
৪ বছরেও মিলল না ধ্বংসাবশেষ। কোথায় কোন অতলে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল! মিলল না বহু প্রশ্নের উত্তর। যেগুলোর উত্তর হয়তো কোন দিন মেলাও সম্ভব নয়। ‘ক্লোজড চেপ্টার’ হয়ে গেল নিখোঁজ MH370 এর খোঁজ। তাহলে কি ইতিহাসে ’গ্রেটেস্ট অ্যাভিয়েশন মিষ্ট্রি’ নামেই লেখা থাকবে MH370 নিখোঁজ রহস্য?
কিন্তু না! সবার চেষ্টার যেখানে শেষ,সেখান থেকেই তার শুরু। নিজের মেধা,যোগ্যতা আর স্বভাবসুলভ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পৌছে গেল…….. রহস্যের দ্বারপ্রান্তে।
শাফিকা মিম।
বাঙালী তরুণী। সৌন্দর্য,কাঠিন্য,কমনীয়তা আর কোমলতার মিশ্রনে গড়া। বিপদ সঙ্কুল পরিবেশ আর রহস্যময়তা যার বিচরণ ক্ষেত্র।
১.
তখনো সূর্য অস্ত যাবার কিছুটা সময় বাকি। চারদিকে কবরস্থানের মতোন নীরবতা বিরাজ করছে। স্পেনের বিখ্যাত নদী গোয়াদেল কুইভারের সেতুতে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা নামা দেখছিল শাফিকা মিম। স্রোতস্বিনী গোয়াদেল কুইভার যেন আপাদমস্তক বিষন্নতায় মুড়ে আছে। নদীর কিনারে দাঁড়ানো একসময়ের বিশ্বকাপানো সব শাসকরে বাসস্থান কর্ডোভার পরিত্যক্ত রাজপ্রাসাদ আল কাজারকে দেখে মনে হচ্ছিলো বৈধব্যের পোষাক পড়া জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত কোন অবয়বের প্রতিচ্ছবি। আল কাজারের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কর্ডোভার সবথেকে বড় মসজিদ। ১২৯৩ স্তম্ভ বিশিষ্ট এই মসজিদটিকে স্ট্যানলি লেনপুল স্তম্ভের অরণ্য বলে অবহিত করেছিল। একটা সময় এই মসজিদের বুক আবৃত থাকতো ৪৭ হাজার ৩ শত কার্পেটে, এর বুক আলোকিত থাকতো ১০ সহস্র আলোকশিখায়। কিন্তু আজ তার সুউচ্চ মিনার ভগ্ন,দরজা জানালা লুন্ঠিত। কালের গর্ভে সব সৌন্দর্য হারিয়ে আজ সে রিক্ত।
ব্রীজের রেলিং এ ভর দিয়ে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল ও গোয়াদেল কুইভারের তীর জুড়ে বিস্তৃত কর্ডোভা শহরের দিকে। একটা মৃত শহর যেন এখন কর্ডোভা। অথচ দশম শতাব্দীর দিকে সমগ্র ইউরোপ যখন অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত সেই সময় আন্দালুসিয়ার রাজধানী এই কর্ডোভা নগরীতেই শুধু ছিল ৩৫০ টি হাসপাতাল,৮০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অসভ্য ইউরোপ জাতি যখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বুঝতো না,পানি ব্যবহার না করাকেই কৃতিত্ব মনে করতো তখন কেবল এই কর্ডোভা নদরীতেই ৯০০ টি পাবলিক টয়লেট ছিল জনগনের ব্যবহারের জন্য। যখন কর্ডোভার মানুষজন সরকারী উজ্জল আলোকময় রাস্তায় চলাফেরা করতো তার ৭০০ বছর পরেও লন্ডনের রাস্তায় সরকারীবাতি জ্বলেনি। ইউরোপ যখন বিদ্যালয় কাকে বলে জানতো না, তখন স্পেনের মানুষেরা জ্ঞান চর্চার জন্য যে বইগুলো ব্যবহার করতো তার নামের তালিকাটিই ছিল ৪৪ খন্ডে বিভক্ত। এরকম নানান ইতিহাস ভেসে আসছিল মনে কর্ডোভা নগরীর। গত পরশুদিন জার্মানী থেকে মাদ্রিদে নেমেছে ও। তারপর সোজা একটা গাড়ি ভাড়া করে কর্ডোভা। অনেকদিন ধরেই কর্ডোভা দেখার ইচ্ছে ছিল। আর মনটাও বেশি ভাল যাচ্ছিলো না। তাই কাউকে কিছু না বলেই নির্জনতা যাপনের জন্যে স্পেনে আসা। পাশ থকে কারো কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। চকিত পাশ ফিরে তাকিয়েই দেখতে পায় একটা সতেরো/আঠারো বছর বয়সী মেয়ে কান্না করছে। আর তাকে সান্তনা দিচ্ছে একটা মাঝবয়সী একজন লোক। দেখে ভারতীয় মনে হওয়াতে এগিয়ে যায় ও। কথা বলে লোকটির সাথে।
’দুঃখিত ডিস্টার্ব করার জন্য। আমি বাঙালী। আপনাদের ভারতীয় মনে করে কথা বলতে আসলাম।’ লোকটিকে জিজ্ঞেস করে শাফিকা মিম।
একটু চুপ থেকে লোকটি বলল,’সে এক বড় বেদনার কাহিনী মা।’
’আপনার আপত্তি না থাকলে আমি শুনতে চাই।’
’শোন তাহলে,মেয়েটা আমার সবে তখন কলেজে উঠেছে। সেই সময় পরিচিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এক তরুণের সাথে। মন দেয়া নেয়াও হয়ে যায়। আমার মা মরা মেয়ে। বড় আদরের। তাই জানার পর সম্পর্কটা আমিও মেনে নিই। ছেলেটাও ভাল বংশের। ছেলের বাবার সাথে কথা ছিল ওরা পরিণত বয়সে উপনীত হইলেই বিয়ে দেব। সবকিছু ভালই চলছিল। ছেলেটা স্টাডি ট্যুরে মালয়েশিয়া গেছিলো। হঠাৎ ওখান থেকে একটা জরুরী প্রয়োজনে চীনে যাবার দরকার পড়লে কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং এর একটা ফ্লাইট ধরে। সেই ফ্লাইট টা ছিল মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স এর MH370 বিমানের। তারপরের টুকু তো তোমার জানারই কথা মা। আজ পর্যন্ত বিমানটির কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ছেলেটির শোকে আজ মেয়েটি আমার অর্ধ উম্মাদ।
লোকটির কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মেয়েটির দিকে একবার তাকায় মিম। কি অপরুপ ফুটফুটে একটা মেয়ে। দীঘল কালো চুল,বড় বড় চোখদুটোই কি অপরিসীম মায়া! অথচ কত কষ্ট লালন করতে হচ্ছে মেয়েটিকে। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নিজের অতীতের কথা মনে পড়ে যায় ওর। আজ দশটি বছর হয়ে গেছে অনিরুদ্ধ’র কোন খোজ পায়নি ও। অনিও তো ওর প্রথম প্রেম ছিল। যাকে এখনও খুঁজে ফেরে ও। প্রিয়জন নিখোঁজের যন্ত্রণা ও বোঝে। আজ সারাবিশ্ব জুড়ে স্পাই ও এসপিওনাজ জগতে ওর যে নাম ডাক তার সবকিছুই তো অনিরুদ্ধ’র জন্য। সেই সহজ সরল বালিকা থেকে আজকের অপ্রতিরোধ্য এসপিওনাজ এজেন্ট হিসেবে গড়ে ওঠা তো শুধু ভালবাসার মানুষটাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য। বাংলাদেশ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স এর মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করলেও বছর কয়েক যেতেই স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেয় কর্মজীবন থেকে। নিজেই শুরু করে একটা গোয়েন্দা ফার্মের। এখন নেশার মতোন হয়ে গেছে। ভয়ংকর সব অপারেশনে না গেলে কেমন যেন পানসে লাগে সময়গুলো। কিন্তু যার জন্য এই পেশায় আসা তাকে আজ খুঁজে পায়নি ও। আসলে যে ইচ্ছে করেই নিজেকে আড়াল করে তাকে কি খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়? তার উপর সে যদি হয় অনিরুদ্ধর মতোন খেয়ালী মানুষ!!
যাইহোক,নিজের ভালবাসা কে সে এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি কিন্তু এই অল্পবয়সী মেয়েটার প্রেমিক কে একবার সে খোঁজার চেষ্টা করবে।
একটুখানি এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির মাথায় হাত রাখে ও। বুকের সাথে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে,তুমি চিন্তা করো না আমি তোমার ভালবাসার মানুষটিকে খুঁজে এনে দেব।
মুখ তুলে তাকায় মেয়েটি,অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে,’ আমি আবার ওকে ফিরে পাবো? দেবেন আপনি ওকে খুঁজে এনে? আমি সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকবো ওকে এনে দিলে।’ চোখে পানি চলে আসে মিমের। একদিন অনিও ওর কোন এক আত্মীয়কে বলেছিল এভাবে অনুনয় করে ওকে ফিরে পাবার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অভিমান করে নিজেই নিখোঁজ হয়ে গেল অনি।
ওদের সাথে কথা বলে হোটেলে ফিরে আসে শাফিকা মিম। ব্যাগ গোছাতে শুরু করে ও। মেয়েটার ভালবাসার মানুষটাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়তে হবে ওকে। ওর কাছে কোন তথ্য নেই এই সম্পর্কে,সামনে শুধুই অন্ধকার। লক্ষ্য এখন একটাই। একটা বিমান। যার গায়ে লেখা MH370 । শুরু হলো MH370 নিখোঁজ রহস্যের অনুসন্ধান।
চলবে..