
সৈয়দ হকের দ্বিতীয় প্রয়াণবার্ষিকী
‘সৈয়দ হক কবিতায় অঞ্জলি’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসব আজ
সময়টা ২০০৭ সালের ২৪ আগস্ট। কবি সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক তখন লন্ডনে। সেদিন সেখানে তিনি ‘সমাধিফলক’ নামের ১৪ লাইনের একটি সমাধিলিপি রচনা করেছিলেন।
যার শুরুর কয়েকটি লাইনে তিনি লিখেছেন- ‘তেরোশতো নদীর এ দেশ পলিসমৃদ্ধ নিশ্চয়।/পলি পাড়ে। পালল-শিলায় লেখা গল্পটা সময়।/মানুষের সব গল্প? নাকি আছে তারও নির্বাচন?/হে মাতঃ বাংলার মাটি, করজোরে করে সম্ভাষণ/তোমার সন্তান কবি, পদচ্ছাপ রাখো মা শিলায়/যদি রাখো, কী আছে জীবন যদি মাটিতে মিলায়!’ সৈয়দ শামসুল হকের সমাধিসৌধে তার মনের কথাগুলো শিলালিপিতে খুব দ্রুত ভেসে উঠবে এমন প্রত্যাশা দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রতিটি মানুষের। দেশের মহান এ সাহিত্যিকের দ্বিতীয় প্রয়াণবার্ষিকী আজ।
এ উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী আয়োজনে আজ ‘সৈয়দ হক : কবিতায় অঞ্জলি’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হতে যাচ্ছে। এতে সৈয়দ হককে নিবেদিন দুই বাংলার শতাধিক কবির লেখা দেড় শতাধিক কবিতা স্থান পেয়েছে।
সব্যসাচীর চলে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে তার কল্পনার ‘জলেশ্বরী’ জন্মস্থান কুড়িগ্রামে তার নামাঙ্কিত স্মৃৃতিকেন্দ্র ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয়। বর্তমানে নকশা নির্মাণের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজও প্রায় শেষপর্যায়ে।
এ ব্যাপারে সরকারের যথেষ্ট আন্তরিকতার বিষয়টি উল্লেখ করে লেখকের পরিবারের পক্ষ থেকে কাজে আরও অগ্রগতি আনার বিষয়ে জানানো হয়। স্মৃতিকেন্দ্রের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিণী কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক যুগান্তরকে বলেন, সরকার স্মৃতিকেন্দ্রটি নির্মাণের বিষয়ে খুবই আন্তরিক।
সবার প্রচেষ্টায় নির্মাণকাজটি আরও ত্বরান্বিত হবে এটা আমাদের বিশ্বাস।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর যুগান্তরকে বলেন, বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতি রক্ষার্থে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা রয়েছে। কাজেই প্রকল্পটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যাপারে আমরাও কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে নকশার কাজ এগিয়ে চলছে।
স্মৃতিকেন্দ্রটি এমনভাবে তৈরি করা হবে, যেখানে সৈয়দ শামসুল হককে জানার পাশাপাশি কেন্দ্রটিকে ঘিরে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা হয়।
সৈয়দ শামসুল হকের দ্বিতীয় প্রয়াণবর্ষ উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমি আজ ও কাল দু’দিনব্যাপী স্মরণার্ঘ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। আজ সন্ধ্যা ৭টায় জাতীয় নাট্যাশালা মিলনায়তনে পিয়াস মজিদ সম্পাদিত ‘সৈয়দ হক : কবিতায় অঞ্জলি’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। বইটিতে শঙ্খ ঘোষ, কবীর চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, মুহম্মদ নূরুল হুদা, অসীম সাহা, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়সহ দুই বাংলার শতাধিক কবির কবিতা স্থান পেয়েছে। সব কবিতাই সৈয়দ হককে নিবেদিত। বইটি প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশ। আজকের আয়োজনে আরও থাকবে কবিতা আবৃত্তি এবং নাট্য পরিবেশনা। স্মৃতিচারণ ও আলোচনায় অংশ নেবেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক।
সৈয়দ হকের কবিতা আবৃত্তি করবেন বাচিকশিল্পী হাসান আরিফ। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মঞ্চায়ন হবে থিয়েটার প্রযোজিত সৈয়দ শামসুল হক রচিত নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’।
‘সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সমাধিস্থলে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ’ প্রকল্পের প্রস্তাবক বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। ২১ মে সর্বশেষ এ প্রকল্পের যাচাই-বাছাই কমিটির সভা শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এর মধ্যে রয়েছে- কবি সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতিসৌধ ও সমাধিস্থল সংলগ্ন স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে এক একর জমি প্রয়োজন হবে। প্রাক্কলিক জমির মধ্যে ০.৬১ একরের মালিকানা শিক্ষা বিভাগ তথা কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের এবং ০.৩৯ জমির মালিকানা কুড়িগ্রামের গৃহায়ন ও গণপূর্ত বিভাগের নামে রয়েছে। জমির মালিকানা হস্তান্তরে উভয় মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক সম্মতি গ্রহণ করা হবে।
এ স্মৃতিকেন্দ্রে একটি লাইব্রেরি-কাম-গবেষণা কক্ষ থাকবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কর্নারসহ। আরও থাকবে ৪৫০ আসন বিশিষ্ট একটি অডিটোরিয়াম, একটি মাল্টি পারপাস সেমিনার রুম, একটি সংগ্রহশালা-কাম-গ্যালারি, একটি উন্মুক্তমঞ্চ, আট কক্ষবিশিষ্ট ডরমিটরি ও অফিস কক্ষ।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাব্য মেয়াদকাল ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হতে পারে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হবে।
২০১৬ সালের এপ্রিলে সৈয়দ শামসুল হকের ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে তিনি পাঁচ মাস চিকিৎসা নেন। ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন।
একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার ইচ্ছা অনুযায়ী জন্মভূমি কুড়িগ্রামে সরকারি কলেজের পাশে তার লাশ দাফন করা হয়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও তিনি লিখেছেন কবিতার পর কবিতা, ছোটগল্প। বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সম্ভার হ্যামলেট অনুবাদ করেছেন।
সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে সদর্প বিচরণকারী সৈয়দ হক ৮১ বছর (জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর, মৃত্যু ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর) বেঁচেছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি দু’হাত ভরে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও গান লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন।
১৯৫৪ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘তাস’ প্রকাশ হয়। এরপর একে একে ‘শীত বিকেল’, ‘রক্ত গোলাপ’, ‘আনন্দের মৃত্যু’, ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’, ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’ নানা বিষয়ে গভীর জীবনঘনিষ্ঠ রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯৫৯ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘এক মহিলার ছবি’ প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’ প্রকাশিত হয়। ‘বিরতিহীন উৎসব’, ‘অপর পুরুষ’, ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’সহ বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।
তার লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- ‘নীল দংশন’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘তুমি সেই তরবারি’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ অন্যতম। তার অতুলনীয় কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘ঈর্ষা’, ‘গণনায়ক’ ইত্যাদি। সুত্র: যুগান্তর