনা ওর। তাছাড়া মুখে না বললেও এ টুকু তো বোঝা যায়, বিভাগীয় প্রধান, প্রধান পরীক্ষক মামার উপস্থিতি তাকে একটু আত্মবিশ্বাস তো দিয়েছিল। সবাই মিলে তাকে সান্ত্বনা দিলাম বটে, তবে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা তেমন জানা ছিলনা।
রাতেই কমল মামার বাসায় গেল। ওকে দেখে মামা বললেন, ‘কি ভাগ্নে খালি হাতে কেন? এত বড় পাশের পর’! লজ্জায়, অপমানে, শোকে বিহ্বল কমল কিছুই বলতে পারলনা, বুঝতেও কষ্ট হচ্ছিল মামা কি বলতে চাইছেন। চারপাশের বাতাস আরও ভারি হতে না দিয়ে এক পর্যায়ে বলে উঠল মিন মিন করে, ‘মামা আমি তো এনাটমি পাশ করি নি’।
কমলের কথা যেন মামার বিশ্বাস হয়নি। তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। বিড় বিড় করে বললেন, কিন্তু আমি যে দেখলাম কয়েকজন কমল পাশ করেছে। তুই সেখানে নেই! উল্লেখ্য তৎকালীন চট্টগ্রাম আর সিলেট মেডিকেল কলেজ মিলে আমাদের ব্যাচ এ কয়েকজন ‘কমল’ ছিল। তিনি বুঝলেন এদের অনেকে পাশ করলেও কমল সেখানে নেই।
খানিক পরেই স্বভাবসুলভ গুরুগম্ভীর প্রকাশভঙ্গি তে ফিরে গেলেন মামা, বললেন, ‘ভালো করে পড়া শোনা করো, পাশ করতে হলে তো আর কোন শর্ট কাট নেই’।
পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার বেদনায় আমাদের কমল যেন নীল-কমল হয়ে উঠল। নীল কমলের জল ভরা লাল চোখ দুটো যেন হয়ে উঠল দুটো সাগর।
সাগরের লোনা জলে ভাসতে ভাসতে আমাদের কমল ফিরে এল হোস্টেলে, আমাদের মাঝে।
পুরো ঘটনায় অধ্যাপক মামার উপর আমাদের কারও এতটুকু রাগ-অভিমান হয়নি। বরং মনে পড়লো সেই পুরোনো কবিতার লাইন, ‘আজ হতে চির উন্নত হল, শিক্ষা গুরুর শির’!
পিছন ফিরে ভাবি, এমন বিরল প্রজাতির শিক্ষক নিঃসন্দেহে কিছু দিনের মধ্যে জাদুঘরে সংরক্ষণে চলে যাবে, পরম যত্নে। আর আমরা স্মৃতি রোমন্থন করব অনাগত দিনগুলিতে, প্রজন্মের কাছে।
দ্র. বাস্তব ঘটনার সাথে কিঞ্চিৎ কল্পনার মিশেলে গল্পটা রচিত। চরিত্রের সাথে কারও মিল-অমিল-সংঘর্ষ কেবলই কাকতলীয় মাত্র।
ডাঃ অর্জুন দেঃ চিকিৎসক এবং লেখক।