
ইউরোপ জুড়ে এখন ক্রিসমাসের আমেজ।বর্তমানে ইউরোপের যেকোনো দেশের যেকোনো শহরেই ক্রিসমাসের আমেজ লক্ষ্য করা যায় । প্রতিটি শহরেই সাঁঝ সাঁঝ ভাব, সাথে আছে বেশ রমরমা পরিবেশ। চারিদিকেই শহরে লোকে লোকার্নো । প্রতিটি শহরের দোকানপাট গুলো চকচকে ঝকঝকে, নানান রংয়ে সজ্জিত । ক্রিসমাসের জন্য দোকানগুলোতে আছে নানান ধরনের ক্রিসমাস সারপ্রাইজ, আছে বিভিন্ন ধরনের চমকপ্রদ প্রাইজ ( দামের দিক দিয়ে), অনেক ধরনের অ্যকশন প্রাইজ, যা কিনা প্রতিটি কাস্টমারের কেনার ক্ষম। প্রতিটি শহরেই কেনাকাটার দোকানপাট এর সাথে আছে অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশের নানান কফি হাউজ, রেস্টুরেন্ট এবং সুপার মার্কেট। সুপার মার্কেট গুলোতে আছে বাচ্চাদের জন্য খেলাধুলার নানান রকম ব্যবস্থা । এই সকল সুপার মার্কেটে পরিবার পরিজন, বাচ্চাকাচ্চা সহ সাড়াদিন কাঁটিয়ে দিলেও মনে হবে , আরো সময় কাঁটানো যায় । ক্রিসমাসের এই আমাজে হাতে তিনদিন ছুটি থাকায়, দুদিন সাল্জবুর্গ শহরে ছিলাম। এই শহরটি অস্ট্রিয়ায় পর্যটকের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় শহর। আজকে এই শহরের কিছু কথাই বলার চেষ্টা থাকবে।
সাল্জবুর্গ অস্ট্রিয়া প্রজাতন্ত্রের ৯ টি প্রদেশের মধ্যে একটি। এটি অস্ট্রিয়ার বৃহত্তম ভিয়েনা, গ্রার্জ, লিন্জ শহরের পরেই চতুর্থ স্থানে অবস্থিত। শহরটিতে প্রায় ২২৫ কিলোমিটার দীর্ঘের সালচ্ছাক ( Salzach) নদী, বহমান। শহরটির অপরুপা মনোরঞ্জন দৃশ্যের নদী আর পর্বতমালা দাড়া আবিষ্ট । সালচ্ছাক নদীটি শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই শহরের উত্তর-পশ্চিমে জার্মানির বর্ডারের “ফ্রাইলাসিং” শহর অবস্থিত । সাল্জবুর্গ ( জার্মানি শব্দ Salz= লবন, Burg=দূর্গ) । বুর্গ এর মূল উৎসগুলি লবন খনির, কখনো কখনো সোনার খনির উৎসও ছিলো। শহরটি ইউরোপের বৃহত্তম মধ্যযুগীয় দূর্গ। ১৭ শতকের দিকে শহরটি আর্চবিশপ “ভোল্ফ ডিটরিখ” ও তার উত্তরাধিকারিদের জন্য রাজকীয় বাসস্থানে সজ্জিত ছিলো। পৃথিবী বিখ্যাত মিউজিশিয়ান ও কম্পোনিস্ট ” ভোল্ভগাং আমাদেউস্ মোজার্ট ” এই শহরে ১৭৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এই কারণে এই শহরটি “মোজার্টস্টাড” (মোজার্ট শহর) নামে সুপরিচিত । সাল্জবুর্গ শহরটি ১৯৯৬ সাল থেকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে। শহরটি আয়তনে দীর্ঘ ৬৫,৬৮ কিলো স্কোয়ার মিটার। পহেলা জানুয়ারি ২০১৮ সালের হিসেবে ১৫৩,৩৭৭ অধিবাসীর বসবাস এই শহরে। ইউরোপের অস্ট্রিয়ায় আমার বসবাসের শহর লিন্জ থেকে মাত্র ১৩২ কিলোমিটার দূরুত্বের শহর। এই সাল্জবুর্গ শহরেই ৭০০ খ্রিঃ রোমানদের বসবাস ছিলো। এই শহরের সর্বোচ্চ পর্বতমালা নাম ” গ্রোর্সভেনেডিগার” যার উচ্চতা ৩,৬৭৪ মিটার। এই পর্বতমালাটি বছরের সব সময় প্রায় এক চতুর্থাংশ পিচ্ছিল বরফে ঢাকা থাকে।
সাল্জবুর্গ শহরটি ইউরোপের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রস্থল । শীতকালে এই শহরটি শীতকালীন খেলা বরফ স্কির জন্য বেশ প্রসিদ্ধ । অস্ট্রিয়ায় ফ্লাখাও, ভাগরাইন, সেন্ট জোহান এবং গাস্তাইনার টাল এই স্থান গুলো স্কির জন্য বিখ্যাত । অবশ্য গ্রীষ্মকালে এই স্থানগুলোই বিস্ময়কর ভাবে পর্বতারোহণের জন্য অনবদ্য হয়ে উঠে। এই শহরের ল্যান্ডমার্ক দূর্গ ” হোহে সাল্জবুর্গ ” দেখার জন্য বছরে হাজার হাজার পর্যটকের ভীড় থাকে। ঠিক একই ভাবে এই শহরের “হাউজ ডেয়ার নাটুওর” ( প্রাকৃতিক ঘর) , “মিরাবেল প্রাসাদ” পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান । ১৯২০ সাল থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ক্যাথিড্রালের সামনে প্রতিবছর এই শহরের ” ইয়াডারমান” খেলার সাথে ওপেন-এয়ার ফেস্টিভ্যাল এই শহরের ঐতিহ্য এবং বিশ্ববিখ্যাত ।এই শহরটি পৃথিবীর সকল দেশের পর্যটকদের জন্যেই কিছু না কিছু উপভোগ্যর আছে।
সাল্জবুর্গ শহর সমন্বয়ে বলতে গেলে ” ইউনিভার্সিটি মোজার্টিউম সাল্জবুর্গ ” সমন্বয়ে একটু বলতেই হয়।
১৮৪১ সালের ২২ সে এপ্রিল সাল্জবুর্গ শহরে এটি সঙ্গীত স্কুল হিসেবে গড়ে উঠে । মূলত এটি কম্পোনিস্ট মোজার্ট এর নামে ” ডোমফিয়ের্টেল অব মোজার্টিউম ” নামেই বেশি পরিচিত । এই ইউনিভার্সিটি রাষ্ট্রিয় মালিকানাধীন। এটির বর্তমান রেক্টর ( ভিসি) এলিজাবেথ গুটজাহর্ । ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১৮০৪ , কর্মচারীর সংখ্যা ৬৮৫ , অধ্যাপকের সংখ্যা ১০৮ এবং বার্ষিক বাজেট ৪১,৯ মিলিয়ন ইউরো ( ২০১০) ।এটার ওয়েভ সাইট http://www.uni-mozarteum.at ইউনিভার্সিটিতে তিনটি স্বাধীন সংস্থা আছে।
* সঙ্গীত, নাটক সম্পর্কিত বিষয় গুলোর জন্য একটি শিল্প একাডেমী।
* ইন্টারন্যাশনাল মোজার্টিউম ফাউন্ডেশন- কনসার্ট সংগঠক, মিউজিক কালেকশন এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট ।
* মোজার্ট অর্কেস্ট্রা সাল্জবুর্গ- সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা সাল্জবুর্গ ।
শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত সাল্জচ্ছাক নদীর দুই পাড়েই পাথরে ঘেরা এবং নদীর পাড় ঘেঁষে
দুই পাড়েই চমত্কার পিচঢালা রাস্তা যেখানে কেবল সাইকেল চলাচলের অনুমতি আছে, আর মানুষের জন্য হাঁটাহাঁটি বা দৌড়ানো বা বিভিন্ন ধরনের রোলারস্কেটিং এর জন্য চমত্কার পরিবেশ কেননা পিচঢালা রাস্তায় কয়েক মিটার পর পর সারি সারি গাছের সমারোহ যা কিনা পর্যটকদের সত্যি বেশ আকর্ষণ করে। এই নদীর উপরে শত বছরের পুরানো সেতু সহ মোট ১৩ টি সেতু আছে। ১৩ টি সেতুর মধ্যে কেবল একটি সেতু যা কিনা পথচারী এবং সাইক্লিস্টদের উদ্দেশ্যেই করা। ৪ টি সেতু আছে যা কিনা মোটরযান ট্র্যাফিকের জন্য, তার মধ্যেতিনটি সেতু শহরের অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের জন্য । একটি সেতু আছে যা রেল চলাচলের জন্য ডিজাইন করা। এই সকল সেতুতে দাঁড়িয়েই সমগ্র সাল্জবুর্গ শহর বেশ উপভোগ্য ।
সাল্জবুর্গ শহরের দশটি শীর্ষ আকর্ষণীয় স্থানের মধ্যে আজকে কেবল একটি দূর্গের কথাই বলবো। ইতিপূর্বেই বলেছি দূর্গটির নাম ” হোহেনসাল্জবুর্গ”। উচ্চতম এই দৃর্গটি সেন্ট্রাল ইউরোপের সর্বাধিক বৃহত্তম সংরক্ষিত দূর্গ।এই দূর্গটি প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটকদের আকর্ষণ করে। আর্চবিশব গেহার্ড ১০৭৭ সালে এই দূর্গটি এমনভাবে নির্মাণ করে যেন, দূর্গ থেকে সমগ্র সাল্জবুর্গ শহরের প্যানোরামাটি দর্শন করা যায়। পরবর্তীতে গেহার্ড এর উত্তরসূরিরা এই দূর্গের উন্নয়ন ঘটান এবং সর্বশেষে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে, আর্চবিশব লিওনার্হার ভন কেট্সচাচের অধীনে দূর্গটি তার বর্তমান রুপ পায়। দূর্গটি দর্শনের জন্য সাড়া বছর খোলা থাকে। ১৮৯২ সাল থেকে কেবলমাত্র পায়ে হেটে নয়, এই দূর্গে উঠতে একটি রেল লিফ্টের বন্দবস্থ আছে।
পুরো সাল্জবুর্গ সমন্বয়ে লিখতে হলে মহা কাব্য লিখতে হবে। লেখার শেষে আজকে সাল্জবুর্গ শহরের বর্তমানের ক্রিসমাস মার্কেটর ছোট্ট একটি বিবরণী দিয়ে শেষ করবো।
শহরের মাঝখানে তীর্থযাত্রার ফিল্ছমোজ গির্জার পাশে চারিদিকে এই ডিসেম্বর মাস জুরে ( কেবল ডিসেম্বরেই এই মার্কেট) ক্রিসমাস মার্কেট। এই মার্কেট কেবলমাত্র ক্রিসমাস কে সামনে রেখেই মাস জুরে বসে। এই ক্রিসমাস মার্কেটে সুগন্ধি থেকে শরু করে মশলা, মোমবাতি থেকে ওয়াইন বা হাতে তৈরি নানান ধরনের কারুকাজের মাফলার, টুপি, মোজা বা নানান জাতীয় বিশেষায়িত বাদাম সব ধরনের বিশেষ বিশেষ সামগ্রী পাওয়া যায়, যা কিনা ক্রিসমাসের সময় একে অপরকে উপহার দেওয়ার জন্য অন্যতম। ইউরোপের সমগ্র ক্রিসমাস মার্কেটের একটি বিশেষ ধরনের গরম ওয়াইন থাকে যা ঠান্ডার মাঝে সবাইকেই বেশ আকর্ষণ করে এবং সত্যি বেশ মজাদার । সাল্জবুর্গের এই ক্রিসমাস মার্কেটের ঠিক মাঝখানে একটি কৃত্রিম বরফ গ্যালারি আছে, যেখানে শিশু থেকে শুরু করে বড়রা বিনা পয়সায় বরফ স্কেটিং করতে পারে। মজার বিষয় হলো, এখানে বড়রা বরফ স্কেটিং করে ঠান্ডা হয়ে প্রায় সবাই সেই আকর্ষণীয় বিশেষ গরম ওয়াইন পান করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। শিশুদের জন্য এই বিশেষ জাতীয় গরম ওয়াইন পাওয়া যায় ( শিশুরা যেন ঠান্ডাই হয় না! খেলাতেই মগ্ন থাকে বেশিরভাগ সময়) তবে সেই গরম ওয়াইনে কোনো আলকোহল থাকে না। এই মার্কেটে এমন কিছু বিশেষ খাবার পাওয়া যায়, যা সত্যি খুব মজাদার এবং এই খাদ্যে গুলো সাধারণত এই বিশেষ মাসেই পাওয়ার সুযোগ বেশি। মার্কেটটি সকাল থেকে রাত অব্দি খোলা থাকে এবং রাতেই বেশি আকর্ষণীয় বলা যায়, কেননা রাতে মানুষের বেশি আনাগুনা এবং চমত্কার লাইটিং অতীব আকর্ষণীয় ।
আজকাল আমাদের দেশ থেকে অনেকেই ইউরোপ আমেরিকায় ঘুরতে আসেন। আমরা প্রবাসীরা সত্যি গর্বিত হই যখন কোনো বাংলাদেশীদের ইউরোপে ট্যুর করতে দেখি। কেননা পূর্বে দেখা যেত না, যা কিনা এখন অনেক বাংলাদেশি ট্যুরিস্টদের দেখা মেলে। বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে স্যান্কজ্যান্স ভিসায় ইউরোপের ইউনিয়নের সকল দেশ এক ভিসায় ঘুরার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আগামীতে বাংলাদেশ থেকে অনেক ট্যুরিস্ট আসুক আমরা প্রবাসীরা সেটাই কামনা করি। বাংলাদেশি ট্যুরিস্টদের জন্য অস্ট্রিয়ার সাল্জবুর্গ শহরটি দেখার জন্য অগ্রিম আমন্ত্রণ থাকলো।
বুলবুল তালুকদার
সহকারী সম্পাদক, শুদ্ধস্বর ডটকম