
গোলাম মোহম্মদ কাদের, জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান।জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের কোচবিহারের দিনহাটায়। রংপুর জেলা স্কুল হতে মাধ্যমিক ও কারমাইকেল কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগ থেকে ১৯৬৯ সালে স্নাতক। ১৯৭০ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ডে। দীর্ঘদিন তেল বিপনন কোম্পানি যমুনা অয়েল কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন।
নব্বইদশকের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে পদার্পণ।
পর পর তিনবার লালমনির হাট জেলা সদর হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বিগত মহাজোট সরকারে পাঁচ বছর তিনি প্রথমে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন এবং পরে বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করেন। তাঁঁর সাথে কথা বলেছেন শুদ্ধস্বর ডটকমের সহকারী সম্পাদক আইরিন পারভীন খান।
শুদ্ধস্বর: দেশে চলমান রাজনীতি কোন পথে? এক দল বলছে বর্তমান সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন আরেক দল বলছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না এর সমাধান কোথায়?
জি এম কাদের: বর্তমান পরিস্থিথি অনিশ্চিত, কিছুটা সংঘাতমুখী। দু’পক্ষই বিপরীতমুখী অবস্থানে। আলাপ আলোচনা করে, দু’পক্ষই ছাড় দিয়ে মাঝামাঝি কোনো অবস্থান একমত হতে পারলেই শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। কিন্তু সেটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
শুদ্ধস্বর: এমন পরিস্থিতে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কেমন হবে?
জি এম কাদের: জাতীয় পার্টি যেকোনো পরিস্থিতিতেও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দু’পক্ষই যাতে কিছুটা নমনীয় হয় ও সুষ্ঠু অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয় সে প্রত্যাশা করছে।
শুদ্ধস্বর: নির্বাচনকে সামনে রেখে আপনারা নাকি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের সঙ্গেই যোগাযাগ রক্ষা করে চলছেন?
জি এম কাদের: আমার জানা মতে শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে।
শুদ্ধস্বর: বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় পার্টির অবস্থান কী হবে আর না নিলে কেমন হবে?
জি এম কাদের: বিএনপি অংশ নিলে জাতীয় পার্টি জোটবদ্ধ নির্বাচন করবে। না নিলে ৩০০ আসনের সব কটিতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
শুদ্ধস্বর: আবারও কি জাতীয় পার্টি সমঝোতার মাধ্যমে গৃহপালিত বিরোধী দল হবে?
জি এম কাদের: জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করলে সরকারের অংশ হওয়ার আর এককভাবে নির্বাচন করলে সরকার গঠনের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
শুদ্ধস্বর: নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে জাতীয় পার্টির কোনো প্রস্তাবনা আছে কিনা? নাকি জাতীয় পার্টি থেকে এক-দুই জন রাখলে খুশি আপনারা?
জি এম কাদের: বিগত ২০১৪ সালের ১০ম সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সর্বদলীয় সরকার গঠন করে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার প্রস্তাব জাতীয় পার্টির প্রধান এরশাদ সাহেব দিয়েছিলেন। সেটা গ্রহণ করে তখনকার মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির সাতজন মন্ত্রী নেয়া হয়েছিল। তখনকার বিরোধী দল বিএনপি হতেও মন্ত্রী দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। বিএনপি প্রস্তাবে রাজি হয়নি, নিজ দল হতে মন্ত্রী মনোনয়ন দেয় নি। আমাদের এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নতুন কোনো প্রস্তাব নেই।
শুদ্ধস্বর: সরকার বিরোধী জাতীয় ঐক্য নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
জি এম কাদের: দেশের জনগণ এখন কট্টরভাবে দু ভাগে বিভক্ত। একভাগ চায় এ সরকার ফের নির্বাচিত হোক, সরকারি কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক। অপরভাগ সরকার পরিবর্তনের পক্ষে, পরিবর্তিত আঙ্গিকে দেশ পরিচালিত হোক, এটা তাদের ইচ্ছা।
এ প্রেক্ষিতে সব দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে দল সমূহ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি জোটে নির্বাচন করবে বলে ধারণা করছি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে দুটি জোট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নির্বাচনকে সামনে নিয়ে সেদিকেই মেরুকরণ হচ্ছে।
কিছুকিছু দল সরকারদলীয় জোটে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। আবার কিছু দল সরকার বিরোধী জোটেও যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে। যে ঐক্য প্রক্রিয়া হয়েছে ডঃ কামাল হোসেন, বিএনপি ও অন্যদের নেতৃত্বে; এই ঐক্যফ্রন্ট আগামী দিনে সরকারি দলের বিপক্ষে শক্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে পারে।
কারণ হল, বর্তমানে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল নয়; তাদের জনসমর্থনও নগণ্য নয়। তাদের এ মুহূর্তে যে জিনিসটির ঘাটটি তা হল, তাদের শীর্ষ নেতৃত্বে শূন্যতা দেখা দিয়েছে। প্রধান দুজন নেতা এবং নেত্রী এই মুহূর্তে নির্বাচন অথবা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি থাকা অনিশ্চিত, বা অন্ততপক্ষে নির্বাচন করতে পারবেন সেটা মনে হচ্ছে না।সেক্ষেত্রে বিএনপিতে পরবর্তী ধাপের নেতা কর্মীদের এবং বিভিন্ন ইস্যুতে যদি তাদের মধ্যে দ্বিমত সৃষ্টি হয়, সেখানে একটি দলের মধ্যে ভাঙ্গনের একটা ঝুঁকি বা আশঙ্কা থেকে যায়। তারা (বিএনপি)কামাল হোসেন বা অন্য যারা আছেন, তাদেরকে নিয়ে জোটবদ্ধ থাকলে তাদেরকে নিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে তাদের অভিবাবক মেনে নেতৃত্বের স্থানে বসানো হলে বিএনপির যে সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে, তাতে ভাঙ্গনের আশংকা কমবে। এবং সেক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি শক্তিশালী মোর্চা গঠিত হতে পারে।
এই প্রক্রিয়ায় দল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা কম। কারণ, এই রাজনীতিবিদদের একটি অত্যান্ত পরিছন্ন ভাবমূর্তি আছে। বিএনপিকে দখল করে নেবার মত তাদের মন মানসিকতা বা শক্তি নেই।
রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকারের বিপক্ষে ভবিষ্যতে এই মোর্চার যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে। বিএনপি যদি তাদেরকে অভিভাবকের ভূমিকায় মেনে নেয় তাহলে তাদের মাধ্যমে দলের সংহতি রক্ষা করা সম্ভব হবে। এছাড়া নির্বাচনে সরকারের বিপক্ষে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতেও তাদের সুবিধা হতে পারে।
শুদ্ধস্বর: আগামী নির্বাচন নিয়ে জনগণে প্রতি কী বার্তা দিবেন?
জি এম কাদের: জনগন দেশের মালিক এবং সকল ক্ষমতার মালিক /উৎস জনগণ, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগন সে ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ পায়। তারা তাদের ক্ষমতা হস্তাওন্তর করে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ভোটের মাধ্যমে। সেই নির্বাচিত প্রতিনিধি সেটা ব্যবহার করে দেশ চালায়।
এক কথায়, জনগন তাদের ক্ষমতা কার মাধ্যমে ব্যবহার করবে সেটার প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করার জন্যই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
জনগণের সরাসরি অংশগ্রহন ও ভোটের মাধ্যমে দেশের সরকার এবং বিরোধী দল গঠিত হয়। বিরোধী দলের দায়িত্ব হল সরকার যাতে জনগণের কথামত দেশ পরিচালনা করে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা।
আমি মনে করি যে, নির্বাচনে সঠিক মানুষকে নির্বাচিত করা এবং যার মাধ্যমে তারা বিশ্বাস করে যে, দেশ ও জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে বুঝে দেশ পরিচালনা করবে এমন মানুষকে নির্বাচিত করা উচিৎ। এক্ষেত্রে যদি তাদের ভোটাধিকারের প্রশ্ন আসে এখানেও আমি মনে করি, ভোটাধিকার রক্ষায় তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে। তাদের ভোটাধিকার যাতে কেউ নষ্ট করতে না পারে সেদিকে যথেষ্ট সচেষ্ট থাকা উচিৎ নিজেদের ভূমিকা রাখা দরকার।
আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি এবং এই দুর্নীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সাধারণ জনগণ। এই বিষয়কে মাথায় রেখে তাৎক্ষণিক কোনো সুযোগ সুবিধার দিকে লক্ষ না রেখে একেবারে সার্বিকভাবে দেশের মঙ্গল এবং তার মাধ্যমে নিজেদের এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মঙ্গলের জন্য দূর্নীতিবাজদের নির্বাচিত না করার দিকে বিশেষ লক্ষ রাখা প্রয়োজন।
সৎ ব্যক্তিদের যোগ্য ব্যক্তিদের তারা নির্বাচিত করবে এটাই আমার প্রত্যাশা জনগণের কাছে।
শুদ্ধস্বর: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জি এম কাদের: ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: আইরিন পারভিন খান
সহকারী সম্পাদক: শুদ্ধস্বর ডটকম