
OLYMPUS DIGITAL CAMERA
গত জুলাই মাসে প্রকাশিত আমার বই ” নীলকণ্ঠে স্বগতোক্তি “ তে একটি আর্টিকল আছে দেশপ্রেম নিয়ে । আজকের লেখাটি তার কিছুটা পুনরাবৃত্তি হলেও চমত্কার একটি উদাহরণের কারণেই আজকের লেখা । তাছাড়া আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি দেশপ্রেম নিয়ে শতবার লেখা উচিত আর শতবার লিখতে গিয়ে কোনো লেখার পুনরাবৃত্তি অবশ্যই মার্জনা পেতে পারে । কেননা ,আমাদের দেশে দেশপ্রেম কি বা দেশপ্রেমের সংজ্ঞা নিয়ে প্রায় সকলের মাঝেই একটু দ্বিধান্বিত বা দ্বিধাগ্রস্ততা দেখতে পাওয়া যায় । এই দ্বিধাগ্রস্ততা কোনো চিন্তার গভীরতা থেকে আসে বলে মনে হয় না , বরং এটা এক প্রকার খামখেয়ালিপনা বলেই প্রকাশিত হয় । কোটি বাঙালি প্রবাসে আছে , অনেকের মুখেই অনবরত শোনা যায় এদের দেশ প্রেম কম বা নাই । কোনো এক প্রবাসী যদি প্রবাস থেকে দেশের কোনো অস্বাভাবিকতা নিয়ে কিছু একটা লিখলো তো কথাই নাই । তাকে প্রথমেই শুনতে হবে , আছেন তো নিরাপদে , তাই বড় বড় কথা । যদি দেশে থাকতেন তাইলে বুঝতেন , কত ধানে কত চাল । আর যদি বিষয়টি রাজনীতির হয় , তাহলে আরো একধাপ এগিয়ে । দূরে বসে অনেক কথাই বলা যায়, দেশের বাউ বুঝেন না তো , তাই ! মানলাম যে দূরে থাকার কারণে হয়তো অনেক ঝক্কি ঝামেলা থেকে নিরাপদ থাকা যায় । কিন্তু ওনারাও ভুলে যান , যারা প্রবাসে বসে কিছু লিখছেন , তারাও হয়তো কোনো এক সময়ে এরকম ঝক্কি ঝামেলায় রাজনীতি নিয়ে রাজপথে ছিলো বা কোনো দুর্ধর্ষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জীবনের ঝুকি নিয়ে আন্দলোনে ছিলো । কথাগুলো বললাম যে কারণে , তা হলো যে কোটি বাঙালি প্রবাসে আছে তাদের দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে কোনো কমতি আছে বলে মনে করি না । বরং উল্টোভাবে বলা যায়, এই সকল প্রবাসীদের আঁতে আরো বেশি ঘাঁ লাগে । কেননা প্রবাসে বসে যখন দেখে সব কিছু সুষ্ঠু এবং সুন্দর নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে , তখন প্রতিনিয়তই সকল প্রবাসীদের প্রথম কস্টের নিশ্বাস বের হয় , হায়রে আমার দেশে যদি এমন থাকতো বা যদি এমনভাবে চলতো । বিশ্বাস করুণ এই কথা আমি অভিজ্ঞতা থেকে জোর গলায় বলছি , প্রতিটি প্রবাসীর ক্ষেত্রেই একই রকম ঘটে । প্রবাসীরা দেশের সকল মায়া ত্যাগ করে প্রবাসে থাকে , আর যে আলো বাতাসে মানুষ বড় হয় তার প্রতি ভালোবাসা থাকবে না ! তাই কি কখনো হয় ?
যাকগে বলছিলাম দেশপ্রেম কি তার সংজ্ঞা নিয়ে দ্বিধান্বিত বা দ্বিধাগ্রস্ততার কথা । দেশপ্রেম প্রকাশের ক্ষেত্রে বড় বড় কিছু করে দেশ কে দিতে হবে , এমনতো কিছু নিশ্চয়ই নয় । অনেকের ধারণায়, দেশপ্রেম মানে , হাতে কোদাল আর মাথায় টুকরি নিয়ে গ্রামেগেঞ্জে যেখানে রাস্তাঘাট নাই , সেখানে রাস্তা তৈরি করে দেওয়া বা বিনি পয়সায় দেশের জন্য শ্রম দেওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি । আসলে কি বিষয়টি সত্যি এমন ? না , তা মোটেও নয় । এখানে প্রাসংজ্ঞিক কারণেই একটি রাজনৈতিক উদহারণ দেই , আর তা হলো সমাজতন্ত্র । একসময়ে বা বর্তমানেও অনেকের ধারণায় আছে সমাজতন্ত্র মানেই দেশের সকলের মাঝে নিক্তিতে মেপে একেবারে সমানভাবে সকল কিছু বন্টন করা হবে অথবা একই লঙ্গরখানায় খাওয়া তৈরি করা হবে এবং সকলের মাঝে সমান বন্টন করা হবে । প্রশ্ন হলো সমাজতন্ত্র কি তাই ? এখানেই যত বুঝার ভুল । অন্যভাবে বলা যায়, আমাদের বিজ্ঞ সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিবিদরা সমাজতন্ত্র বিষয়টিই সার্বিকভাবে দেশের জনগণের মাঝে নির্ভুলভাবে তুলে ধরতে পারেননি বলেই হয়তো আজকে দেশে সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো এই দৈন্যদশা । এখানে শুধু আশা করবো, এই দৈন্যদশা থেকে সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো একসময় বেরিয়ে এসে সমাজতন্ত্রের চিন্তাধারা কে দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারবে ।
সত্যি বলতে কি দেশপ্রেম সবচাইতে সহজসাধ্য বিষয় । একটি উদহারণ দেই তাহলে হয়তো বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার করা যাবে । ধরুণ আপনি দেশের যে কোনো পার্কে যে হাঁটাহাটি করবেন , বুক ভরে খোলামেলা আবহাওয়ায় নিশ্বাস প্রশ্বাস নিবেন , হয়তোবা একসময় চিনাবাদাম খাবেন । হাঁটাহাটি করবেন , চিনাবাদাম খাবেন , খোলামেলা আবহাওয়া উপভোগ করবেন , এগুলো আপনি /আমি দেশের নিকট পাওয়ার অধিকার রাখি । প্রশ্ন হলো আপনি চিনাবাদাম খেলেন , তার খোসা গুলো জায়গা মত ফেলতে গিয়ে কোনো ডাস্টবিন পেলেন না । তখন আপনি বা আমি কি করি, খোসাগুলো পার্কের যেখানে সেখানে ফেলে আসি । এই কয়েকটি চিনাবাদামের খোসার মধ্যেই আপনার বা আমার দেশপ্রেম নিহিত আছে । সেটা কিভাবে ? সেই পার্কে ডাস্টবিন দেওয়া সরকারের দায়িত্ব বা কর্তব্যের মধ্যে পরে । সরকার তার দায়িত্ব যেকোনো কারণেই হোক হয়তো পালন করেনি । এখন আমরা যদি সেই চিনাবাদামের কয়েকটা খোসা কাগজে পুরে বাসায় বা অন্যকোথায় জায়গামত ফেলি , সেটাই হবে দেশপ্রেম । আপনি আমি এই ছোট্ট কাজটি করে দেশপ্রেম দেখাতে পারি । আমরা আমাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করে এখন যত খুশি সরকারের বিরুদ্ধে বলতে , লিখতে বা চিল্লাতে পারি । মনে রাখা ভালো পৃথিবীর কোনো দেশেই সরকার সব কিছু একা করতে পারে না , সেখানে জনগণের সহায়তাই মূলে থাকে । ঠিক একইভাবে, যেখানে সেখানে দলা দলা থুথু না ফেলা বা অযথা গাড়ির হর্ণ না বাজানো এগুলোই মূলত দেশপ্রেম । এরকম হাজারো উদহারণ দেওয়া যাবে , যে কাজগুলোর মাঝেই দেশপ্রেম নিহিত আছে । শুধু একটু সচেতন হলেই হয় , দেশপ্রেমের জন্য একটি পয়সা খরচের প্রয়োজন হয় না ।
এবার আসি তামিমের একহাত আর পরিছন্নতার কথায় । লক্ষ্য করুণ, শ্রীলঙ্কার বিপরীতে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলায় তামিম শেষ কয়েকটা বলে যেভাবে দৃঢ়চেতা মনে দলের প্রয়োজনে এবং দেশের জন্য একহাতে ব্যাট নিয়ে মাঠে নামলেন ! প্রথমেই তামিম কে শতসহস্র সালাম । এটাই দেশপ্রেম। তামিম খেলায় একহাতে কিছুই করতে পারবে না , সেট সবারই জানা । কিন্তু দেশের প্রতি প্রেম থেকে তামিমের মাঠে প্রবেশই , মুশফিককে কতটা উৎসাহিত করেছে , ফলাফল ১৫ বলে ৩২ রান , সাথে খেলায় লড়ে যাওয়ার বড় পুঞ্জী । আমরা হেরে গেলেই খেলোয়াড়দের কি বকাঝকাই না করি !! অথচ সেদিন দেশের প্রতি খেলোয়াড়রা কত বড় দেশপ্রেমের উদহারণটাই না তৈরি করলেন । আমরা কথায় কথায় কত বলি ,খেলোয়াড়দের দেশের প্রতি কোনো দরদ বা মায়া বা প্রেম কিছ্ছুই নাই । সময়ে তারাই প্রমাণ দিলেন , এই সকল খেলোয়াড়রা কতটা দেশের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে খেলে ।
এবার শেষে প্রবাসীদের কথায় আসি । প্রবাসীদেরও দেশপ্রেম কতটা আছে তার উদহারণ সেই একই দিনের খেলায় দেখতে পাই । সেদিনের খেলা শেষে দুবাইয়ের স্টেডিয়াম প্রবাসীরা মিলেমিশে সম্পূর্ণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেই ঘরে ফিরেছেন । এখানেও অনেক বড় দেশপ্রেমের গল্প খুঁজে পাওয়া যায় । কেউ হয়তো চিমটি কেঁটে বলবেন , এগুলো রাশিয়ার ফুটফল বিশ্বকাপে জাপানিদের নিকট দেখে শিখেছে । হ্যাঁ তা সত্য এবং শিখতে তো কোনো বাঁধা নাই । তবে একথাও মনে রাখা ভালো যে , সেদিন কিন্তু সেই স্টেডিয়ামে ভিন্ন দেশের মানুষেরাও ছিলো । তারাও নিশ্চয়ই রাশিয়ার বিশ্বকাপ ফুটবল দেখেছে ? তারাও নিশ্চয়ই জাপানিজদের কর্মকা দেখেছে ? কই , অন্য কোনো দেশের কেউতো সেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজটি শেষ করে যায় নি ! হয়তো অনেকে প্রশ্ন করবেন ভিন্ন দেশের স্টেডিয়াম পরিষ্কারের মাঝে দেশপ্রেম কোথায় ? হ্যাঁ, এখানেও দেশপ্রেম নিহিত আছে । এই সামান্য কাজটির জন্য আমরা প্রবাসীরাও বাংলাদেশ কে অনেকের কাছে বড় করে তুলেছি । এই কাজটির জন্য বাংলাদেশ বড় হয়েছে , এটাই দেশপ্রেম । লেখা শেষে অন্তর থেকে সেই সকল প্রবাসীদের জন্য ধন্যবাদ এবং ভবিষ্যতেও দেশ কে এভাবেই পৃথিবীর বুকে ভালো দেশ হিসেবে তুলে ধরুন । আপনাদের সবার প্রতি শত সালাম । সাথে দেশের সকলের প্রতি বলবো , শুধুমাত্র সরকারের প্রতি চেয়ে না থেকে নিজের থেকে দেশের প্রতি প্রেম ভালোবাসা প্রকাশ করুণ। একজনের দেখাদেখি শত , হাজার বা ধীরে ধীরে কোটি এবং এক সময় সকলেই দেশপ্রেমে এগিয়ে আসুক।
বুলবুল তালুকদার
সহকারী সম্পাদক, শুদ্ধস্বর ডটকম