জাকওয়ান হুসাইনের গল্প “প্রতিচ্ছবি”

প্রথমে চোখ খুলেই নিজেকে একটা টিনশেড ঘরে দেখতে পায় আহসান। দীর্ঘসময় চোখ বাঁধা থাকবার কারণে অন্ধকার ঠাহর করতে সময় নিচ্ছে একটু। একটু পরেই আলো সয়ে যায় চোখে। এখনো পুরোপুরি অন্ধকার নামেনি বোঝা যায়। ঘরের চারপাশটা এক নজর দেখে নেয় ও। এক কোনে একটা কাঠের চৌকি ছাড়া তেমন কিছু দেখা যায় না। চৌকি বরাবর বেড়ার উপরে একটা কাবা শরীফের ছবি টাঙানো। আশে পাশে কোন লোকজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। দূর থেকে বেশ কিছু পাখির কিচির মিচির ভেসে আসছে। মনে হয় জায়গাটা জঙলা মতোন কিছু একটা হবে। জিপে আসার সময় এবরো থেবরো রাস্তা বোঝা গেছে। ওকে তুলে নিয়ে আসার কতক্ষন সময় পার হয়ে গেছে মনে নেই ওর। সময় দেখার ইচ্ছে হলেও উপায় নাই । কারণ ও ঘড়ি ব্যবহার করে না। জীবনে কোন দিনই ব্যবহার করেনি। একবার প্রেমিকা একটা ঘড়ি উপহার দিয়েছিল অবশ্য কিন্তু কোনদিন সেটা ব্যবহার করা হয়নি। ও আসল কথা বলা হয়নি। ওর পুরো নাম নাবিল আহসান। একজন বেকার ছেলে। ছাত্র রাজনীতি করে। রাজনীতি করার জন্য দীর্ঘ দিন ফ্যামিলির সাথে সম্পর্ক নেই। টুকটাক লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করে। গত কয়েক ঘন্টা আগে সাদা পোশাকধারী একদল লোক ওকে তুলে এনেছে। হেমন্তের দুপুরগুলো নাতিশীতোষ্ণ হলেও আজকের দুপুরটা বেশ কড়া ছিল। প্রেসক্লাবের সামনে থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষ করে টিএসসির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করেছিল। টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ায় ২০ টাকায় ভরপেট খাবার পাওয়া যায়। বাবা যবে থেকে টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে তখন থেকেই বেশ হিসেব করে চলতে হয়। প্রেসক্লাবের কোনার ফুটপাতের দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরায়ে হাইকোর্টের পেছন দিয়ে শিল্পকলার সামনে দিয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে টিএসসিতে আসবে ভেবে হাঁটা শুরু করে। বাংলা একাডেমির সামনে আসতেই সামনে একটা সাদা মাইক্রোবাস থামে । কিছু বোঝার আগেই ওকে তুলে নেয় মাইক্রোবাসে। সেই কথা ভাবতেই এখন ক্ষুধা অনুভব হয় আহসানের। দুপুরে তো খাওয়া হয়নি ওর। এতক্ষন ভুলে ছিল ক্ষুধার কথা। ওকে কেন তুলে আনা হয়েছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে ও। নির্বাচন ইস্যুতে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে বিপর্যস্ত জনজীবন। আর ওরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের বিপক্ষেই মাঠে নেমেছে। জাতীয় সংলাপের দাবীতে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়ে। দুজন লোক প্রবেশ করে ঘরে। ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে  বলে ওঠে,

’চলো বাইরে যেতে হবে। ম্যাডাম অপেক্ষায় আছে।’

ওদের কথা মতোন বের হয়ে আসে ওদের সাথে। বাইরে এসেই মনটা কেমন যেন ভাল হয়ে যায়। চারদিকে সবুজের সমারোহ। মাত্রই সন্ধ্যা নামছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে চারদিকে। কোথায় হতে পারে জায়গাটা? গাজিপুরের কোথাও একটা হবে হয়তো।  এত অল্প সময়ে ঢাকা থেকে গাজিপুর ছাড়া আর কোথাও যাওয়া সম্ভব না। আর এত সুন্দর জায়গা গাজিপুরের এদিকেই কেবল পাওয়া যায় এদিকে। ও হ্যা আজ আবার পূর্ণিমা। একটু পরেই আকাশ আলো করে বিশাল চাঁদ উঠবে। ভালোই হলো অরণ্যে চন্দ্রদর্শনের শখ ছিল অনেক দিনের। একটি মহিলা কন্ঠের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পায় ও।

’আপনি নাবিল আহসান?’

’হ্যা’।

’বসুন। সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বলেন ভদ্রমহিলা।’ মহিলা বললে ভুল হবে। অসম্ভব রুপবতী একজন তরুণী। বয়স ঠাহর করা যাচ্ছে না। কিন্তু গোধুলীর এই আধো অন্ধকারে আলোকবাতির মতো চমকাচ্ছে তার চেহারাখানি। শার্ট প্যান্ট পরিহিত,মাথায় বড় করে খোঁপা বাঁধা। কাজী নজরুল এরকম কাউকে দেখেই মনে হয় গেয়ে উঠেছিলেন,’তুমি প্রিয়া হবে মোর  এসো,দেবো খোঁপায় তারার ফুল’।

চেয়ারে বসতেই মহিলা কথা বলে ওঠে,’নাবিল আহসান। মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এ অধ্যায়নরত। প্রতিবাদী ছাত্রনেতা। ফার্মগেটে একটা মেসে থাকেন। পরিবারের সাথে অনেকদিন যোগাযোগ নেই। বর্তমানে রাজনীতিই ধ্যানজ্ঞান। কোন কাছের বন্ধু বা প্রেমিকা নেই। রাজনীতিই মুখ্যু এখন। কি ঠিক বলেছি?’

’হা সব ঠিক বলেছেন। জানিনা আপনারা প্রশাসনের লোকজন কি না। বা কোন গ্রুপের  কি না তাও জানি না। যেহেতু রাজনীতি করি আর এবারের আন্দোলন টা একই সাথে সরকারী ও বিরোধী দলের দুটোরই মাথা ব্যথার কারণ সেহেতু আমার সম্পর্কে সব জানাটাই স্বাভাবিক আপনাদের। কিন্তু প্রেমিকা বা কাছের বন্ধু নেই এটা জানা কি একটু অস্বাভাবিক নয় কি?’

’সব বিষয় জানাটা অফিসিয়ালি আর ওইটুকু পারসোনালী।’একটু হেসে বলেন মহিলাটি। ও হ্যা আমি সোনালী বোস। পূর্ণ পরিচয়টা দিতে পাচ্ছি না। ক্ষমাপ্রার্থী। উপর থেকে অর্ডার এসেছে আপনাকে মেরে ফেলার। আপনি অনেকের অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।’

’মেরে ফেলুন। অপেক্ষা করছেন কেন?’

’হুম। মেরে তো ফেলতেই হবে। উপায় নেই। কিন্তু তার আগে আপনার সাথে একটু গল্প করি। কথা বলে ভাল লাগছে আপনার সাথে। আসলে হুট করে আপনার সাথে এভাবে দেখা হবে ভাবতে পারি নি।’

’আপনার কথা বুঝতে পারলাম না?’

’ছেলেরা মেয়েদের কয়টা কথা বুঝতে পারে বলুন তো? যাকগে বাদ দিন। আচ্ছা এত প্রতিভাশীল একজন মানুষ হয়ে কেন মৃত্যুঝুকির পথে পা বাড়িয়েছিলেন বলুন তো?’

’আমরা কি অন্যায় কিছু করছিলাম?’

’আপনার মৃত্যু ভয় নেই?

’একটুও না।’

একদৃষ্টে আহসানের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকেন মহিলা সোনালী বোস। কিছুক্ষন চুপ থেকে বলেন,’আমি আপনার থেকে বয়সে বেশ কয়েক বছরের বড় হবো। কিন্তু আপনি কি জানেন আমি তুমুল ভাবে আপনার প্রেমে পড়ে গেছি?’

’আপনার সাথে মনে হয় এর আগে আমার কখনো দেখা হয়নি।’ আহসান বলে।

’না দেখা হয়নি। কিন্তু আপনার নির্বাসিত নক্ষত্র সহ সবগুলো বই আমি পড়েছি। অনেক ইচ্ছে ছিল নির্বাসিত নক্ষত্র উপন্যাসের নায়িকার মতোন কচুপাতা রঙের শাড়ি পড়ে কপালে বড় একটা সবুজ টিপ পড়ব,চোখে গাঢ় করে কাজল লাগাবো,মাথায় বড় করে খোঁপা করে বেলী ফুলের মালা গুজবো সেই খোঁপায়,তারপর আপনার সামনে গিয়ে বলবো ভালবাসি আপনাকে। আজ যখন জানলাম নাবিল আহসান কে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে তড়িঘড়ি করে চলে আসলাম। না আসলে হয়তো জীবনেও আর দেখা হবে না তার সাথে।’

’আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে এখানে আজ আমার মৃত্যু একদম নিশ্চিত।’

’হা। আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?’

সোনালী বোসের কথার উত্তরে হেসে ওঠে আহসান। ওর দিকে তাকিয়ে বলে, মৃত্যু সকল সৌন্দর্যের উৎস। তাতে ভয় পাবার তো কিছু নেই।’

’আচ্ছা আপনি রাজনীতিতে কেন আসলেন? আর আসলেন যখন তখন নির্দিষ্ট কোন দলের হয়ে না এসে এরকম নিরপেক্ষ মতবাদ নিয়ে কেন মাঠে নামলেন?’

’আমি নিরপেক্ষ বলে।’

’আমি আমার পেশাগত কারণে আমার পরিচয় আপনাকে দিতে পারবো না। এইখানে এইভাবে যারা আসে তারা কেউ বেঁচে ফেরে না। কিন্তু আমি আপনার লেখা পড়ে আপনাকে অনেক আগেই ভালবেসে ফেলেছি। তাই একটা সুযোগ আপনাকে দিতে চাই। আপনি রাজনীতি ছেড়ে দিন। তাহলে বেঁচে যাবেন।’

’একটা সিগারেট হবে?’

’আমি আপনাকে কিছু বলেছি।’

’একটা সিগারেট দেবেন প্লিজ। অনেক ঘন্টা ধরে সিগারেট খাওয়া হয়নি। বড্ড সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছে।’

আহসানের কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ হয়ে থাকে মহিলা। কোন কথা না বলে পকেটে থেকে সিগারেটের প্যাকেট টা এগিয়ে দেয়। আহসান সিগারেট ধরিয়ে জোরে একটা টান দেয়। সামনের জঙলের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় বিশাল চাঁদ উঠেছে। সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে বলে ওঠে সোনালী বোসের উদ্দেশ্যে, ’ওদিকে তাকিয়ে দেখুন কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে। আজ পূর্ণিমা জানেন তো?’

গভীর দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থাকে আহসানের দিকে সোনালী বোস। মৃদু স্বরে বলে ওঠে,রাজনীতির মাঠে আপনাকে মানায় না। আপনাকে শুধু প্রেমিক রুপেই মানায়।’

একটু হেসে আহসান বলে,’একজন বিপ্লবী বা রাজনীতিবীদকে তুমুল প্রেমিক হতে হয়। যার মনে সর্বগ্রাসী প্রেম নেই সে কখনো খাঁটি বিপ্লবী বা রাজনীতিবীদ হতে পারে না। আচ্ছা আমার মৃত্যুর কত সময় বাকি রয়েছে?’

’কেন? মৃত্যুর আগে আপনার কোন শেষ ইচ্ছে  আছে নাকি? থাকলে আমাকে বলতে পারেন। পূরণ করবার চেষ্টা করবো।’

’নাহ কোন ইচ্ছে নেই। তবে বেশি সময় হাতে থাকলে অনেকক্ষন চাঁদ দেখতে পাবো। আজকের পূর্ণিমা কে নেকড়ে পূর্ণিমা বলা হয়। বড় অদ্ভুত আজকের এই পূর্ণিমাটা। একবার নেকড়ে পূর্ণিমার রাতে আমি আর আমার প্রেমিকা একসাথে পাহাড়ে ছিলাম। সারাটা রাত চাঁদ দেখে কাটিয়ে দিয়েছিলাম।

’আচ্ছা আমি কি আপনাকে একটা চুমু খেতে পারি? আমার জীবনের শেষ ইচ্ছে বলতে পারেন। আমি জানি আপনাকে আজ মারা হবে। কারণ রাষ্ট্রের কাছে আপনি অনেক বড় অপরাধী। অনেক বড় পথের কাঁটা। আপনাকে বাঁচাবার ক্ষমতা আমার নেই। যদি থাকতো নিজের জীবন দিয়ে হলেও বাঁচাতাম। আমাকে আপনার কাছে পাঠানো হয়েছে যদি কোন তথ্য নিতে পারি আপনার থেকে এ জন্য। এই পুরো এলাকা আমাদের লোকজন দিয়ে ভরা। একটু পরেই ওরা আপনাকে নিতে আসবে। সামনের জঙলেই আপনাকে মেরে ফেলবে ওরা।’

কিছু বলার আগেই মেয়েটা এসে জড়িয়ে ধরে আহসান কে। গভীরভাবে চুম্বন করে।

সময় বয়ে যায়। ওরা মুখোমুখি বসে থাকে। পুরো জঙলকে আলোকিত করে মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকে নেকড়ে পূর্ণিমার চাঁদ। লৌহ কঠিন মেয়েটা নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। যাকে সে ভালবাসে কিছুক্ষন পর তার মৃত্যু হবে। আর আহসান একটার পর একটা সিগারেট টানতে টানতে গভীর মনোযোগে নেকড়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে। চাঁদের মাঝে ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকার প্রতিচ্ছবি দেখে। ওর তো মৃত্যুবোধ নেই।

মাঝরাতে ওরা আসে। কালো কাপড় পড়া কয়েকজন লোক। সোনালী বোস কাছে এসে বলে,শেষ কোন ইচ্ছে থাকলে আমাকে বলতে পারেন।’

কিছুক্ষন সোনালী বোসের দিকে তাকিয়ে থেকে আহসান বলে, আমার একটা চার বছর বয়সী মেয়ে আছে। সে যখন বড় হবে তখন ও যেন এতটুকু জানে যে তার বাবা একজন সাহসী মানুষ ছিলেন। বীরের মতোন মৃত্যু হয়েছিল তার। আপনি এতটুকু দেখবেন বুলেটের আঘাত যেন আমার শরীরের পেছনে না লাগে,বুকের মাঝ বরাবর যেন লাগে। ইতিহাস যেন স্বাক্ষী দেয় আমি মৃত্যু থেকে পালাইনি।

একটু পর সামনের জঙল থেকে দুবার গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। সোনালী বোস প্রেম আর কর্তব্য পালনের দ্বন্দে পুড়ে মরে। রাষ্ট্রযন্ত্র তার পথের কাঁটা দূর হওয়ার আনন্দে ভাসে। অনেক দূরে চার বয়সী একটি বাচ্চা খেলনা ফোনে তার বাবাকে আইস্ক্রিম পাঠানোর কথা বলে…আর জঙলের ভেতরে গুলি খাওয়া যুবকটি মৃত্যুর আগ মুহুর্তে নেকড়ে পূর্ণিমার চাঁদের ভেতর তার প্রেয়সীর প্রতিচ্ছবি দেখে।

received_481774662306314

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.