আমি যেখানে থাকি সেখানে স্বপ্ন দেখা নিষিদ্ধ। দেখা যায় শুধু লাঞ্চনা। এখানে গল্প করা নিষিদ্ধ,করা যায় শুধু পশুর মতো কাজ। এখানে আনন্দ আহার নিষিদ্ধ,পাওয়া যায় শুধু দুবেলার ডাল ভাত। নিজের মনের মতো করে কথা বলার অধিকারটুকুও আমার নেই,আছে শুদ্ধ ভাষায় একটি-দুটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার নিয়ম। এখানে আমার কাজের কোনো কদর নেই, আছে শুধু প্রতি মাসে কিছু টাকা মাইনে হিসেবে। এখানে বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ; পাওনা শুধু দাসত্বের অভিশাপ। এই নিষিদ্ধ  গৃহে আমি তাও একটা বন্ধু পেয়েছি। নাম তার শাওন। সে অনেক ভালো। ওকে অনেক পছন্দ করি আমি। কিন্তু ওর মা-বাবাকে একটুও পছন্দ করি না। বিশেষ করে ওর মাকে। ওর মা-ই এই নিষিদ্ধ সাম্রাজ্যের মহারানী। তিনি আমার শাওনের সাথে কথা বলাটা মোটেও সহ্য করতে পারেন না। শাওনের মুখে আমার নামও সহ্য হয় না তার। ওহ! আমার নাম টাইতো বলা হলো না। আমার নাম স্বপ্না। যে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। মা বলতেন মার স্বপ্নগুলো আমি পূরণ করব। তাই আমার নাম স্বপ্না রেখেছেন। মার স্বপ্ন ছিল মা নিজে পড়ালেখা শিখবেন এবং তার গ্রামের সব ছেলেমেয়েদেরও পড়াবেন। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, নিজের মেয়েকেই সপ্তম শ্রেণির পর আর পড়াতে পারেননি। তবে অনেক চেষ্টা করেছেন। আমাকে পড়ানোর জন্য মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করেছেন, মানুষের কথা শুনেছেন। এখনও মানুষের বাসায় কাজ করেন। তবে এখন আর আমাকে পড়ানোর জন্য নয়; বাবার চিকিৎসার জন্য। বাবার কি যেন রোগ। আমি আর মা দুজনেই বাবার চিকিৎসার জন্য রোজগার করে যাচ্ছি। এখন মার একমাত্র স্বপ্নই হয়তো বাবার সুস্থতা। তবে আমার দ্বারা এটিও পূরণ হবে কিনা তাও এখন সন্ধিহান। শাওনের মা এই নিষিদ্ধ সাম্রাজ্যের মহারানী,তাদের গৃহকর্মের জন্য নতুন কর্মচারী খুঁজে পেয়েছেন। বেশ সম্ভবত সে  আর কিছুদিন পর থেকেই কাজ শুরু করবে। আর আমাকে চলে যেতে হবে। আচ্ছা আমি চলে গেলে কী শাওনের আমার কথা মনে পড়বে? নাকি সে আমাকে একদমই ভুলে যাবে।

বিগত তিন বছরে কেবল তিনটি বাসায় কাজ করা হয়েছে। আসলে এসব লোকেরা আমাকে মানুষ বলে হয়তো কমই ভাবত। হয়তো ভাবত অসহায় জন্তু কিংবা বুদি¦হীন যন্ত্র। তবে এর চেয়ে বেশি কিছু না। তাদেও চেয়ে আসলে শাওনের মা অনেক ভালো। তবে এই তিস বছরের দাসত্বকালীন সময়ে শাওনের মতো ভালো বন্ধু আমার আর কখনোই হয়নি।

এই ঘরের সবারই বেশিরভাগ কাজ শাওন কেন্দ্রিক। সে কখন কী করছে, খেয়েছে কিনা, পড়াশোনা করছে কিনা এসবই। সমবয়সী একটা ছেলের প্রতি আশেপাশের সব মানুষের এতটা আদর যত্ন দেখে আমার মতো মেয়ের এতটু হিংসে হওয়া উচিত ছিল। তবে ব্যাপারটা শাওনের তাই লাগছে না। কারণ যেসব মানুষের কাছে আমি বন্ধুর মতো আচরণ পেয়েছি তার মধ্যে শাওনই সবার উপরে।

শাওন নিয়মিত বিকেলে খেলতে যায়। তার সাথে আমার বন্ধুত্ব হওয়ার পর সে আমাকেও নিয়ে যেতো। সেখানে সবাই ক্রিকেট খেলত। শাওনের বন্ধুরা আগে আমাকে খেলতে দিতো না। ভাবত হয়তো পারব না। কিন্তু একদিন শাওন অনেক অনুনয় বিনয় করার পর একবার খেলতে দিয়েছিল। আমি এর আগে কখনও ক্রিকিট খেলিনি তবে অনেক দেখেছি। আমাদের পাড়ায় মেয়েরা ক্রিকেটের মতো একটা খেলা খেলত- গিল্লি ডান্ডা। আমি সেটা আগে অনেক খেলেছিলাম। তাই সেদিন গিল্লি ডান্ডা খেলার সব অভিজ্ঞতা নিয়ে উঠে পরে লেগেছিলাম ভালো খেলার জন্য। সেদিন আমি বেশি ভালো খেলিনি। তবে শাওন বলেছিল খুব খারাপই যে খেলেছি তা নয়। ও হ্যাঁ! মনে পড়েছে। সেদিন প্রথম বলেই উরাধুরা একটা ছক্কা মেরেছিলাম। এরপর শাওনের বন্ধুগুলো বেশ কঠিন হয়ে গেল। এরপর আর ছক্কা হলো না। তবে নিজের রানের খাতায় দুটো চার ঠিকই লিখিয়ে নিয়েছিলাম। শেষমেষ ব্যাট দিয়ে নেখানের দু-চারটা ইটের তৈরি স্ট্যাম্প ভেঙ্গে আউট হয়েছি। অনেকদিন সেখানে নিয়মিত খেলতাম। কেউ মানা করত না। তবে কালকেই শাওনের মা দেখতে পেয়েছেন। তাই আজকে থেকে খেলাও নিষিদ্ধ। এখন আবার আগের মতোই জীবনযাপন।

আজ সকালে মা এসছেন। কাল রাতেই শাওনের মা তাকে আসতে বলেছেন। তাই কাল রাতেই বুঝতে পেরেছি; এখানে সেইদিনই ছিল আমার দাসত্বের শেষ দিন। আজ থেকে আমি মুক্ত। এখানে শুধু শাওন আর ক্রিকেটের কথাই কিছুটা মনে পরবে। আর বেশি কিছু না।

বাবা আগের চেয়ে কিছুটা  রোগা হয়ে গেছেন। আর মাথার চুলগুলোও পেকেছে। তার চেয়ে বোশ কোনো পরিবর্তনতো দেখা যাচ্ছে না। তবে কিছুটা অনুভূতিহীন হয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ আগেই মার সাথে বাসায় চলে এসেছি। এটা যদিও অন্য পাড়ায়। বাবা এখন বেশিরভাগ সময়ই বাসায় থাকেন। বাইরে যান শুধু হাঁটতে, পাড়ার খোজখবর নিতে। তার চেহারায় একটা অসহায় ভাব চলে এসেছে। বেশ একাকীও লাগে তাকে। আমরা আগে থেকেই অস্বচ্ছল ছিলাম। তবে অভাবের ছাপ বাবার মুখে আগে কখোনই এতো প্রকট ছিল না। বেশ হাসি-খুশিই তিনি থাকতেন। মার জমানো টাকাগুলো জোর করে নিয়ে হাসিমাখা চেহারায় ”যেটা তোমার সেটা আমার আর যেটা আমার সেটাতো আমারই” এই কথা বলতে বাবাকে অনেক শুনেছি। তবে এখন তার মুখে হাসির ছিঁটে ফোঁটাও নেই। দারিদ্র্যতা যে শিক্ষা কেঁড়ে নিতে পারে সেটাতো সবাই-ই জানে; কিন্তু একটা মুখের হাসিও যে কেঁড়ে নিতে এই ব্যাপারটা কি সবাই বুঝে। আমাদের জীবনপ্রণালি, থাকার জায়গা এসব দেখেতো অনেকেরই মুখের বিকৃতি ঘটে; কেনো আমরা এভাবে থাকি সেটা কি কেও জানে।

মা আমার জন্য কাজের সন্ধানে ব্যস্ত। কিন্তু আমি এখন শুধু  নিজেকে খোঁজার কাজে ব্যস্ত। আগে আর কিছু করতে ইচ্ছা করতো না। শুধু পড়তেই ইচ্ছা করতো। এখন পড়াশোনার চেয়ে ক্রিকেটই বেশি ভালো আবেগ দখল করে আছে। এখনতো রাতের বেলা স্বপ্নেও ক্রিকেট দেখি। কালকে কি দেখলাম জানো? আমি অনেক বড়ো মাঠে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছি। আর আগে শাওন যেমন খেলার সময় আমার নাম নিয়ে চেঁচামেচি করতো; তেমনি আরো অনেকে আমার নাম মুখে তুলে চিৎকার করছে, আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে। এই স্বপ্নটা আমি ঠিক ভোওে দেখেছি।অনেকেতো বলে ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। আমি অবশ্য এসব বিশ্বাস করি না। তবে আজকে কেন জানি খুব ইচ্ছা করছে এই বিশ্বাস করতে।

বিগত কয়েকদিন ধরেই গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকি যখন ভাইরা ক্রিকেট খেলে। ব্যাট ধরার সুযোগতো আর নেই। শুধু সময়ে সময়ে তাদেও বল কুঁড়িয়ে দিতাম। আজকে একটা ভাইয়া বেশ কটাক্ষ করে জিজ্ঞেস করেছিল, খেলব কিনা। আমিও হ্যাঁ-সূচক মাথা নাঁড়লাম। আর উপস্থিত বাকি সবাই হেসে যেন কুঁটিকুঁটি হয়ে গেল। কিন্তু আমি মোটেও হতাশ হইনি। কালকে আবার সেখানে যাব, বারবার যাব। যতদিন খেলতে দিবে না ততদিস যাব। শেষমেষ একদিনতো খেলতে দিবেই।

গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকাটা বৃথা যায়নি। আজকে আমাকে খেলতে দিয়েছে। আমি ঠিকই ভালো ব্যাট করেছি। তবে একবার বল করতে দিয়েছে তখন আর ভালো খেলিনি। কিন্তু সবাই বলেছে  আমি ভালো খেলেছি। তাই আমি তাদেও সাথে খেলতে পারব। একটা ভাইয়া বলেছে আমাকে ঠিক মতো বল করাও শিখিয়ে দিবেন। সেইদিন তাদের অহেতুক হাসি দেখে যদি খেলা দেখতে যাওয়া বন্ধ করে দিতাম তবে নিশ্চয়ই আজ আর  সুযোগ হতো না।

ইদানিং আমি প্রতিদিনই ক্রিকেট খেলতে যাই। কেউ খেলতে ভেটোও দেয় না। ভাইয়া  বলেছিল, আমাকে বল করা শিখিয়ে দিবেন; তিনি তার কথা রেখেছেন। তবে আমিই ভালো বল করতে পারি না। কিন্তু ব্যাট করার হাত আগের চেয়েও অনেক ভালো হয়ে গেছে। আমি এখন অনেক ভালো  খেলোয়াড়। এই গলির সবাই আমাকে তাই বলে।

বহুদিন পর মা নিজের খোঁজে সফল হয়েছেন। তিনি আমার জন্য অন্য বাসায় কাজ খুঁজে ফেলেছেন। আমি সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে এসেছি। সাথে মাও আছেন অবশ্য। তার মধ্যে   বেশি কোনো আবেগি ভাবও নেই। সে এখন পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে আছেন। বাসায় আনার পর তার আমার সাথে কথা বলার কোনো সুযোগ হয়নি। অনেক ব্যস্ততা তার। যাইহোক, বের হওয়ার আগে যেই অসীম গুরুত্বপূর্ণ কাজটা আমি করেছি তা হলো সকল খেলোয়ারদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি। চলে আসার পথে ”ভালো থেকো এমন কথা আমাকে কেউ বলেনি। সবাই শুধু বলেছে আমি খেলতে থাকলে অনেক ভালো করতাম। আমারও অবশ্য তাই মনে হয়।

নতুন বাসায় আমার সমবয়সী, আমার চেয়ে ছোট বা অল্প বেশি বড়ো কেউই নেই। শুধু আছে দুজন দম্পতি। সাথে আছেন তাদেও বুড়ো মা। মূলত তার দেখাশুনার জন্যই আমার এখানে আসা। তিনি আমাকে যথেষ্ট আদর করেন। তার সাথেই আমার সারাদিনব্যাপী গল্প কর্মসূচী চলে।

এখানে নিষিদ্ধ বলতে তেমন কিছুই নেই। তবে ঘর থেকে অনুমতি ছাড়া বের হওয়াটা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ। বহুদিনের প্রস্তুতির পর তাই একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। উত্তরে শুধুমাত্র না-ই পেয়েছি। এখন আমি শুধু তের তলা ভবনের ছোট্ট জানালা দিয়ে সবাইকে খেলতে দেখতে পারব; কিন্তু খেলতে পারব না।

আচ্ছা আমি যখন পড়তে চাইতাম, তখন পড়াশোনা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। এখন আমি যখন খেলতে চাই তখন তাও নিষিদ্ধ হয়ে গেল। কোনো দিন যদি মুক্ত ভাবে শ্বাস নিতে চাই, তখন তাও নিষিদ্ধ হয়ে যাবে নাতো? নাকি দাসত্বের অভিশপ্ত মানুষেরা যা চায় তাই নিষিদ্ধ?

 ইফফাত শারমীন নিঝুম

মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় (১০ম শ্রেণী)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading