চিঠির খামটা খুলতেই পরিচিত সেই গন্ধটা নাকে এসে লাগলো অর্পিতার। নির্ঝরের কাছে থেকে যতবার চিঠি পেয়েছে ও ততবারই এই গন্ধটা মিশে ছিল চিঠির পাতায়। বেলী ফুলের ফ্লেভার। চিঠিতে প্রত্যেকবার ও এই পারফিউমটা ইউজ করতো। নীল কাগজে গোটা গোটা করে লেখা চিঠি। ওর লেখায় আলাদা রকম একধরণের মাদকতা আছে। খুব সুন্দর গুছিয়ে লিখতে পারে। বছর দুয়েক আগে জলপাইগুড়ির এক চা বাগানে আলাপ হয়েছিল ওর সাথে। শ্যামলা বর্ণের মাঝারি গড়নের ছেলেটির চোখে মুখে সব সময় কি নিঃসীম মায়া ই না লেগে থাকে। ওর দুজনেই ঘুরতে গেয়েছিল জলপাইগুড়িতে। প্রথম দেখাতেই তুই তুই সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। বেশ আলাপী ছেলে নির্ঝর। ঢাকার একটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। আর অর্পিতা কলকাতার যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। নির্ঝর ওর থেকে বয়সে দু’বছরের ছোট ছিল। কিন্তু বয়স বা ধর্ম কোনটাই ওদের বন্ধুত্বে অন্তরায় হতে পারেনি। নির্ঝর কেন যেন মোবাইল ফোন ইউজ করতো না। তাই ওদের যোগাযোগ চিঠির মাধ্যমেই হতো। প্রথম দিকে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই চিঠি লিখতো। এবারের চিঠিটা আসলো অনেক দেরীতে। প্রায় ৫ মাস পর। এই কয়েক মাস অনেক চেষ্টা করেও নিঝুমের কোন খবর পায়নি ও। খুব খেয়ালী ছেলে তো! কখন কি করে ঠিক নেই। যাইহোক চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করে অর্পিতা…

প্রিয় অপু,

আশা করি ভালোই আছিস। অনেকদিন তোকে চিঠি লেখা হয়নি। শেষবার যখন কোলকাতা থেকে আসলাম তারপর আর চিঠি লেখা হয়নি। এখন যখন চিঠি লিখছি তোকে সময় প্রায় মাঝরাত। ভাবলাম শেষ চিঠিটা তোকে লিখেই ফেলি। সিদ্ধার্ত মানে গৌতম বুদ্ধু যেমন এক কাকফাঁটা জোৎসনা রাতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গৃহত্যাগী হয়েছিল আমারও তেমনি এই প্রখর শীতের রাতে অবিরাম শিশির ঝরা দেখে পৃথিবী ছাড়ার ইচ্ছে হচ্ছে। আমি অনেক আগে থেকেই বিশ্বাস করতাম মৃত্যুই সকল সুন্দরের উৎস। আমি বরাবরই সুন্দরের পূজারী। তাই সব সময় সুন্দরেই মিশে থাকতে চাই। আমার সেই প্রেমিকার কথা মনে আছে তোর? যার কথা তোকে আমি বলেছিলাম চা বাগানের টিলার পাশে বসে? আরে সেই মেয়েটা যাকে ঈশ্বরের থেকে বেশি বিশ্বাস করতাম। সে ছিল অনিন্দ্য সুন্দর এক রমনী। প্রকৃতি তার সব রুপ ঢেলে দিয়েছিল তার মাঝে। আমি স্বার্থপরের মতোন তার মনকে ভালবাসার আগে তার রুপকেই ভালবেসে ফেলেছিলাম। পরে বুঝে ছিলাম তার রুপের থেকে তার মনের সৌন্দর্যটাই অনেক বেশি। চূড়ান্ত সুন্দরে মিশে যাবার ঝোক আমার সবসময়ের। তাই আজ সকল সৌন্দর্যের উৎস মৃত্যুতে মিশে যাচ্ছি। যাবার আগে তোকে না বলা কিছু কথা বলে যাওয়া উচিত। সুইসাইড নোটে তো মানুষ মৃত্যুর কারণ লিখে রাখে। আর আমি লিখে গেলাম জীবনের কথা। আমার জীবনে কোন কিছু না পাওয়া নেই। আমি খুব সুখী একটা জীবন যাপন করে গেলাম। নেই কোন আক্ষেপ জীবনে আমার। আমি পরজনমে বিশ্বাস করি না। যদি পরজনম থেকেও থাকে সেখানে আমার স্বর্গের প্রয়োজন নেই। আমি পৃথিবীতেই অসংখ্যবার স্বর্গসুখ অনুভব করেছি। যতবার প্রেমিকা কে চুমু খেয়েছি আমি ততবারই স্বর্গসুখ অনুভব করেছি। অর্পিতা বিশ্বাস কর হাতে হুইস্কির গ্লাস আর সাথে বেনসন সিগারেট….এর থেকে স্বর্গীয় মুহুর্ত আর হতেই পারে না। তোর সাথে যতবার ১৩ নং চৌরঙ্গী রোড এর সেই বাসায় এক সাথে নি শরীরে শুয়ে থেকেছি ততবারই আমি স্বর্গসুখ অনুভব করেছি। তাই পরজনমে আমার নরকবাসে কোন আপত্তি নাই। জীবন একটা চক্রের মতোন। ঘুরেফিরে সবকিছুই একই রকম। তাই আর ভাল লাগছিল না। মৃত্যুর নির্মোহ সুন্দরে নিজেকে বিলিয়ে দিলাম। বাইরে শিশির ঝরছে বৃষ্টির মতোন। তোকে চিঠি লেখা শেষ করে এখুনি কাজের ছেলেটার হাতে দিয়ে দেব তোকে পোষ্ট করতে। তুই যখন চিঠিটা পাবি তখন আমি আর পৃথিবীতে থাকবো না। সময়ের চক্রে পড়ে একদিন সবাই আমাকে ভুলে যাবে। পরজনম বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে আমার বিশ্বাস ওপারে আবার তোর সাথে দেখা হবে আমার নরকবাসে। কারণ আর যাই কিছু আলাদা হোক জীবনের পথ চলার ধরণ তোর আমার একই রকম ছিল। বিদায় নেয়ার শেষকালে এই আত্মতৃপ্তি নিয়ে যেতে পারছি যে আমি সত্যিকারের প্রেমিক ছিলাম….

”নির্ঝর

ঢাকা,বাংলাদেশ।

চিঠিটা পড়া শেষ হলে কিছুক্ষন চুপ করে থাকে অর্পিতা। তারপর একটা সিগারেট ধরায়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যালকনি থেকে ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ও একদিনের জন্য আস্তিক হতে চায়। আজ একবার সাদা শাড়ি পড়বে ও। হৃদয়ে ধারণ করে থাকবে একটি সুইসাইড নোট।

49183524_221208595465542_5255786252170428416_n

জাকওয়ান হুসাইন

 

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading