
(দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি)
যখন স্বামীর রক্ত পজিটিভ গ্রুপের, স্ত্রীর রক্ত নেগেটিভ, আর গর্ভের শিশু পজিটিভ।
আগেই বলেছি পজিটিভ মানে D এন্টিজেন বিদ্যমান, আর নেগেটিভ রক্তে D এন্টিজেন নেই।
ধরুন এই দম্পতি প্রথম সন্তানের প্রত্যাশায় আছেন, অর্থাৎ স্ত্রী গর্ভবর্তী। সবকিছু একদম ঠিক, গর্ভাবস্থায় কোন ধরনের জটিলতা নেই। এমন অবস্থায় নয় মাস দশ দিন পর সন্তান প্রসব হবে এটাই কাঙ্খিত।
এই স্বাভাবিক ঘটনা যখন ঘটবে তখন ছোট্ট আরেকটি স্বাভাবিক ঘটনা অজান্তেই ঘটে যেতে পারে। সেটা হলো, নবজাতকের একটু খানি রক্ত মায়ের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। উল্লেখ করেছি, সন্তানের রক্ত কিন্তু পজিটিভ, অর্থাৎ D এন্টিজেন উপস্থিত।
এই একটু খানি পজিটিভ রক্ত, হোক না 0.১ মিলি, যেই মায়ের শরীরে প্রবেশ করবে, তাৎক্ষণিক একটা প্রতিক্রিয়া ঘটবে, যার ফলে মায়ের রক্তে তৈরি হবে বিশেষ ধরনের একটি প্রতিরোধী প্রোটিন, যার নাম এন্টিবডি। এই এন্টিবডির কাজ হচ্ছে যখনই সে পজিটিভ রক্ত পাবে, সেই রক্তের লোহিত কণিকা গুলোকে ভেঙে দিবে।
কিন্তু এন্টিবডি তৈরি হতে হতে তো বাচ্চা জন্ম হয়েই গেল। তবে সমস্যা কোথায়?
হ্যাঁ, এই বাচ্চার জন্য আসলেই কোন সমস্যা নেই। সমস্যা হোল, এন্টিবডি গুলো মায়ের রক্তে বহমান থাকে বহু বছর।
পরবর্তীতে এই মা যখনই পজিটিভ রক্ত গ্রুপের সন্তান গর্ভে ধারণ করবেন, তাঁর এন্টিবডি গুলো গর্ভস্থ শিশুর শরীরে প্রবেশ করবে।
ফলশ্রুতিতে শিশুর লোহিত কণিকা গুলো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত হুড়মুড় করে ভাঙতে শুরু করবে। শিশু দ্রুত হয়ে পড়বে রক্তশূন্য, দেখা দিবে তীব্র জন্ডিস, জন্মের আগেই যুদ্ধের মুখোমুখি ক্ষুদ্রাকায় মানবশিশু!
প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে সাধারণত কোন সমস্যা হয়না। দ্বিতীয় সন্তান থেকে শুরু করে পরবর্তি সন্তানের ক্ষেত্রে তীব্রতা কেবল বাড়তেই থাকে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে প্রথম সন্তানও বিপদে পড়তে পারে। যেমন মায়ের জ্ঞাতসারে বা অজান্তে যদি পূর্বে কোন গর্ভপাতের ইতিহাস থাকে, যদি কোন ভাবে ভুলবশত তিনি পজিটিভ গ্রুপের রক্ত নিয়ে থাকেন।
রক্তশূন্যতা আর জন্ডিসে কি সমস্যা?
রক্তস্বল্পতার জন্য শিশু ফ্যাকাশে আর ভীষণ দুর্বলতা নিয়ে জন্মাবে, খাবেনা বা খেতে পারবে না, এমনকি স্বাভাবিক নড়াচড়া করতেও সক্ষম হবে না। তীব্র রক্তশূন্যতা থেকে হৃদযন্ত্রের কর্যক্রম বিপন্ন হতে পারে, মেডিকেলের পরিভাষায় যাকে বলা হয়, ‘হার্ট ফেইলিউর’। জন্মের আগেই হার্ট ফেইলিউর হয়ে গেলে মর্মান্তিক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সেই শিশু এমনকি প্রাণহীন অবস্থায়ও জন্ম নিতে পারে।
জন্ডিসের মাত্রা বেশি হলে, রক্তের বর্ধিত বিলিরুবিন এক পর্যায়ে অপরিণত মস্তিষ্কে ঢুকে পড়তে পারে। এটা তার মস্তিষ্ক নস্ট করে দিয়ে জীবন শুরু হওয়ার আগেই মহা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। শিশু হতে পারে মানসিক, শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী।
চিকিৎসা?
চিকিৎসা নির্ভর করবে শিশুর রোগের তীব্রতা কতটুকু, কত তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় হল তার উপর। শিশুর অবস্থার উপর নির্ভর করে, প্রধানত তিনটি পদ্ধতির এক বা একাধিক চিকিৎসা প্রয়োজন হবে। এগুলো হলো, ফটোথেরাপি, শিশুর শরীরে রক্ত পরিসঞ্চালন, কোন কোন ক্ষেত্রে শিশুর প্রায় সমস্ত রক্ত পরিবর্তন করে দিতে হয়, যাকে বলে, ‘এক্সচেঞ্জ ট্রান্সফিউশন’।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগ করে আজকাল এমন শিশুদের বেশীর ভাগকেই সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স সহ উপযুক্ত জনবল এবং সরঞ্জামাদি।
তবে অন্য যে কোনো অসুস্থতার মতই এ ক্ষেত্রেও প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। কথাটি এ বিশেষ পরিস্থিতিতে যেন একটু বেশি সত্য।
প্রতিরোধ কি ভাবে করতে হবে?
স্বামী স্ত্রী যদি যথাক্রমে পজিটিভ ও নেগাটিভ গ্রুপের হয়ে থাকেন তবে গর্ভের শুরু থেকে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।
চিকিৎসক গর্ভ চলাকালিন বেশ কয়েক বার মায়ের রক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে শিশুর অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন। আশঙ্কাজনক কিছু ধরা পড়লে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিবেন।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সন্তান প্রসবের পর প্রথম কাজ হবে, অতি দ্রুত শিশুর রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা। যদি শিশু নেগেটিভ হয় তাহলে কিছুই করতে হবে না, আর দশটি স্বাভাবিক শিশুর জন্য যা এখানেও কেবল তাই।
যদি শিশুর রক্তের গ্রুপ হয় পজিটিভ তখন মাকে সন্তান প্রসবের ৭২ ঘন্টার মধ্যে একটি ইনজেকশন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ইনজেকশন টি একটু দামি বটে, তবে নাগালের বাইরে নয়। তার চেয়ে বড় কথা এটি সব জায়গায় সহজপ্রাপ্য নয়। তাই এমন অবস্থায় এটির জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। মায়ের এই ইনজেকশন নেয়া অতিব গুরুত্বপূর্ণ পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে রোগটি প্রতিরোধের জন্য, বর্তমান শিশুর জন্য নয়।
এভাবেই একটু সচেতন, একটু সতর্ক হলেই একটা সন্তান বাঁচবে, বাঁচবে একটা পরিবার, আমাদের প্রিয় পৃথিবীটা হবে আরও সুন্দর।
আসুন সুকান্তের ভাষায় বলি, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’।
দ্রষ্টব্য: অনেক ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী কে বলতে শুনি, আমিও স্বীকার করি, বিষয়টি একদম সহজবোধ্য নয়। তাই চেষ্টা করেছি দুর্বোধ্য অংশগুলো কাটছাঁট করে যতটা সহজে সবার কাছে উপস্থাপন করা যায়। কতটা পেরেছি জানিনা, কেউ যদি উপকৃত হন তাতেই আমার চেষ্টা সফল হবে।
প্রথম অংশ যারা শেয়ার করেছেন তাদের সবাইকে বিশেষ ধন্যবাদ। দ্বিতীয় অংশের ব্যাপারেও আমার অবস্থান আগের মতোই।
লেখক: ডাঃ অর্জুন দে, চিকিৎসক এবং লেখক।