
বর্তমানে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের একটি বড় অংশ। আর এ প্রযুক্তি ব্যবহারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম এখন স্মার্টফোন। স্মার্টফোন কিংবা ক্যামেরাতে নিজ হস্ত দ্বারা বিশেষ ভঙ্গিমার সাথে নিজে নিজের ছবি তোলাকে সেলফি বলে। ১৮৩৯ সালে রবার্ট কর্নেলিয়াস প্রথম নিজের ছবি নিজে তুলেন। ১৯০০ সালে “পোর্টেবল কোডাক ব্রাউনি বক্স ক্যামেরা” বাজারে আসার পর ফোটোগ্রাফিক আত্ম-প্রতিকৃতি তোলা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বহনে সহজ এই ক্যামেরার সাহায্যে আয়নার মাধ্যমে সেলফি তোলার প্রচলন শুরু হয় তখন থেকেই। সেলফি শব্দটির প্রাথমিক ব্যবহার ২০০২ এর আগে পাওয়া গেলেও, ২০০২ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ান এক অনলাইন ফোরামে (এবিসি অনলাইন) প্রথম ব্যাবহৃত হয়। সেই থেকে সেলফি কাহিনী শুরু। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে ‘সেলফি’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা হয় যার অরিজিন হিসাবে অস্ট্রেলিয়া উল্লেখ করে একে ‘ওয়ার্ড অফ ইয়ার’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
সেলফি, আজকালকার ডিজিটাল প্রজন্মের কাছে বহুল ব্যবহৃত একটা শব্দ। বর্তমানে সেলফি নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝেই বেশ জনপ্রিয়। স্মার্টফোন আছে, কিন্তু কোনো দিন সেলফি তোলেননি- এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর। বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের অধিকাংশের কাছেই মোবাইল ফোন আছে। আর স্মার্ট ফোনের দামও এখন হাতের নাগালে। ফলে দেখা যাচ্ছে মানুষে মানুষে সামাজিক যোগাযোগ কমে গেলেও অনলাইন যোগাযোগটা বাড়ছে। ডিজিটাল ক্যামেরা, স্মার্টফোনে নিজের ছবি তুলে তা ফেসবুক, টুইটারে শেয়ার করে অন্যের মতামত পাওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুললেই দেখা যায়, কেউ না কেউ সেলফি তুলে পোস্ট করেছেন। এছাড়া পথে ঘাটে, মাঠে, শপিংমলে, ড্রয়িংরুমে, বিয়েবাড়ি, পিকনিকসহ নানা অনুষ্ঠানে সেলফি তোলা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমাদের মাঝে অনেকেই নিজের স্মার্টফোনটি দিয়ে সারা দিনই নিজের সেলফি তোলায় ব্যস্ত থাকে। তারা নিজেরাও জানে না এ সেলফির নেশা একসময় মাদকের নেশার মতোই ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকের কল্যাণে আমরা প্রায়শই দেখতে পাই অদ্ভুত ও বিকৃত রুচির কিছু সেলফি। আমি মাঝে মাঝে ফেসবুকে খুব ভাল করে দেখি, কিছু মেয়ে এবং ছেলেদের সেলফি গুলা, চোখ মুখ দাঁত এরম করে, সেরম করে তুলে। ইশ! সেলফি তুলবা ভালো কথা- সেলফি তোলার সময় এমন করে দাঁত মুখ খিঁচাইতে হইবে কেন? এমন কষ্ট দেখে আমারও যে কষ্ট লাগে। আমার খুব মায়া লাগে। এ যুগে যেন সেলফি ছাড়া চলেই না, বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, নানা ঢঙে, বিভিন্ন স্থানে এবং অনেক কিছু সাথে নিয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে এ যাবত অসংখ্য দুর্ঘটনাও ঘটেছে। আমেরিকার সাইকিয়াট্রিস্ট এসোসিয়েশন সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে সেলফি তোলা অবশ্যই একটি মানসিক রোগ। যার নাম দেওয়া হয়েছে “সেলফাইটিস”। নিজস্ব মানসিক সংযম ব্যতীত এর কোন ওষুধ নেই। এ রোগের চরম পর্যায় হলো “ক্রনিক সেলফাইটিস”। এই রোগে আক্রান্তরা দিনে পাঁচবারের বেশি বিরামহীন ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সেলফি তোলেন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করেন। সেলফি তুলতে চেয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, হয়তো ভবিষ্যতে আরও ঘটবে। বিশেষ করে ব্যতিক্রমী সেলফি তুলে ইতিহাস হতে গিয়ে অনেক তরুণ-তরুণী সত্যি সত্যিই ইতিহাস হয়েছে। বতর্মানে যে যত বেশি বিপদজনক সেলফি তোলতে পারে সে বেশি জন প্রিয়। সেলফি তুলতে গিয়ে প্রান হারানোর সেলফি।
▪️বরগুনার তালতলীর ট্যাড়াগিরি ইকোপার্কে কুমিরের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে দর্শনার্থী আসাদুজ্জামান রনি প্রাণ হারায়। কুমির তাকে গভীর পানিতে টেনে নিয়ে যায়। এতে তার মৃত্যু হয়।
▪️পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনা ও তিন বোনের শেষ সেলফিটা, দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে গেছে । বর্তমানে সেলফি একটা মানসিক রোগ। দিনদিন কিছু পাগলের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে; ফেসবুকে খালি সেলফি আর সেলফি !!
▪️বিবাড়িয়ায় সেল্ফী তুলতে গিয়ে দু’কিশোর ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে।
▪️বরগুনার ইকো পার্কে সেল্ফী তোলার সময় এক যুবক কুমিরের আক্রমণের শিকার হয়ে প্রাণ হারায় ৷
▪️অস্কার অটেলো আগুইলার নামের এক তরুণ বন্ধুদের সাথে মদ পান করে একটি পিস্তল নিয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে ভুলক্রমে নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে দেন। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
▪️রেগাইটন জাডিয়েল নামের একজন মোটরবাইক চালানো অবস্থায় সেলফি তুলতে যান এবং দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যুবরণ করেন।
▪️ ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার সময় পড়ে যান জিনিয়া লেগ্নাটেভার। একটি বৈদ্যুতিক তারের ওপর পড়ে গেলে মারাত্মক শকে তাৎক্ষণিকভাবেই মৃত্যু হয় তাঁর।▪️পর্তুগালের একদম্পতি কাবো ডা রোকা পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার সময় প্রায় ২০০ ফিট উচ্চতা থেকে পড়ে মারা যান।
এ রকম অনেক দুর্ঘটনার খবর দেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাওয়া যায়। সবশেষে একটাই কথা বলবো সেলফি নিয়ে, ভার্চুয়াল লাইফ নিয়ে, মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি যেন কাউকে গ্রাস না করে ফেলে সেই কামনা রইলো। ভালো থাকুন সবাই।
লেখক: আবু জাফর শিহাব।