
“কাজ না থাকলে সেলফের প্রোডাক্ট গুলো এদিক সেদিক করবে, বসে থাকবে না। ক্লায়েন্ট এলে দেখবে কাজের ব্যাস্ততা, বুঝবে বিক্রি ভালো, কিনতে উৎসাহিত হবে !”
বিক্রি বাড়াতে, একাউন্টেন্ট স্টেফানোর দেয়া বুদ্ধি।
শনিবার, সপ্তাহের শেষ দিন । ছেলেও কাজে সহায়তা করছে । সেলফ এর প্রোডাক্ট এদিক সেদিক করে কাজ কাজ খেলা নয়, সত্যি সত্যি কাজ । চলছে, এক্সপায়ার ডেট কন্ট্রোল, প্রোডাক্টলিস্ট ও পরিচ্ছন্নতা ।
দুপুরের পরও, আরেকটি সেলফ পরিস্কার করলাম। এসময় ক্লায়েন্ট কম।
“তোমাকে কি সহায়তা করতে পারি ?”
হটাত কথাটি শুনেই ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালাম। যা আমি বলি, ক্লায়েন্টদের, আমাকে বলে কে ?
জুলিয়া ! নিঃশব্দে কখন এলো বুঝিনি । আড়াই মিটার সেলফের শেষ তাকের নাগাল পেতে, তখন আমি মইয়ের মাথায়।
নেমে এলাম হ্যান্ড গ্লভস সহই, জড়িয়ে সুভেচ্ছা বিনিময় করতে করতে অভিযোগের সুরে বলল,
“নিশ্চিত ছিলাম না, এই সময় তোমাকে পাব কি না। সকাল হতে ফোনেও পাচ্ছিলাম না।”
ত্রিশ বছর বয়সী জুলিয়া, ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়লেও, কাজ করে অভিবাসীদের নিয়ে । পরিপাটী,ছিমছাম, স্বল্প ভাষী মেয়েটির পোশাক, কথা সব কিছুতেই ফুটে উঠে রুচিবোধ আর বিদেশিদের নিয়ে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ভাবনা।
লম্বা আলখাল্লা ধরনের একটি ম্যাক্সি পরেছে আজ । ঝলমলে সোনালি চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পিঠ জুড়ে । পোশাকের প্রশংসায় আর তার খোঁজার কারন জানতে চাওয়া হল না।
বললাম, ‘কাজের ব্যাস্ততা ছিল, দেখা হয়নি ফোন। বাহ, ড্রেসটিতো ভারি সুন্দর, খুব মানিয়েছে তোমাকে।’
উৎফুল্ল হয়ে বলল, “মায়ের পোশাক এটা, অনেক আগের । মন খারাপ হলে, পুরানো গান বা পোশাক ভলো লাগে । জানো মা ও সহায়তা করবে, বাচ্চাদের জন্য ফ্রি কচিং আর ভাষা শেখার কাজে । মনে আছে তো,গত বছরের সেই প্রজেক্ট, কিছু ফান্ড পেলেই কাজটি শুরু করবো । তুমি সাথে থাকবে তো আমাদের ।”
এক নাগাড়ে বলে গেলো সে কথাগুলো !
বছর তিনেক আগেও খুব বেশি ভালো সম্পর্ক ছিল না মায়ের সাথে জুলিয়ার ।
বাবা মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হলেও, একটি ফ্লাট ও নিয়মিত খরচ নিশ্চিত করেছে, পরিবার তার জন্য ।
অর্থনৈতিক ক্রাইসিস, অনেক বন্ধন ভেঙ্গেছে। কিছু ভাঙ্গা সম্পর্ক, পারস্পারিক প্রয়োজনে জোড়া লেগেছে। জুলিয়া ও তার মা রবের্তার সম্পর্ক হয়তো এমন।
কোন প্রজেক্ট প্লানিং নিয়ে কথা শুনব না, ভেবেই কথা ঘুরালাম। বললাম, ‘তোমার ব্যাগটিও খুব সুন্দর!’
ছোট্ট হাসি দিয়ে বলল, “ওহ এটা, আয়েশা গিফট করেছে। ওর নিজের হাতে তৈরি। আফগানি নারীদের নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করেছিলাম। আয়েশার জীবনের গল্প সহ আরও তিনজনের । তুমিতো আসলে না । প্রেজেন্টেশন এর সময় ও তোমাকে ফোন করে পাইনি, এস এম এস ও করেছিলাম ।”
‘ফোন সাইলেন্ট থাকে, মিস কল বা এস এম এস দেখলে নিজেই কল করি।’ বলতেই,
কিছুটা মনক্ষুণ্ণ হয়েই, কাজের কথায় এলো।
“আরবি খাবার আয়োজন করতে হবে, আগামী সপ্তাহে । ক্যাটারিং সার্ভিসটি তোমাকেই দিতে চাই। পাবলিসিটিও হবে।
স্বর্গবাসী আয়লানের সৃতিতে, ছবি প্রদর্শনী ।”
একটু থেমে আবার বলল, “কোন সিরীয়ান পরিবার বা আরবি ঐ অঞ্চলের কেউ পরিচিত থাকলে তাদের ও জানাতে পারো । তারাও চাইলে আসতে পারে, নিজেদের কথা বলতে পারবে।
তুমি কি বল… …”
দ্রুত দরকার টুকু বলেই থামল। সারাবছর নিজেকে নাস্তিক দাবী করা, জুলিয়া ।
তার কথার বিষয়ে কোন রা-শব্দ করতে ইচ্ছা হলোনা, প্রসঙ্গ বদল করি, ‘মেডিটেশন ও ছবি আঁকার কোর্স করবো ভাবছি, আগামী সপ্তাহ হতে সুরু হচ্ছে । মানুয়েলা মারুসসি’র ওখানে, কেমন হয় বলতো… … ‘
উল্টো তার মতামত চাইলাম।
সুন্দর চেহারাটি ফ্যাকাসে হয়ে গেল, এতো দিনের পরিচিতার। এড়িয়ে যাবো, আশা করেনি হয়তো।
তার অভিব্যাক্তিতে আমি যেন, সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ।
নিজেও অবাক হলাম, হাসি মুখেই ক্যাটারিংয়ের দায়িত্বটি ফিরিয়ে দিয়ে । প্রচারনা বাড়বে জেনেও !
না বলার জন্যও প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা বলিনি।
নিজের অসহায়ত্ব কে পুঁজি করে, নতুন নতুন ইস্যুতে মানবতার কাজ করা স্বীকৃত মানব দরদী জুলিয়া নিঃশব্দেই চলে গেল।
সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া মানুষটির কোন কাজেই আসতে পারলাম না ।
আমাকেও তো,বিক্রি বাড়াতে, কাজ না থাকলেও সেলফের প্রোডাক্ট গুলো এদিক সেদিক করতে হবে।
(ঘটনাটি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের, তুরস্কের বদ্রুম উপকূলে সাগর সৈকতে তিন বছরের সিরিয়ান শিশু আয়লান কুর্দির মরদেহ উদ্ধারের পর।)
আইরিন পারভীন
সহকারী সম্পাদক, শুদ্ধস্বর ডটকম।