
নির্বাচনের উৎসবের আমেজ। সরগরম রাজনৈতিক দলের কার্যালয়। নেতাদের বাসা-বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মী সমর্থকদের ভিড়। পাড়ায় মহল্লা চায়ের দোকান সবখানে জমজমাট আলোচনা। নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়। রাষ্ট্রের নাগরিকগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে বাছাই করার সুযোগ পায়। প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দল ও প্রার্থীদের জন্য ভোট হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার মোক্ষম হাতিয়ার। সাংসদ নির্বাচন চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। পরবর্তী একটি মেয়াদে কারা দেশ পরিচালনা করবেন তা নির্ধারিত হয় নির্বাচনে। সাধারণ নির্বাচন দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের পথ। সেখানে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা গুরুতর। আর জনগণের সঠিক সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে জাতির ভাগ্য। আসতে পারে ইতিবাচক পরিবর্তন অথবা ঘটতে পারে বিপর্যয়। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি অপরিহার্য বিষয়। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রথম ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে সময়কার ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর অধীনে। যার ৩টিই ছিলো সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার। তবে ১৯৯১ সালের নির্বাচনটি করে সব দলের ঐকমত্যে গঠিত একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ১৯৯৬ সাল থেকে পরপর ৩টি নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ২০১১ সালে সংবিধানে সংশোধনী এনে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধানে ফিরে যায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন হয় আর সেই নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ভোট বর্জনের করে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হবে। আর এই নির্বাচনে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচন করবে এবং বিএনপির প্রতীক ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপির একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণার পরপরই পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। একদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। দুই পক্ষেই নির্বাচনী যুদ্ধে নামছে সর্বশক্তি নিয়ে। দীর্ঘদিন পর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আভাস পেয়ে প্রার্থী হতে চান অনেকে। রীতিমতো মনোনয়ন সংগ্রহের হিড়িক পড়েছে। সব আসনেই প্রার্থীর ছড়াছড়ি। ১০ বছর পর নৌকা আর ধানের শীষের লাড়াই দেখা যাবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করতে যেসব রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্ষমতার লোভ ত্যাগ করে কাজ করবেন, জাতি তাঁদের মনে রাখবে। একসময়ে ভারতের পাশাপাশি সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে সেই ঐতিহ্য হারিয়েছে বাংলাদেশ। তাই ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হোক। ভোটারদের ভোট প্রদানে উৎসাহিত এবং নিরাপত্তা ও পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব সরকার ও নির্বাচন কমিশন এবং গোটা সমাজের। গণতন্ত্রের মূল হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ। নির্বাচনই গণতন্ত্রের ভিত রচনা করে। নির্বাচন হল গণতন্ত্রের উপাদান আর নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের যাত্রাই হয় না। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে থাকেন। ভোটাররাই এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কাজেই যেকোনো নির্বাচন, বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপকসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিই কাম্য। বর্তমানে প্রায় সকল দেশেই ভোট হচ্ছে আধিপত্যকামী, পুঁজিপতি, বংশগত রাজনীতিক, গডফাদার ও ক্ষমতালোভীদের একটি খেলা। এটি এমন একটি খেলা, যেখানে প্রতারণা ও মিথ্যা হচ্ছে বড় উপাদান। যেমন : পারিবারিক রাজনীতি, অন্যকে গালমন্দ করা, গীবত-শেকায়েত করা, নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া, নেতা-নেত্রীর অন্ধ আনুগত্য, একে-অন্যের কোনো ভালই স্বীকার করতে না চাওয়া, নিজের অবাস্তব ও মিথ্যা অবদানের প্রচারণা, মিথ্যা অপবাদ-মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এবং শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে আদর্শিক কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও জোটবদ্ধ হওয়া ও আদর্শিক শত্রুকেও জোটে নেওয়া।মনোনয়ন না পেলে রাতারাতি এত দিনের শত্রুকে বন্ধু বানিয়ে দলবদল করা, মনোনয়ন বাণিজ্য, অর্থ, পদবী ও রাষ্ট্রীয় সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে ভোট কেনা-বেচা ইত্যাদি। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভালো লোকদের প্রার্থী হওয়া বা নির্বাচিত হওয়ার আইনগত বাধা নেই, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। হাতে গোনা সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বর্তমানে নির্বাচন হচ্ছে টাকার বিনিময়ে আধিপত্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তির খেলা। আমাদের দেশে গণতন্ত্র এখনো উন্নত দেশের গণতন্ত্রের মতো শক্ত ভিত পায়নি, তাই গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করতে হলে ধারাবাহিকভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যকীয়। সুষ্ঠুভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব প্রধানত নির্বাচন কমিশনের, তবে সরকারের সহযোগিতা অবশ্যই হতে হবে ইতিবাচক।
লেখক: আবু জাফর শিহাব (এল এল বি)