
নিরাপত্তার কথা ভেবেই চলমান শ্রমিক ধর্মঘটের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের ৩৮ ছাত্রীকে বাড়ি পাঠানোর জন্য কলেজ বাসে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এরপরও শ্রমিকদের উচ্ছৃঙ্খলতার হাত থেকে রেহাই পাননি ছাত্রীরা। বাস আটকে চালক ও হেলপারের মুখে কালি (পোড়া মবিল) লেপে দেয় তারা। ছাত্রীদের অনেকের গায়েও পোড়া মোবিল ছুড়ে মারে ও গালিগালাজ করে। বাসের গ্লাস ভাঙচুর করে। ছাত্রীদের অভিযোগ, সড়কে পরিবহন শ্রমিকদের নৈরাজ্য চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ছিল ‘সাক্ষীগোপাল’-এর মতো। তাদের চোখের সামনে এ ঘটনা ঘটলেও তারা কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। তবে পুলিশ ছাত্রীদের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
হামলার শিকার ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রবিবার (২৮ অক্টোবর) দুপুর পৌনে একটার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা পার হচ্ছিলো তাদের বহনকারী কলেজ বাসটি। এ সময় পরিবহন শ্রমিকরা সেটি আটকায়। ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা শিক্ষার্থীদের বহনকারী বাসের গ্লাস ভাঙচুর করে। বাসের চালক মজিবুর রহমানের মুখমণ্ডলে পোড়া মোবিল লাগিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করলে শ্রমিকরা তাদের দিকেও পোড়া মোবিল ছুড়ে মারে। এতে কয়েকজন শিক্ষার্থীর পোশাকে পোড়া মোবিল লেগে যায়। শ্রমিকরা এ সময় অকথ্য ভাষায় তাদের গালিগালাজ করে। বাসের কয়েকটি গ্লাস ভেঙে বাইরে থেকে ভেতরে কালি নিক্ষেপ করে তারা। এ সময় ছাত্রীরা বাস থেকে নেমে যান। পরে বাসটি সড়কের পাশে পার্কিং করে রাখা হয়।
বাসের হেলপার মো. জহিরুল হক জানান, ‘পৌনে একটার সময় সাইনবোর্ড এলাকায় পৌঁছানোর পরেই হঠাৎ দুজন লোক এসে আমাদের বলে, আজ সব বাস বন্ধ। বাস চালাইতাছোস ক্যান? কিন্তু কলেজ বাসের কথা বলায় তারা ছেড়ে দেয়। বাসটি একটু সামনে আগালেই ২০-২২ বছরের ৭-৮ জন যুবক এসে বাসটি আবারও আটকায়। কোনও কিছু বোঝার আগেই তারা ইট ছুড়ে মারে গ্লাসে। তিনটি গ্লাস ভেঙে যায়। বাসের স্টার্ট বন্ধ করার পর তারা আইসা তুই-তুকারি শুরু করে। পরে গালি দিয়ে বলে—ওই, আজ বাস-গাড়ি সব বন্ধ। বাস চালাইতাছোস ক্যান?
তিনি বলেন, ‘জানালা দিয়ে বাসের ড্রাইভার এবং বাসের গেটের সামনে থেকে কয়েকজনে আমার চেহারায় কালি লাগায় দেয়। এরপরেই বাসের শিক্ষার্থীরা বলে ওঠে, আমাদের গাড়ি আটকিয়ে রাখছেন কেন? এটা তো কোনও পাবলিক পরিবহন না। আমাদের বাসায় যেতে দেরি হচ্ছে। এটা বলার পরেই শিক্ষার্থীদের ওপর জানালা আর বাসের গেট দিয়ে পোড়া মোবিল লাগানো ময়লা কাপড় ছুড়ে মারে, যা ১০-১৫ শিক্ষার্থীর গায়ে এসে পড়ে। চেহারা, জামা-কাপড় সব কালিতে ভইরা যায়। এরপর বাস ওইখানে ছাত্রীসহ প্রায় আধঘণ্টা আটকায় রাখে। পরে সামনের কয়েকজনরে আবেদন করলে তারা বাসের গেট খুলতে দেয়। ছাত্রীদের অন্য গাড়ি করে বাসায় চলে যাইতে বলি। এরপর বাস সরিয়ে একপাশে রাখি। ৩-৪ ঘণ্টা পর বাসটি কলেজে নিয়ে আসছি।’
বাসের চালক মুজিবর রহমান বলেন, ‘বাসটিতে ৩৮ জন ছাত্রী ছিল। তারা সবাই সরকারি মহিলা কলেজে পড়ে। ছাত্রী বহনকারী বাসটি সাইনবোর্ড এলাকায় এলেই হামলা করে বাসের গ্লাস ভাঙচুর করে শ্রমিকরা। পরে ছাত্রীদের গায়েও কালি মাখিয়ে দেয়।’
মহিলা কলেজের সমাজকর্ম বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মো. ওয়াজেদ কামাল এই ঘটনা সম্পর্কে বলেন, ‘মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের টেস্ট পরীক্ষা ছিল। অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে আসে। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে গণপরিবহন চলবে না। সেখানে শিক্ষার্থীদের বাসের ওপর কোনও হামলা করার কথা নয়। আর শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার একটা দায়িত্ব আছে আমাদের। এতগুলো শিক্ষার্থী কীভাবে যাতায়াত করবে, তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই বাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠিয়েছি। কিন্তু সেখানেও যে ছাত্রীদের সঙ্গে এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করবে, সেটা বুঝতে পারিনি।’
মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ বেদৌরা বিনতে হাবিব বলেন, ‘পরিবহন ধর্মঘটে আমার কলেজের মেয়েরা হয়রানির শিকার হয়েছে। বাসের গ্লাস ভেঙেছে। মেয়েদের গায়েও কালি ছুড়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছি। মেয়েদের তো সেখান থেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের কলেজের বাসটি বাইরে ছিল। পুলিশ প্রহরায় আমাদের বাস ও বাসকর্মীদের নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু কলেজের মেয়েদের সঙ্গে যে কাজটি করেছে, এই বিষয়টি খুবই নিন্দনীয়।’
শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পরিবহন শ্রমিকরা যখন সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের বহন করা গাড়িতে হামলা চালায়, তখন পুলিশ কিছুটা দূরে ছিল। খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত সেখানে যায়। পুলিশকে দেখে হামলাকারীরা সটকে পড়ে। এরপর পুলিশি পাহারায় বাসটি কলেজে নিয়ে আসা হয়েছে এবং ছাত্রীদের বিভিন্ন যানবাহনে করে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে আমরা ঘটনার সময়ের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে দায়ী ব্যক্তিদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেবো।’
এদিকে ছাত্রীদের গায়ে কালি লেপনের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় বইছে। এক ছাত্রীর কলেজ ড্রেসে কালির ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। তার ছবির নিচে নিন্দা আর ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্তব্য করছেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা।