
বেবী হালদার । ১৯৭৩ সালে কাশ্মীরে জন্ম বেবীর.. বেবী হালদার.. বেবীর বাবা চাকরি করতেন সেনা বিভাগে.. প্রচন্ড মদ্যপ এবং অত্যাচারী.. বেবী ধরা ধামে আসার পর কেউ শঙ্খ বাজায় নি কেউ “লক্ষী এল ঘরে” এসব কথাও বলেনি.. জ্ঞান হওয়া ইস্তক কোন রাইমস, বারবি ডল, টুইনকল টুইনকল লিটিল স্টার এসব কিছু ছিল না কস্মিন কালে.. বাবার চিৎকার, মায়ের কান্না, এসব রোজকার ব্যাপার.. মেয়েদের প্রথম ভালোবাসা বাবা কে রোজ দেখেছে তার হতভাগী মা এর উপর চড়াও হতে.. মারধোর, ভাঙ চুর বেবীর শৈশবের “সুখ স্মৃতি”.. গোলাপি ফ্রক, দুধ কোনোটাই জোটেনি বেবীর কপালে.. বাবার কারন সুধার নেশায় শৈশবের প্রয়োজনীয় জিনিস মেলেনি.. বেবী একমাত্র বোনের কোলেই মানুষ.. মা এর সময় কোথায়?? পাঁচ বাড়ি কাজের শেষে রাতে ফিরে রোজ পাইকারি রেটে মার.. দিনের পর দিন এত অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বেবীর মা বেবী কে আর বোন কে নিয়ে মুর্শিদাবাদ এ মামারবাড়ি ফিরে আসে.. সেখানেও মামারবাড়ি ভারী মজা..”কিল চড়” নাই.. এসব কপালে নেই মারধোর গঞ্জনা ডালভাত.. বাঁচার অক্সিজেন ক্রমশ ফুরিয়ে আসতে থাকে বেবীর.. দারিদ্র্য, অনাহার এসব সহ্য করতে না পেরে বেবীর মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন.. নতুন জামার বদলে নতুন বাবা পেল বেবী.. নতুন সংসার এর বীজ বপন হল দুর্গাপুর এ… নতুন বাবার পেশা ছিল ড্রাইভারি.. প্রথমদিকে খাওয়া পরা জুটলেও “ঘুম” জোটেনি বেবীর.. রোজ রাতে পরম্পরা মেনে মা কে প্রচন্ড পেটাতো বেবীর “বাবা”… ঘর বর কোন ভাগ্য ভাল ছিল না বেবীর মা এর.. বেবী বোনের সাথে এরই মধ্যে বড় হতে থাকে.. স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হয় বেবী.. টিফিনের স্বপ্ন কখনো দেখেনি বেবী.. সরকার বাহাদুর এর বানানো রাস্তার কলের জল আর কপাল সার্ফ এক্সেল হলে দু একদিন রুটি.. তাও ক্লাস সিক্সের পর স্কুলের মায়া ত্যাগ করতে হয় বেবী কে.. সামনেই দিদির বিয়ে..এত খরচ আবার পড়াশোনা?? পাগল নাকি?? আর মেয়েছেলের অত লেখা পড়ায় কাজ কি রে ভাই?? দিদির বিয়ের কিছুদিন পরেই বেবীর জন্য ভারী ভাবনা হল সৎ বাবার..মেয়েটা কে পাত্রস্থ না করলেই নয়.. বেশি না ১২ বছর বয়সেই পুতুল খেলা , রান্নাবাটি চু কিত কিত দড়ি লাফ খেলার বয়সে বেবীর বিয়ের ফুল ফুটল.. বিয়ে হল ২৬ বছর বয়সী সজ্জা শিল্পী বরের সাথে.. ছোট খাট কাজ ও করে টুকটাক.. মেয়েরা বিয়ের পর যে স্বপ্ন নিয়ে শ্বশুর বাড়ী যায় .. অষ্ট মঙ্গলার কদিন পরেই বরের হাতে কাঠের তক্তার মার খেয়ে সে স্বপ্ন ফাটা বাল্ব.. নিত্যদিনের মার বাঁধা.. রান্নায় নুন কম হোক বা বিছানায় সঙ্গ.. পান থেকে চুন খসলেই চ্যালা কাঠ, লাঠি.. এসবের আদর.. তবে বেবীর স্বামী মাইরি এক কথায় লোক.. ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নেওয়ার সময় কথা দিয়েছিল “বেবীর পেট কখনও খালি রাখবে না”.. ভদ্রলোকের এক কথা সে খালি রাখেনি.. ১৩ বছর বয়সে প্রথম সন্তান সুবোধ এর জন্ম দেয় বেবী.. ১৪ বছর বয়সে ডবল প্রোমোশন.. এক ছেলে এক মেয়ে.. যে বয়সে মেয়েরা আয়নায় নিজেকে দেখে.. নতুন লিপস্টিক টা মানিয়েছে কি না.. সরস্বতী পুজোয় কোন শাড়িটা পরলে পাড়ার দাদা রত্নটি চোখ ফেরাতে পারবে না সেই নিয়ে বান্ধবীদের সাথে আলোচনায় মাতে… সেই বয়সে বেবী বাচ্চার ন্যাপি পাল্টাতে , দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত.. সেই ফাঁকে কৈশোর জানলা দিয়ে হুশ শ শশ.. বেবী মনেপ্রাণে আশা করেছিল এবার হয়ত পাল্টাবে সব.. আদর সোহাগ পাবে.. হল তার উল্টো.. সন্তান জন্মের পর বেবীর স্বামী দেবতা হসপিটালে দেখতে এসেছিলেন একবার.. না না সন্তান কে দেখতে নয় .. নবজাতকের মুখ দেখে আত্মীয় স্বজন রা যে টাকা দেন সেই টাকার জন্য.. টাকা ছাড়া সন্ধ্যা মৌতাত জমে নাকি??? আপনারাও যেমন.. বাড়ি ফেরার পর অত্যাচার টাকার দাবি মেরে ফেলার হুমকি এসব ইন্সনটিভ পেত বেবী.. শিশু দের দুধের টাকাও লুকিয়ে রাখতে হত.. খোঁজ পেলে সেটাও… নিজের সন্তানদের বাঁচানোর জন্য একদিন বর কাজে যেতেই একদিন বাচ্চাদের নিয়ে পালাল বেবী.. সামনে স্টেশন.. গিয়ে দেখল একটাই ট্রেন দাঁড়িয়ে.. কোন ট্রেন কোথায় যাবে এসব ভাবে কোন আহাম্মক?? বাঁচার জন্য সন্তানদের নিয়ে ওই ট্রেনেই ভিড় কামরায় উঠে বসল বেবী.. বাঁচার জন্য.. অনেক অনেক দূরে পালাতে হবে.. বিধাতা বোধহয় সেদিন অন্তরালে মুচকি হেসে ছিলেন.. ট্রেন এসে থামল দিল্লী.. প্রথম কদিন জমানো টাকায় কাটিয়ে কোনরকমে দুটো বাড়ি কাজ জুটিয়ে নীল বেবী..সকালে ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করতে যেত বেবী..সারাদিন গাধার খাটুনি তারউপর চড় চাপটা.. মালকিন রা হাতের সুখ করতেন.. “বিশ্রাম” শব্দ বেবীর অভিধানে নেই.. কাজের ফাঁকে বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য ১০ মিনিট সময় চাওয়ায় মালকিন বাচ্চাদের টেনে অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে বলেছিলেন “আগে কাজ পরে খাওয়া”..এত কষ্টের মধ্যেও বাচ্চাদের পড়াশোনা আদর যত্নে খামতি রাখেনি বেবী… জীবন তখন অন্য রূপকথা বুনছিল বেবীর জন্য.. এক গোয়ালার সুপারিশে অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক প্রবোধ কুমারের বাড়ি কাজ পেল বেবী.. প্রবোধ বাবু সম্পর্কে মুন্সি প্রেমচন্দ এর প্রপৌত্র..বেবী এই বাড়িতে কাজে এসে দেখল এই বাড়ি অন্যরকম.. বাচ্চাদের কেউ বকে না উল্টে ভাল জামা খাওয়া দাওয়া ফল এসব দেয় বেবীর হাতে.. বেবী আনন্দে আত্মহারা.. বিয়ের আগে মদের পয়সার জন্য বেবীর লাল নীল মলাটের বই গুলো বাবা কেজি দরে বেচে দিয়েছিল.. সেরকম লাল নীল রঙিন বইতে বাড়ি ভর্তি.. বেবী কাজের ফাঁকে বই গুলো ঝেড়ে মুছে রাখে উল্টে দেখে.. বাচ্চাদের ছবি দেখায়..অধ্যাপক প্রবোধ বাবু একদিন খেয়াল করলেন এই মেয়েটা আর পাঁচটা কাজের মেয়ের মত নয়.. সে অবসরে বই পড়ে.. পাতা উল্টে দেখে… একদিন কৌতুহলী হয়ে তিনি বেবীকে জিগ্যেস করলেন-” তুমি পড়তে জানো”?????… বেবী সলজ্জ ভাবে জানাল হ্যাঁ… মুখচোরা মেয়েটিকে চিনে নিলেন জহুরী চোখ দিয়ে প্রবোধ বাবু.. খুশি হয়ে নিজের গ্রন্থাগার এর চাবি বেবী কে দিয়ে পড়তে বললেন… বেবী হাতে স্বর্গ পেল… রাতে বাচ্চাদের শুইয়ে রোজ পড়তে লাগল বেবী.. প্রথমে প্রবোধ বাবু বেবী কে পড়তে দিলেন তসলিমা নাসরিনের “আমার মেয়েবেলা”… এরপর একে একে তসলিমার সব বই পড়ে ফেলল বেবী.. বেবীর বই এ দাগ দিয়ে লেখার আগ্রহ দেখে প্রবোধ বাবু পেন ও নোটবুক উপহার দিলেন বেবী কে.. বেবী লজ্জায় লাল.. প্রবোধ বাবুর উৎসাহে বেবী সারাদিনের কাজের পর লিখতে শুরু করল…সব মনের কথা স্মৃতি সব না বলা কথা লিখত বেবী.. মা, বিয়ে সংসার সন্তান, বোনের বিয়ের পর জামাইবাবু কিভাবে টাকার জন্য বেবীর বোন কে মেরে সিলিঙে টাঙিয়ে দিয়েছিল সব.. কয়েকমাস টানা লেখার পর বেবী প্রবোধ বাবু কে খাতাটা পড়তে দিল.. প্রবোধ বাবু পড়ে কিছু বলতে পারেন নি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন আর বেবীকে আশীর্বাদ স্বরূপ লেখাটি গুছিয়ে টাইপ করে দিয়েছিলেন নাম দিয়েছিলেন “আলো আধারি”… বইটি প্রথমে হিন্দিতে প্রকাশিত হলেও ২০০২ সালে কলকাতার রোশনি পাবলিকেশন বইটি প্রকাশ করে বাংলায়… প্রকাশ হওয়ার পরই ম্যাজিক… বইটি দারুন জনপ্রিয়তা অর্জন করে… মিডিয়া সংবাদ মাধ্যম এ আলোড়ন সৃষ্টি হয়….আগামী দুই বছরের মধ্যে নতুন সংস্করন হয়ে বইটি ইংরেজি ভাষা ও মালয়লম ভাষায় প্রকাশ হয়… New York Times বইটিকে বেস্ট সেলার হিসেবে বিবেচিত করে… ২১টি ভাষায় বইটি প্রকাশ হয়… সমগ্র বিশ্ব জুড়ে বইটি নিদারুণ খ্যাতি অর্জন করে… ২০০৮ সালে জার্মানি তে সর্বাধিক পঠিত বই হিসেবে বইটি পুরষ্কার লাভ করে… যে বেবী নদীর ওপারে কাশফুল দেখেনি সেই বেবী জার্মানির ডুসেলদর্ফ, হ্যালে, ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে আমন্ত্রিত হয়ে বিশেষ সম্মান অর্জন করে… “আলো আধারি… ইষৎ রূপান্তর ” বেবীর লেখা বই গুলি সমগ্র বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করে… বাকিটা ইতিহাস.. দুই ছেলে সুবোধ আর তাপস আর মেয়ে প্রিয়া কে নিয়ে দিল্লিতে থাকেন বেবী হালদার.. খ্যাতি তাকে বদলায়নি… সাধারণ জীবন যাপন ই তার পছন্দ…. কলকাতা তেও বাড়ি তৈরী করেছেন বেবী… কলকাতার দুর্গা পূজার বিশেষ অনুরাগী তিনি..কলকাতার খাওয়া, কলকাতার পুজো খুব মিস করেন যে…. ” যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে”..