
আদর্শ রাষ্ট্র কি ? এর বিশেষায়িত কোনো সংজ্ঞা নাই। প্রতিটি রাষ্ট্রের তার নিজস্বতায় আদর্শ রাষ্ট্র হয়ে থাকে। কেননা এক দেশের জন্য যা আদর্শ হবে তা ভিন্ন দেশের জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজেস্ব কৃষ্টি কালচার এর উপরেই আদর্শ রাষ্ট্র হয়ে থাকে। বাংলাদেশ কেমন রাষ্ট্র হলে আদর্শ রাষ্ট্র হবে? সেটা অনেক বিশদ আলোচনার বিষয়, আবার সহজ ভাবে বলা যায় জনমানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেই অনেকাংশেই আদর্শ রাষ্ট্রের রুপ নেওয়া সহজ। মৌলিক অধিকার কি ? এটা নিয়ে মনে হয় তেমন জটিলতা নাই। যাকগে আমরা আদর্শ রাষ্ট্র কিনা, সেটা জনমানুষই ভালো বলতে পারবেন।
আজকে ১০ ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ৪৭ তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস । একজন অবিসংবাদী মহান নেতা, যার অনুপস্থিতি স্বতেও যার নামেই মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়ে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ । এই মহান ব্যক্তিত্বের কথা বলে শেষ হবার নয়। সেটা আমাদের ইতিহাসবিদ, সমাজচিন্তাবিদরা অনেক লিখেছেন এবং ভবিষ্যতে আরো লিখবেন নিশ্চয়ই । তবে আজকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে ইতিহাসে পাওয়া কিছু বিষয়ের বিশেষ কিছু বলার উদ্দেশ্যেই আজকের লেখা।
ইতিহাস থেকে যতটুকু পাই, বঙ্গবন্ধু কে ভারতও একটি বিশেষ বিমান দিতে চেয়েছিলেন, স্বদেশে ফেরার জন্য । কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত বিশেষ কিছু চিন্তাভাবনা থেকেই ভারতের বিমানে না চড়ে ব্রিটিশ বিশেষ বিমানে প্রত্যাবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধু যুক্তরাজ্যেই এক ছোট্ট ভাসনে আমেরিকার জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন এবং চিন সমন্বয়ে একটি কথাও বলেন নি। লক্ষ্যণীয় যুদ্ধে আমেরিকার জনগণের আমাদের প্রতি সমর্থন ছিলো , কিন্তু আমেরিকার সরকারের ভূমিকা ছিলো ভিন্ন । ঠিক চিন সরকারেরও ভূমিকাও ছিলো ভিন্ন । তিনি দিল্লি নেমেই মহামতি ইন্দিরা গান্ধীর নিকট থেকে যে প্রতিশ্রুতি নিছিলেন, তা ছিলো কবে এবং কখন ভারত তার সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করে নিবে। এই বিষয়টি যে একটি স্বাধীন দেশের জন্য কত বড় বিষয় ছিলো , তা কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর মত নেতার পক্ষেই ভাবা সম্ভব ছিলো। ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেই ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করা হবে, হয়েছিলোও।
সদ্য স্বাধীন দেশ নানাবিধ সমস্যায় বিপর্যস্ত। অন্যদিকে আবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি পাওয়া । সবদিক বিবেচনায় রেখেই বঙ্গবন্ধু যখন দেশকে একটি পথ প্ররিক্রমা দেওয়ার চেষ্টায় আছেন, তখনই সেই ভারতই বঙ্গবন্ধুকে একপ্রকার চাপ দিয়েই একটি চুক্তি করিয়ে নেয়। তার মেয়াদকাল ছিলো ২৫ বছর , যেটাকে বিরোধীরা গোলামি চুক্তি বলে ফয়দা নেবার চেষ্টা করেই গেছে।। শুনেছি সেই চুক্তি ভারত বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আজীবন কালের জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটা করেন নি। যাই হোক ১৯৭৫ এর ১৫ ই আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক জঘন্য ইতিহাস সৃষ্টি হয়, তা ছিলো বঙ্গবন্ধুর হত্যা । জনমানুষের মুখতো আর বন্ধ রাখা যায় না, নানান কথা প্রচার আছে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পিছনে ভারতের সহযোগিতা বা হাত ছিলো।
এখন বলবো একজন মাঠের মুক্তিযোদ্ধার কথা ( উনার নামটি এখানে উদ্ধৃত রাখলাম ) । ছোট্ট করে একটু পরিচয় বলতে , তিনি ছিলেন মাঠের একজন অস্রহাতের মুক্তিযোদ্ধা । বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী । ইতিহাসের অনেক কিছুর চাক্ষুষ সাক্ষী । নামটি বললাম না কারণ ওনার নিজের মুখের কথা এবং বিভিন্ন প্রমাণাদি সহ, ওনার কাছ থেকে সত্য ইতিহাস নিয়ে আগামী বছরখানেকের মধ্যে একটি ইতিহাসের বই লেখার চেষ্টায় আছি। অনেক ডকুমেন্ট পেয়েছি, আরো অনেক কাজ করতে হবে, দেখা যাক কতদূর যেতে পারি। যা হোক, সেই মাঠের মুক্তিযোদ্ধার দেখা বা জানা, ওনার নিজের মুখের একটি কথা বলি, জেনারেল জিয়াকেউ ভারত এক সময় সেই ( গোলামি চুক্তি) ২৫ বছরের চুক্তি রিফ্রেইস বা রিনিইউ করার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিলো। জেনারেল জিয়া সেটা করেন নি। যা হোক পরবর্তীতে এক সময় সামরিক কু এর মাধ্যমেই ১৯৮১ এর ৩০ এ মে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।
দেশে একটি জাতীয় নির্বাচন ইতিমধ্যেই সমাপ্তি হয়ে নতুন সরকারের নতুন মন্ত্রীসভাও ঘোষিত হয়েছে। বেশ চমকপ্রদ মন্ত্রীসভা বটে। যাক সেটা আজকের বিষয় নয়। যা বলতে চাচ্ছি, সেটা হলো এবারের নির্বাচনে ভারতের ভূমিকার কথা। যে বিষয়টি এবারের নির্বাচনে একেবারেই ধামাচাপা পরে গেছে। ২০১৪ এর ৫ ই জানুয়ারির নির্বাচনে যেখানে ভারত তার প্রতিনিধি সরাসরি পাঠিয়ে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছিলো , সেই ভারতই এবারের নির্বাচনে একেবারেই নিশ্চুপ ছিলো !! মনে পরে কি , এবারের নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাহেব একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ভারত সফর করে এসেছিলো। ঠিক তার পরপরই বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল মিন্টু সাহেব একটি ছোটো পরিসরের প্রতিনিধি নিয়ে ভারত সফর করে আসে। বেশ ! তারপর থেকেই এবারের নির্বাচনে বরাবরের মত আর কোনো ভারত বিদ্বেষী একটি টুশব্দটিও হয় নি ! সেখানেই কেমন জানি সন্দিহান হতে হয়। বাংলাদেশের নির্বাচন, সেখানে ভারত নিয়ে কোনো কথা হবে না ! এটাই শত প্রশ্নের জন্ম দেয়। যা হোক ভারতের একটি বিখ্যাত পত্রিকার একটি ফিচার বাংলাদেশের পত্রিকায় নির্বাচনের পূর্বে অনুবাদ করে প্রকাশিত হয়েছিলো, যার হেড লাইন ছিলো ” হাসিনা না খালেদা ? বিপাকে ভারত ” ! সেই প্রতিবেদনের শেষের দুটো লাইন ছিলো , রিপোর্টারের বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের পর্যবক্ষেণ সম্পর্কে এক প্রশ্নে ভারতের একজন কূটনৈতিকের উত্তর ছিলো , ” আমরা তো সাড়া বছরই বাংলাদেশকে পর্যবক্ষেণে রাখি এবং সাথে একটি মুচকি হাসি ” ! সবই পরিষ্কার ।
লক্ষ্যণীয় যে, চিন সাধারণত যা কখনোই করে নাই বা করে না, এবার সেই চিন নির্বাচনের পরপরই রাষ্ট্রদূত কে দিয়ে শেখ হাসিনা কে ফুলের শুভেচ্ছা দিয়েছে ! আর একধাপ উপরে উঠে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী সাহেব স্বয়ং নিজে ফোন করে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছে, এগুলো পত্রিকার রিপোর্ট । বিপদের বার্তা এখানেই। এদের অতি আগ্রহই আমাদের কে ভাবিয়ে তুলে। আমেরিকা এখন অব্দি সেভাবে নাক গলায়নি বা বলা যায় চিন আর ভারতের সাথে পেরে উঠছে না বলেই মনে হচ্ছে। তবে আমেরিকা যে বিপদজনক হয়ে উঠবেই তাদের নিজেদের স্বার্থেই, সেটা বুঝতে বেশি বুদ্বিমান হওয়ার প্রয়োজন নাই। ওদের কার্যক্রমে মনে হয়, বাংলাদেশ যেন ওদের চোখে গরিবের বউ। সবাই ভাবি ভাবি ডাকতেছে, সামনে না কোনো বিপদের ঝড় আসে। শুধু আশা রাখতে চাই বঙ্গবন্ধু কন্যা তার দৃঢ় প্রত্যয় দিয়ে সব সামাল দিতে পারবেন।
উপরের কথাগুলো বলার উদ্দেশ্যে বলি। শেখ হাসিনা মন্ত্রী পরিষদ যেভাবে তৈরি করেছেন, তারুণ্য নির্ভর, বেশ সাহসী পদক্ষেপ বটে। তবে, এই মন্ত্রী পরিষদ এক বাক্যে বলা যায়, শেখ হাসিনার মুঠোয় বন্দি । অর্থাত্ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই পরিষদ একটি বাক্যেও উচ্চারণ করার ক্ষমতা রাখে না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় । যেখানে পুরোনো ঝানুরাই তেমন কিছু বলতে বা করতে পারতেন না !
আরো লক্ষ্যণীয় যে, সংসদে এরশাদের বিরোধী দল সেটা শেখ হাসিনার জন্য একেবারেই বালখিল্য বিষয় । কেননা গৃহপালিত বিরোধী দল! এটা কে বিরোধী দল বলা মানে সংসদের অপমান বটে। মনে পরে বিগত পাঁচ বছর শেখ হাসিনা সরকার ভারত সহ বিদেশের সাথে অনেকগুলো চুক্তি নিষ্পত্তি করেছিলো। এই গৃহপালিত বিরোধী দল সেই চুক্তিগুলো সমন্বয়ে কিছুই করার ক্ষমতা দেখাতে পারে নাই। আইন থাকা স্বতেও জনগণ কে কিছুই জানানো হয়নি। অথচ পা চাটা বিরোধী দল গত সংসদে সেটারও একটি প্রতিবাদ করতে পারে নি। এবার তো আরো বেহাল অবস্থা। সামনে যদি তেমন কোনো বৈদেশিক চুক্তি সমাপ্তি হয়, আমরা জনগণ যে আবারো ধোঁয়ার মাঝে থাকবো, সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় । সংসদে কার্যত বিরোধী দল যত দিন না হবে, ততদিন জনগণের কপালে খারাপিই আছে। আমরা সাধারণ জনগণ কেবল আশা করবো এই সরকার ভারত সহ কোনো দেশের সাথে এমন কোনো চুক্তি সম্পাদন করবেন না, যা জনগণ কে জানাতে সমস্যা থাকে। যখন জনগণ কে জানানো হয় না, তাতেই বুঝা যায় সেই সকল চুক্তিতে দেশের স্বার্থ বেশি পূরণ হয় না।
দেশের স্বার্থে শুধু বলবো, মিয়ানমার ঘটনার পর চিনের ব্যাপারে সরকার কে শতভাগ সতর্ক হওয়া প্রয়োজন । এদের অপ্রত্যাশিত শুভেচ্ছার ফুল থেকে কীট যেন নাকে ঢুকে না পরে। আর অন্যদিকে ভারতের কূটনৈতিকের মুচকি হাসি যেন আবার আমাদের গোলামির চুক্তির দিকে টেনে নিয়ে না যায় । শেষে রাস্তার বিরোধী দলকে শুধু বলবো, আমেরিকা যাদের বন্ধু হয় তাদের আর আলাদা শত্রুর প্রয়োজন হয় না। নিজেদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার পরিবর্তন করাই বেশি জরুরি ।
লেখার একেবারে শেষে বঙ্গবন্ধু কন্যা কে মত প্রকাশের অধিকার বলে বলবো , বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবসে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, দেশের এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে বেশি করে লিবারেল হবেন। জোর জবরদস্তি করে দীর্ঘদিন থাকা যাবে হয়তো, তবে এরও একদিন শেষ হতে বাধ্য । দেশের জনমানুষের মনের কথাও শোনার চেষ্টা করুণ। মনে থাকা ভালো, জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতার নেতা মুগাবেও তার জবরদস্তি থেকে অবশেষে তিন যুগ পরে পরিত্যক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনমানুষের হৃদয়ের মানুষ । আশা রাখতে চাই মাননীয় শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবে সেটা অর্জন করতে পারবেন, বঙ্গবন্ধুর স্বার্থে এবং সর্বোপরি দেশের স্বার্থে ।
বুলবুল তালুকদার
সহকারী সম্পাদক, শুদ্ধস্বর ডটকম