
সামনেই জাতীয় নির্বাচন, কত জল্পনা-কল্পনা, কত রাজনৈতিক চাল-প্যাচাল, কত তাল-বাহানা, সর্বশেষ কত খেল? কে?, কাকে?, কত দেখাতে পারে? কে কার পাঁকা ধানে মই দিতে পারে, সব কিছুই গোপনে বা প্রকাশ্যে চলছে। এক কথায় চলিতেছে নির্বাচনী সার্কাস। চলিতেছে চলুক, আমরা আম জনতাও দেখতে থাকি আর সময়ের অপেক্ষায় থাকি, যদি সুযোগ মিল্লা যায়? তখন দেখাবে জনগণের আসল খেল, কত ধানে কত চাল।
এইবারের নির্বাচন নিয়ে একটু বেশিই কথা হচ্ছে তার একমাত্র কারণ জোরালোভাবেই বলা যায়, ২০১৪ এর ৫ ই জানুয়ারির ১৫৪ জনের বিনা ভোটের জয় লাভ করা। সেই নির্বাচন নিয়ে গত পাঁচ বছরের এমন একটি দিন ছিলো না, যে দিনটিতে কথা হয়নি। সেটা সর্বত্র, চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে খবরের কাগজ বা টিভির পর্দায়। তাই বলাই যায়, সেই নির্বাচনের সকল বিষয়াদি জনগণের মনে হয় এখন মুখস্থ আছে। তাই এটা নিয়ে আর পুরানো কাসুন্দি বেশি ঘাটার প্রয়োজন নাই বলেই মনে হয়। তারপরেও এই বিষয়ে একটি তুলনা যোগ্য আলোচনা করতেই হয়, বর্তমানের কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষীতে।
লক্ষ্যণীয় যে গত কিছুদিন পূর্বেই ৭১ টিভির পর্দায় একজন নারী সাংবাদিক ” মাসুদাভাট্টি” ( যদিও ব্যক্তিগতভাবে একজন সাংবাদিক কে সাংবাদিক বিশেষণেই দেখি, ঘটনার পরম্পরায় এখানে নারী সাংবাদিক ব্যবহার করতেই হচ্ছে ) আর ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের টিভি টকশো নিয়ে যা হয়ে গেলো বা আজ অব্দি হচ্ছে! তা সত্যি ভাবিবার বিষয় বটে। দেশ কে একটি অনাকাঙিক্ষত বিষয় দেখতে হলো, সাথে ওনাদের দুজনের ব্যক্তিগত অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো ? যা একে অপরকে দোষাদোষী, রাগারাগি, যুক্তি তর্ক কিংবা ক্ষমা চাওয়া না চাওয়া, প্রকাশ্য চাওয়া বা গোপনে চাওয়া,কত কিছু! সর্বান্ত্য প্রশ্ন চলে এলো ” নারী-পুরুষ “!
লক্ষ্য করুণ, মাসুদা ভাট্টি, একজন বড় মাপের সাংবাদিক। লেখেন ভালো, বলেনও ভালো। তারপরেও বলতেই হবে, দেশের কতজন মানুষ ওনাকে চিনতো? আর এখন ওনাকে দেশের প্রায় সকলেই চেনে। হোক সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কল্যাণে । ভাট্টি, উনি একজন পাকিস্তানি বিয়ে করেছিলেন, কেন একজন পাকিস্তানিকে বিয়ে করেছিলে? সেটা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আমি করছি না, এটাকে ওনার ব্যক্তিগত বিষয় ভেবে। আবার ডির্বোস হয়েছে, সেটাও প্রশ্ন হচ্ছে, আমি করছি না, ব্যক্তিগত ভেবে।তবে যে প্রশ্নটি না করেই পারছি না, সেটা হলো ” নৈতিকতা” নিয়ে । এই নৈতিকতা বিষয়টির সাথেই শতভাগ মিল রয়েছে ২০১৪ এর ৫ ই জানুয়ারির নির্বাচনের। কোথায় এবং কেমন করে মিল আছে? সেটা একটু পরে আসি।
এবার আসি আরেকজন, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের ব্যাপারে। এই ভদ্রলোকের ওনার নিজের একটি অতি প্রচলিত শব্দ যা কিনা উনি প্রায়শই ব্যবহার করেন, আর তা হলো ” শিক্ষিত মানুষ “। এই ভদ্রলোক নিজেও একজন উচ্চমার্গের শিক্ষিত মানুষ বটে। তবে এটা বলতেই হবে, ওনার কথাবার্তা মোটেও প্রাঞ্জল নয় এবং মার্জিত তো অবশ্যই নয়। প্রকাশ্যে উনি দেশের সাবেক এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে যে ভাষায় কথা বলেছেন, সেটা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক টকশোতে ওনার মুখে এই দুই প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে বলতে শুনেছি ” এইগুলা কোনো রাজনীতিবিদই না ” ! অথচ উনি ” শিক্ষিত মানুষ” এই শব্দটি দিয়ে কথা বলেন। মির্জা আব্বাস কে নিয়ে উনার সেই বিখ্যাত উক্তি ” বাস ড্রাইভার “ সকলেই জানেন। অথচ উনি ভুলে গেছেন বঙ্গবন্ধু নিজেও রাজপথের রাজনীতিবিদ ছিলেন ( কেউ আবার ভাববেন না, আমি কোনো তুলনা করছি) । আমি শুধু বলতে চাচ্ছি, মির্জা আবাস রাজপথের রাজনীতি করেই এতদূর এসেছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্ব পালন করেছেন, সর্বোপরি একজন রাজপথের পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদকে নিয়ে এ ভাষা ব্যবহার, একেবারেই অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করি। আর তারেক জিয়া, মাহী বি চৌধুরী বা আরো অনেক কে নিয়ে নিয়ে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, সেটা না হয় বাদই দিলাম। মাসুদা ভাট্রী এই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে ওনার ভাষার ব্যবহার সত্যি দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক। যদিও উনি পরবর্তীতে ফোন করেছেন, ৭১ টিভিকে চিঠি লিখেছেন, এটা ছিলো রাজনৈতিক চরিত্রহীনতার কথা বলেছেন বা বুঝিয়েছেন, আগরুম বাগরুম । সেই দিনের টকশো টি আমার দেখা হয়েছে। সত্যি বলতে ওনার বলার ভঙ্গিতে একটুও মনে হয়নি, উনি রাজনৈতিক চরিত্রের কথা বুঝিয়েছেন ( ব্যক্তিগত মত) , উনি রাগাশ্রিত হয়ে শব্দটি বলেছেন ডেমকেয়ার হিসেবে ( যা আমার কাছে মনে হয়েছে) অথবা জিব্বা থেকে ফুঁসকিয়ে বেড় হয়েছে। যেহেতু উনি প্রকাশ্য বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ওনার সেই একই মিডিয়ায় প্রকাশ্য ব্যাখ্যা এবং মার্জনা প্রার্থনা করা উচিত ছিলো। শিক্ষিত মানুষের অতি নিকটের একটি উদহারণ আমাদের নিকট আছে, ” ডাঃ জাফরুল্লা” সাহেব ( আবার ডাঃ জাফরুল্লা সাহেবের বিষয়টি নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে, সেটা ভিন্ন বিষয় এবং ঘৃণা করি)। আমি এখনও ধারণা করি ব্যারিস্টার সাহেব ” চরিত্রহীন” কথাটি অনেকটা ডেমকেয়ার মনে করে বলেছেন। এখানেও আবার ব্যারিস্টার সাহেবকে নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে, এটাও অনাকাঙিক্ষত। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ” টিউন মেক দি মিউজিক “। ঠিক একইভাবে বলা যায়, বাংলায় “শালা” শব্দটি ব্যবহার করে বন্ধুত্ব বুঝানো যায়, আবার অপমানও বুঝানো যায় । প্রশ্ন হলো, আপনি কোন সুরে, কখন এবং কোথায় শব্দটি ব্যবহার করছেন। সেটাই পার্থক্য তৈরি করে।
এবার আসি মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে। মাসুদা ভাট্টি এবং ৫ ই জানুয়ারির নির্বাচন । এখানেও একটু কথা বলে নেওয়া বা পরিষ্কার করা ভালো। জামাত নামক দলটিকে আমি কোনো ভাবেই মানতে পারি না। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে এই নামে যুদ্ধ জয়ী স্বাধীন দেশে কোনো রাজনৈতিক দল কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। ঠিক যেমনটি শতভাগ গণতন্ত্রের দেশ ইউরোপের জার্মানিতে ” নাৎসি পার্টি “ কোনো কার্যক্রম করতে পারে না। কেন? ইতিহাস বলার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নাই। এই জামাত নামক দলটিকে নিয়ে আমাদের দেশের বড় দুই দল অনেক কু রাজনৈতিক খেলা খেলেছেন, এটার স্পষ্ট বন্ধ হওয়া উচিত। সকলেই জানেন ব্যারিস্টার সাহেব আর ভাট্রীর যে কথোপকথন তার কারণও এই জামাত নামক দলটি।
প্রশ্ন হলো, ৫ ই জানুয়ারির নির্বাচনের সাথে ভাট্টির মিল কোথায়? বা মুদ্রার এক পিঠ কি করে? আবারো বলছি, হ্যাঁ মুদ্রার একই পিঠ। লক্ষ্য করুণ, ৫ ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের উঁচু মহল থেকে নিচু মহল পর্যন্ত সকলেই বিগত পাঁচ বছর একটি কথা বলে চলেছেন ” ৫ ই জানুয়ারির নির্বাচনটি নৈতিকভাবে সঠিক ছিলো না” কিন্তু আইনগতভাবে অবশ্যই সঠিক। এখন প্রশ্ন হলো যা নৈতিকভাবে সঠিক নয় তার আইনগত বৈধতা দেওয়ায় , আইন নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। বলাই যায়, তাহলে সরিষাতেই ভুত আছে।
ঠিক একইভাবে ভাট্টির ক্ষেত্রেও একই বিষয় । উনি জামাত, শিবির, স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে সব সময় সরব থাকেন, যা কিনা সত্যি প্রশংসনীয় । তবে এখানেও সেই সরিষার ভুত। উনি একজন পাকিস্তানি কে বিয়ে করেছিলেন এবং ডির্বোস হয়েছে, তাতে কোনো সমস্যা নাই, তবে ভাট্টি নামটি উনি এখনও কোন নৈতিকতয় রেখে দিয়েছেন ? যদিও এখানেও আইনগতভাবে ঠিক আছে। আপনি স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে সব সময় সরব থাকবেন তবে আপনার সাবেক পাকিস্তান স্বোয়ামির নাম ধারণ করে ? এটা কি দ্বিচারিতা হয়ে যায় না ? সাধারণ জনগণ তো প্রশ্ন করতেই পারে এটা পাকিদের প্রতি কোন প্রেম ? লক্ষ্য করার বিষয় হলো, ব্যারিস্টার সাহেব যখন আপনার ব্যাপারে চরিত্রহীন শব্দটি ব্যবহার করলো, প্রথম দিকে সবার সমর্থনের পাল্লা কিন্তু আপনার দিকেই ছিলো। সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটু নজর দিলেই দেখা মিলে। যেই কিনা আপনার নামটি কোথা থেকে এসেছে, সেটা জানার পর কিন্তু সব উলোট পালোট হয়ে গেলো। তাহলে বুঝন, জনগণ পাকিদের কতটা ঘৃণা করে, সেটা শুধু মুখেই করে না বরং বুকেও করে। অথচ আপনি এখনও মনে হচ্ছে মুখেই করছেন, বুকে নয়। এটা কোনো দোষারোপ কথার জন্য বলছি না। আপনার অবস্থান এবং নৈতিকতার কারণেই বলছি।
তাই বলছিলাম , আইনগত বিষয়টির চেয়েও নৈতিক বিষয়টির গুরুত্ব অনেক বেশি। শুধু আইনের দোহাই দিয়ে পাড় পাওয়া যায় না। যেমনটি ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন আজ অব্দি পাড় পায় নাই, এমনকি ভবিষ্যতেও পাবে না, এটা একটি উদহারণ ইতিহাসেই হয়ে থাকবে।
আমি নিশ্চিত এই সরকার ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যেমন বুক ফুলিয়ে কথা বলতে পারে না, আইনগত বৈধতা (!) থাকা সত্যেও । ঠিক আপনার নামের আইনগত বৈধতা (!) থাকা সত্যেও বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন না। তাই বলছিলাম, দুটো বিষয় মুদ্রার একই রুপ। এখন শুধু আমরা আম জনতা আশা করে আছি, আর কেবলমাত্র আইনগত বৈধতায় কোনো নির্বাচন নয়, নৈতিক বৈধতাও আসুক। প্রার্থনা কেবল সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
বুলবুল তালুকদার
সহকারী সম্পাদক, শুদ্ধস্বর ডটকম