ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও বিবিসি রেডিওতে সাংবাদিকতার পর, অধ্যাপক আলী রীয়াজের সময় কাটছে আমেরিকার ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপনায়। অবস্থান দেশ থেকে দুরে হলেও, অন্তরজুড়ে আছে দেশ ও দেশের ভবিষ্যৎ ভাবনা। তার শিক্ষকতা এবং গবেষণার মূল জায়গা রাষ্ট্র ও রাজনীতি। সেই সূত্রে পলিটিকাল ইসলাম, ইসলামিক মিলিটেন্সি, সাউথ এশিয়ান পলিটিক্স তার ফোকাসের জায়গা। এ বিষয়ে বইও লিখেছেন বেশ কয়েকটি। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস বিষয়ক তার বই প্রকাশিত হয়েছে ২০১৬ সালে। লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতি বিশ্লেষক, ডাকসুর সাবেক সাহিত্য সম্পাদক অধ্যাপক আলী রীয়াজ বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

নির্বাচনের তফসিল, দাবির প্রেক্ষিতে ৭ দিন পেছানো, আবার পেছানোর দাবি- আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

আলী রীয়াজ: বিরোধী দল, বিশেষ করে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের তফসিল আরও পেছানোর দাবি করেছিলো; ফলে সাত দিন পেছানোর এই ঘোষণা তাঁদের দাবির প্রেক্ষিতে হয়েছে এমন বলা যাবে না। এতে করে অবস্থার তেমন হেরফের হচ্ছে বলে আমার কাছে মনে হয় না। সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন আন্তরিক হলে বিরোধীদলের এই দাবি বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। নির্বাচন না পেছানোর জন্যে কমিশনের দেওয়া যুক্তি এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।

পল্টনের সংঘর্ষ কী সাধারণ নির্বাচনী সহিংসতা হিসেবে দেখতে হবে, না বড় কোনো সংকটের ইঙ্গিত?

আলী রীয়াজ: যেকোনো ধরণের সহিংসতাই উদ্বেগের বিষয়, যেকোনো ধরণের সহিংসতাই সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু, পল্টনের ঘটনার প্রেক্ষাপটটা বিবেচনায় রাখলে আমরা কী দেখতে পাই? ক্ষমতাসীন দলের কার্যালয়ে হাজার হাজার মনোনয়ন প্রত্যাশী যখন সমাবেশ করলেন তখন নির্বাচন কমিশনের কোনো উদ্বেগ দেখা গেলো না, মোহাম্মদপুরে ক্ষমতাসীন দলের দুই মনোনয়ন প্রার্থীর কোন্দলে দুজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো। কিন্তু, বিরোধীদলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা যখন সমবেত হলেন তখন নির্বাচনী আইনের প্রশ্ন উঠলো, কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এই নিয়ে তৎপর হতে বললো। আদৌ এর কোনো দরকার ছিলো কি?

নির্বাচন নিয়ে এখনও অনেক অনিশ্চয়তা আছে, ফলে কমিশন চাইলেই এটা এড়াতে পারতো। যদি পুলিশের তৎপরতা না থাকতো তা হলেও কী এই অবস্থার সূচনা হতো? যারাই এই সহিংসতা করেছেন তাঁরা কী চান? আমার ধারণা- তাঁরা চান বিরোধীদল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করুক। তাতে কারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন? বিএনপি’র নেতা কর্মীদের সেটা উপলব্ধি করা দরকার। অন্যদিকে নির্বাচনী আইন ভঙ্গের আরও যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলোর ব্যাপারে কমিশনের ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। ফলে সহিংস ঘটনার পাশাপাশি এর প্রেক্ষাপট এবং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা বিবেচনায় নিলে যে ছবি দেখা যায় সেটা ইতিবাচক নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশের জন্যে সেটা ভালো ইঙ্গিত দেয় না।

পুলিশ নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে, ঘটনাক্রম কী তা বলছে?

আলী রীয়াজ: কাগজপত্রে কী আছে সেটা এক জিনিস আর তাদের ভূমিকা কী বলে সেটা অন্য জিনিস। এখন পর্যন্ত পুলিশের আচরণে কোনো পরিবর্তন নেই; বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ‘গায়েবী মামলা’ তো বন্ধের লক্ষণ নেই। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের আনুকূল্য পাওয়ায় তো ঘাটতি দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশের আচরণ যদি স্পষ্টত বিরোধীদলের বিরুদ্ধে যায় তবে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন আছে সেটাই প্রমাণিত হয়। কমিশন কি সেটাই চাইছে? না চাইলে তাদের উচিত হবে সেটা প্রমাণ করা।

বাংলাদেশের জোট রাজনীতির যে দৃশ্যমান অবস্থান, তা কী বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে?

আলী রীয়াজ: জোট রাজনীতি বাংলাদেশে নতুন নয় – ১৯৫৪ সাল থেকেই আছে। নিকট অতীতেও তা ছিলো। ২০০১ বা ২০০৮ সালের নির্বাচনের দিকে তাকালেও তা দেখবেন। কিন্তু, এবার কিছু কিছু জোটের উদ্ভবের কারণে মনে হচ্ছে যে তারা কেবল সুবিধা নেওয়ার জন্যেই একজোট হচ্ছে। আদর্শের বাইরে গিয়ে, রাজনৈতিক কোনো ধরণের কর্মসূচি বা উদ্দেশ্য ছাড়াই জোট গঠনের একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অনেকগুলো অবশ্য একেবারেই নাম সর্বস্ব। এর মধ্যে এমন জোটও আছে যারা এই কিছুদিন আগেই ক্ষমতাসীন দলের বিরোধিতা করেছে কিন্তু, এখন কেনো তারা ঐ জোটে যাচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে সব মিলিয়ে এটা বড় ধরণের মেরুকরণের ইঙ্গিত দেয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশের পর ক্ষমতাসীন জোটের আকার বৃদ্ধির যে উদ্যোগ তা এই মেরুকরণের ইঙ্গিতকে জোরদার করছে।

প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি – সবাই স্ব-ক্ষমতায় যার যার পদে। নির্বাচন কমিশন কী করে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে নেবে? তা কী সম্ভব?

আলী রীয়াজ: বাস্তবে সেটা সম্ভব নয় এমন আশঙ্কা এবং অতীত ইতিহাসের কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠেছিলো, সেই ব্যবস্থা চালু হয়েছিলো। এই দফায় অন্ততপক্ষে একটা নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছিলো। সেটা মানা হয়নি। পরিস্থিতির এমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি যে আমি আশাবাদী হবো। কিন্তু, মনে রাখবেন যে, নির্বাচন কমিশনের কাছে সেই ক্ষমতা কাগজপত্রে আছে, আইনের মধ্যে আছে – তারা চাইলে সেটা প্রয়োগ করতে পারে। তারা যদি সেটা করতে চায় তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন পাবে বলেই আমি মনে করি। কমিশন এবং ক্ষমতাসীন দল নিশ্চয় মনে রাখবে যে, সাধারণ ভোটাররা এসব বিষয় একেবারে লক্ষ্য করেন না- তা কিন্তু নয়।

জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করার ফলাফল কী? এতে কী বিএনপি লাভবান হলো?

আলী রীয়াজ: জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের নির্দেশ আদালত দিয়েছে ২০১৩ সালে। তাই, ২০১৪ সালেও জামায়াতে ইসলামী চাইলে নির্বাচন করতে পারতো না। ফলে কমিশনের প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকতা বলেই বিবেচনা করা ভালো। এতে মাঠের পরিস্থিতিতে এমন কোনো নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে বলে মনে হয় না। বিএনপি’র লাভ বা ক্ষতির কোনো কারণ নেই। জামায়াতের কিছু কিছু নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন গত কয়েক বছরে। অন্যদিকে, জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থান ২০ দলীয় জোটের কারণে বিএনপির সঙ্গেই। নির্বাচনে যেখানে জামায়াত মনে করবে তাদের সাংগঠনিক কারণে তাদের আলাদা থাকা দরকার সেখানে তারা যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী দেয় তাতে আমি অবাক হবো না। ফলে বিএনপির লাভ বা লোকসান কিছুই হয়নি। আর এখন বিএনপি একা নির্বাচন করছে না, ২০ দলীয় জোট হিসেবেও করছে না।

নির্বাচন তো হবে, সুষ্ঠু কী হবে?

আলী রীয়াজ: নির্বাচন নিয়ে সব অনিশ্চয়তার অবসান হয়েছে তা নয়। তবে বিরোধী দল, বিশেষ করে ঐক্যফ্রন্ট এবং তার শরীক বিএনপি, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে চায় এটা স্পষ্ট। সুষ্ঠু ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের; সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে যে ধরণের পরিবেশ থাকা দরকার নির্বাচন কমিশন এখনও তা তৈরি করতে পারেনি। উপরন্তু, কমিশনের আচরণ নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। ফলে এখনও আশাবাদী হতে পারছি না।    সুত্র : দ্য ডেইলি স্টার

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading