তখন সবে কলেজে পড়ি। মাথায় ভূত চাপলো ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটা সংগঠন খুলবো। যেই ভাবা সেই কাজ। বাংলাদেশ স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার নামে একটা সংগঠন খুলে ফেললাম। তেজগাঁও কলেজের ক্যান্টিনে বসে। সাথে ছিল মাত্র ৩ জন। বন্ধু মাহমুদ,সুমি আপা আর ছোটবোন রুশনী। চারজনের একটি কমিটি করা হলো। চারজনে বসে গঠনতন্ত্র ঠিক করলাম। তারপর শুরু হলো সদস্য সংগ্রহ। চারদিকে ছোটাছুটি। অনেকেই টিটকারী মারে। বাঁকা সুরে কথা বলে। তারপরও মাসখানেকের মধ্যে প্রায় দুইহাজারের বেশি ছেলেমেয়ে আমাদের সংগঠনের সদস্য হলো। সংগঠনের সভাপতি হিসেবে আমি ক্রেডিট পেলেও এই সদস্য সংগ্রহে আমার থেকেও বেশি ভূমিকা ছিল মেয়ে দুটোর। অথচ চারদিকে নাম কেবল আমারই হলো। তো এত সদস্য হবার পর ভাবলাম একটা অনুষ্ঠান করব। সেইসময় সম্ভবত শরৎকাল চলে। তাই শরৎ উৎসব করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে একটা সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম করা হবে। তেজগাঁও কলেজের সাবেক ভিপি বর্তমান ২৬ নং ওয়ার্ডের কমিশনার ফরিদুর রহমান খাঁন ইরান ভাইকে বলতেই তিনি তেঁজগাও কলেজের পুরো অডিটোরিয়ামটাই কয়েকদিনের জন্য দিয়ে দিলেন রিহার্সেল করতে। রিহার্সেল এর আগে শুরু হলো অডিশন। আমাদের সদস্যদের মধ্য থেকে অনেকেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে চায়। তো অডিশনে একটা মেয়ে তার সহজাত অভিনয় দক্ষতায় ভালই নজর কাড়লো। পরবর্তীতে তার সাথে বেশ ভাল একটা বন্ধুত্ব হয়েছিল। অনুষ্ঠানও ভালই ভালই মিটে গেছিল। এখানেও মেয়েদের অবদান অনেক বেশি। তো সেই মেয়েটির কথা একটু আলাদা করে বলতেই হয়। পরর্বতীতে আমার জীবনে এবং সংগঠনের ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখুনি জীবনের প্রথম বই লিখে ফেলেছি। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী পটভূমিতে লেখা একটা ছোটখাটো উপন্যাস। নিজেকে তখন লেখক বলে ভাবতেই কেমন যেন একটা লাগতো। সেই একটা ভাবে থাকতাম সবসময়(এখন শুধু হাসি পায়। লেখালেখির কথা পারলে এখন চেপে যাই সব জায়গায়)। তো মেয়েটির সাথে পরিচয় হবার পর বুঝতে পারলাম মেয়েটি খুব চঞ্চল। ওকে আমার সেই বইটি পড়তে দিলাম। তখন আমার বয়স কত হবে আর? ১৮ পেরিয়ে ১৯ ছুঁই ছুঁই। আর মেয়েটিরও ১৬ পেরিয়ে ১৭ তে পড়েছে মেবি। বালিকাই বলা যায় তাকে। তো সে যেদিন বইটা নিয়ে গেলো তার পরেরদিন বইটা নিয়ে এসে আমাকে বললো,আচ্ছা বইটা কি সত্যিই তুমি লিখেছ? আমি একটু রেগে গিয়েই বললাম,’তোমার কি বিশ্বাস হচ্ছে না?’ তখন সে বলল,না মানে আমি তো জানতাম লেখকরা সব বড় বড় দাড়ি গোফওয়ালা হয়। আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। দেখলাম বইয়ের কাভারে আমার নাম আর ছবির উপরে আচর কাটার দাগ। সে আচর কেটে দেখেছে ওগুলো আমি পরে লাগিয়েছি কি না। এখন এই লেখাটা লেখার সময়ও হাসি পাচ্ছে আমার একটা কারণে। কারণ সেই ঘটনার প্রায় ৫ বছর পেরিয়ে গেছে,আমারও অলরেডি ৭টা বই বাজারে এসেছে কিন্তু দাঁড়ি গোফটা আজও হয়নি ঠিকমতোন। এখনও অনেকটা আগের মতোই আছি। হিহিহি। তো সেই বালিকার সাথে দিন দিন ঘনিষ্ঠতা বাড়তেই থাকলো। এক সাথে সংগঠনের কাজ করা,ঢাকার রাস্তায় রোদে পোড়া,বৃষ্টিতে ভেজা,উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো চলতেই লাগলো। আবার কখনো শহীদ মিনারে,প্রেসক্লাবের সামনে বিভিন্ন আন্দোলনে একসাথে পুলিশের হামলার শিকার হওয়া,মিছিল করা এসবও চলতে লাগলো। সবসময় মিছিলের আগে আগে থাকতাম। আর সার্বক্ষনিক আমাকে নিরাপদে রাখার দায়িত্ব ছিল তার। বহুবার পুলিশের সাথে সামনাসামনি ঝগড়া করেছেন তিনি আমার জন্য। একদিন টিএসসি ক্যাফেটেরিয়ার মাঠে সবুজ ঘাসের উপর আমি শুয়ে আছি আর বালিকা বসে আছে। সামনেই বইমেলা। বালিকা বললেন,এবার একটি বই লেখো। আমি বললাম,ভাল লাগেনা। তিনি বললেন,তুমি মুখে মুখে বলো আমি টাইপ করছি। তার হাতে তখন ল্যাপটপ ছিল। আমি মজার ছলে বলতে লাগলাম। তিনি টাইপ করছেন। নাম দেয়া হলো একটি বুলেট ও কয়েকফোঁটা রক্ত। গল্পের মূল মেয়ে চরিত্রের নাম কি দেব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দুষ্টুবুদ্ধি চাপলো মাথায়। মজা করেই নামটা দিয়ে দিলাম। মাত্র তিন দিনে বইটি শেষ হলো। আমি বলতাম আর তিনি টাইপ করতেন। বইটা লেখা শেষ হলে খ্যাতনামা একজন সাংবাদিক ও সাবেক কমিউনিস্ট নেতা আমার চোখে যিনি রিয়েল হিরো শ্রদ্ধেয় মাহমুদ জামাল কাদেরী আংকেল প্রুফ দেখে দিলেন। আর ভূমিকা লিখে দিলেন দেশের আলোচিত রাজনীতিবীদ শ্রদ্ধেয় মাহমুদুর রহমান মান্না আংকেল। যথারীতি বইমেলায় প্রকাশ পেলো বইটি। হইহই করে চললো। প্রায় দিনই মেলায় বইয়ের স্টলে বালিকা আমার সাথে থাকতো। যখন অসংখ্য মানুষ বইটি কিনতো,অটোগ্রাফ নিতো মাঝে মাঝেই তখন দেখতাম বালিকার চোখের কোনে অশ্রুফোঁটা। নিঃসন্দেহে আনন্দশ্রু ছিল তা। বই লেখা বা প্রকাশে আমার কিন্তু কোন অবদান ছিল না তেমন। সব অবদান ছিল মেয়েটার। হয়তো ও না বললে বইটা আমার লেখাই হতো না। বইটির মূল মেয়ে চরিত্রে নাম ছিল ’ঈশিতা’।
বালিকার নামে নাম রেখেছিলাম। সেদিন বালিকার চোখে যে খুশীর ঝলক দেখেছিলাম তার দাম এই পৃথিবীর সবকিছুর থেকে বেশি ছিল হয়তো। একজন বন্ধু হিসেবে,গাইড হিসেবে রাজপথ থেকে শুরু করে জীবনের অনেক ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অপরিসীম। তার সহযোগিতা,তার প্রেরণা না পেলে জীবনের এই স্বল্প অর্জনটুকু কখনো আলোর মুখ দেখতো না। সব সম্পর্কই চিরদিন টেকে না। একটা সময় পারিবারিক কারণে তিনি অনেকখানি দূ আমারও তখন সবকাজে ভাটা পড়ে গেল। সারাদিন খাই দাই ঘুমাই আর মাঝে মাঝে ক্লাসে যাই। তখন তো আবার ইউনিভার্সিটিতে যাই। সেই সময়ে আবার পরিচয় হলো আরেক বালিকার সাথে। তিনি আগেরজনের থেকে আরো বেশি দায়িত্বশীল একজন। সকালে ঘুমিয়ে থাকতাম উনি ফোন করে উঠিয়ে দিতেন। আমি ঘুম জড়ানো কন্ঠে ফোন ধরতাম,উনি বলতেন আজ না তোমার মিছিলে যাবার কথা? ফ্রেশ হয়ে মিছিলে যাও। আর হ্যা তুমি কিন্তু মিছিলের সামনেই থাকবে। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন,মিছিল মিটিংয়ে যাওয়া শুরু হলো আবার নিয়মিত। এখানেও কিন্তু সব অবদান শুধুই মেয়েটির। শেষ প্রান্তর,নৈঃশব্দবতী,চৈত্র’র বর্ষা ও বাসন্তীর পাপমোচন সহ অসংখ্য কবিতা,গল্প শুধু তার প্রেরণাতেই লিখেছি। উনি না চাইলে সত্যিই বলছি আমার আর সেসব লেখা হতো না। লাস্ট ঈশ্বর সমাচার লিখলাম,এখন নদীর নামটি নৈঃশব্দবতী লিখছি এই লেখাগুলোর পেছনে তার প্রত্যেক্ষ অবদান না থাকলেও পরোক্ষ অবদান কিন্তু আছেই। তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নতুন আরেকটা সংগঠন খুললাম। ভয়েজ অব বাংলাদেশ নামে। অসংখ্য ছেলেমেয়ে এগিয়ে আসলো সাথে। ছেলেদের চাইতে মেয়েরা বেশি অবদান রাখতে লাগলো সংগঠনের কাজে। কয়েকটা প্রোগ্রাম করেছি এরই মাঝে। রাত জেগে পোষ্টার বানানো। এক্সিজিবিশনের ফটো টানানো। প্রচন্ড গরমে জ্যাম ঠেলে ঢাকার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত বিভিন্ন স্কুল কলেজে গিয়ে ইনভাইটেশন দিয়ে আসা সবকিছু ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে করেছে মেয়েরা। প্রতিনিয়তও করছে। আন্দোলন সংগ্রামে কোথাও পিছিয়ে নেই মেয়েরা। কিছুদিন আগে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে সমানে সমান উপস্থিতি তার প্রমাণ করে। সুতরাং নারী পুরুষের সামাজিক অধিকার সমান হোক। নারী জাগরণ ঘটুক দেশে এটাই কাম্য। নারী পুরুষে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। আমরা সবাই মানুষ এটাই হোক আমাদের মূল পরিচয়।