
আপনাদের একটা গল্প শোনাতে চাই! ইতিবাচক পরিবর্তনের গল্প!
ঈদের ছুটি কাটিয়ে গত ছাব্বিশ তারিখে ক্যাম্পাসে এসেছি। ক্যাম্পাসের চিরাচরিত ব্যস্ততা অতটা দেখতে পাচ্ছি না। প্রচন্ড ব্যস্ততার চিঠি হাতে যে ক্যাম্পাস দিনেরপর দিন ডাকহরকরার মত ছুটে চলে, তা আজ ব্যস্ততাহীন। চারিদিকের শূণ্যতা মনের মধ্যে বাচ্চার হাতের স্লেটে খড়িমাটির আঁচড়ে সৃষ্ট মুহুর্তজীবী কাটাকুটির মতো সাম্প্রতিক স্মৃতিতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের গল্প মনের অদেখা দরোজায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। লিখবো লিখবো করেও কিছুতেই লিখা হয়ে উঠছিল না। আর সত্যি বলতে কি লিখালিখির মতো কঠিন কাজ থেকে আড়ালে থাকতেই আজকাল বোধকরি কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। কেন?
কবি কামিনী রায়ের একটা ছড়া আছে না?
আড়ালে আড়ালে থাকি
নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
অনেকটা এরকম অবস্থা আর কি! যাই হোক গল্পের কথাটায় আসি। গল্প শোনানোর কথা বলে এখন কি সব আবোলতাবোল বকছি! অনেকে হয়তোবা বিরক্তও হচ্ছেন! তাদের কাছে মার্জনা কামনা করে গল্প বলা শুরু করছি-
গল্পটার প্রধান চরিত্র একটা গ্রাম। বগুড়া জেলার অন্তর্গত দুপচাঁচিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। গ্রামটির নাম গুনাহার। গ্রামের নাম শুনে অনেকের চোখ চড়কগাছ হয়ে যেতে পারে! ‘গুনাহার’ এটা আবার কোন গ্রামের নাম হতে পারে না কি? নামের মতোই এই গ্রামের অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, অবকাঠামো, রাজনীতি এমন সব অতিপ্রয়োজনীয় শব্দগুলোর যথার্থ প্রায়োগিক ইতিবাচক কোন কর্মযজ্ঞ আজ থেকে মাত্র দশ সালের অতিতে যে রূপে ছিলো তা এখন চিন্তা করলেও আমার চোখ আপনাদের মতোই চড়কগাছ হয়ে যায়! বিস্তারিত বলছি, কিছুটা বিশদভাবে না বললে আমি হয়তো গল্পের শুরুটাতেই বুঝাতে অক্ষম হবো।
গুনাহার গ্রাম আমার জন্মস্থান। বাল্যকাল থেকেই তার সাথে আমার নিগূঢ় পরিচয়। মাত্র আট-দশ বছর আগে গ্রামের খেটেখাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে যে অভাব আমি দেখেছি তার বর্ণনা দিতে গেলে হয়তো কয়েকটা উপন্যাস লিখা হয়ে যাবে। সেদিকে আর যাচ্ছি না তবে শুধু এটুকু বলি গ্রামে বিভৎস দারিদ্রতা, পেটের তীব্র ক্ষুধা, পুষ্টিহীনতা, অসুখ-বিসুখের সানন্দ বিচরণ মানুষের জীবনকে বোধকরি কষ্টের এক মর্মান্তিক মোড়কে মুড়িয়ে রেখেছিল। সেসব দিনের কথা ভাবতে ভাবতে আমার মনে হয়,
তরুণ কবি সুকান্ত বাবু এই গ্রামটিকে উৎসর্গ করেই হয়তো বলেছিলেন,
প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়ঃ
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
আজ গ্রামের সেই দশ বছরের রূপ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। কান খাড়া করে থেকেও আর দারিদ্রতার সেরূপ আর্তনাদ শুনতে পাই না। কোথায় যেন পড়েছিলাম, নতুন দিনই নাকি নতুন চাহিদা ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। গ্রামে সম্ভবত সেই নতুন দিনের আলোকরশ্মির আগমন ঘটেছে।
যে পাড়ায় সিংহভাগ পরিবারে শুধু হাটবারেই(সপ্তাহে দুই দিন) সামান্য আমিষ(মাছ, মাংস) রান্না হতো সেই পাড়াতেই আজ পনেরটি পরিবারে রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করছে। বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা মূল্যের রেফ্রিজারেটর কেনা, চাহিদার অতিরিক্ত খাদ্যবস্তু কিনে সেটা সাময়িক সংরক্ষণ করে রাখবার ক্ষমতা যে তাদের হবে এটা হয়তো গত দশ বছর আগে তারা নিজেও কল্পনা করে নি। কিন্তু তাদের নতুন দিন এসেছে!
আরেকটা বিষয় খুবই লক্ষণীয় সেটা হচ্ছে, গ্রামে ভিক্ষাবৃত্তির আজ বিপন্নপ্রায় অবস্থা। গ্রামে আগে প্রতিদিন কয়েকডজন ভিখারী দ্বারে দাঁড়িয়ে সুউচ্চস্বরে বাড়িওয়ালার জন্য প্রশংসা ও প্রার্থনাবাণী উচ্চারণ করতো। গত সপ্তাহের পুরোটা বাড়িতে থেকে আমি খোঁজ করেও একটা ভিক্ষুক দেখতে পেলাম না। এই না পাওয়ার মাঝেই যে সুন্দরতম মৃদু একটা সুখ আছে তা আমি কোন উপমা দিয়েই ব্যাখ্যা করতে পারবো না।
পাড়ার মধ্যে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে বাড়িতে থাকতে কয়েকজন চাচি-ভাবী সম্পর্কীয় মহিলারা ভালোবেসে গাছের ফল, নিজের হাতে বানানো পিঠা, মিঠাই দিয়ে গেলেন। সম্পন্ন অশিক্ষিত এই মানুষদের মধ্যে অজান্তেই জন্ম নেওয়া শিক্ষা ও শিক্ষিতের প্রতি নিরেট ভালোবাসা তাদেরকে সামাজিকভাবে যে উন্নততর করছে এটা তারা বুঝতে না পারলেও আমি ঠিকই আঁচ করতে পেরেছি।
গ্রামের ছোট ছোট ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজি অনাবিল স্বপ্ন ও শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে যখন এসে বলে, ‘ভাইয়া/কাকু আমি তোমার মতো হতে চাই। আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই’ বুকটা অজান্তেই এক সৌন্দর্যময় সুখে ভরে যায়। অভিভাবকেরা পাশে এসে উৎসুকভাবে যখন ছেলেমেয়ের পড়াশোনার প্রশংসা করে! আমার ছেলে কি এটা হতে পারবে? মেয়েটা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে? এই প্রশ্নগুলোকে আমার কাছে শুধু প্রশ্ন নয় নতুন এক সম্ভাবনা বলে মনে হয়। দশ বছর আগেই আমার চোখের সামনে পড়াশোনা থেকে ঝরে যাওয়া আমার চেয়েও কয়েকগুণ মেধাবী চাচাতো ভাই-বোনদের কথা মনে পড়ে। সেই সময়ে তাদের পরিবারের দারিদ্রতার কষাঘাত, অভিভাবকের উদাসীনতা বর্তমানের সুন্দর সম্ভাবনাগুলোকে সেদিন ধবংস করেছিল। ভাবনা আসে। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি।
বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই গ্রামের বাইরে থাকার জন্য আশপাশটা বহুদিন ঘুরে বেরানো হয় না। এবারের ঈদের ছুটিতে বেশ কয়েকটা গ্রামে ঘুরলাম। লোকজনের সাথে কথা বললাম। একটা কথা লিখতে কিছুটা বিব্রত লাগছে, তবুও এই জায়গাটায় এটা লিখবার লোভ সামলাতে পারছি না। ছয়-সাত বছর আগে গ্রামের সড়ক দিয়ে হাঁটতে বেরুলে এক ধরনের উৎকট গন্ধ নাকে এসে নিকৃষ্টভাবে লুকোচুরি খেলতে চাইতো। কোথাও বসে একটু নির্মল হাওয়া খাওয়ার চিন্তা করলেও এদিকওদিক তাকিয়ে তারপর বসতে হতো। আসলে বলছিলাম, পথেঘাটে পায়খানা করবার নির্মম কুৎসিত ঘটনার কথা। আর স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে সামর্থহীনতা তারচেয়ে বড় ব্যাপার সচেতনতার অভাবের কথা। আজ দিন বদলিয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরলেও আর উৎকট গন্ধ লুকোচুরি খেলবার জো নিয়ে নাসিকার দিকে আগমন করে না। শুধু তাই নয়, আজ আমাদের গ্রামের প্রায় প্রতিটা বাড়িতে পানির সাপ্লাই লাইন সরবরাহ করা হয়েছে, শতভাগ বাড়ি বিদ্যুতসেবার আওতাভুক্ত হয়েছে, সময়ের তাগিদেই একজন উদ্যোক্তা নিজ উদ্যোগে গ্রামে নিয়ে এসেছেন ওয়াইফাই লাইন। ডিজিটাল বাংলাদেশের ফলপ্রসূ প্রভাব যেন পুরো গ্রামটাকে এক ধরনের নব উদ্দামতা দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ করলাম। রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিবর্তন!
দোকানের সামনে টঙে বসে পাঁচ বছর বয়সী এক বাচ্চার কাছ থেকে ‘অ আ ক খ ১ ২’ এইসব ‘ইনিসিয়াল-স্টাডি’গুলো সম্বন্ধে শুনছিলাম। ভাঙাভাঙা শব্দে বাচ্চাটি একে একে সব বললো। ইংরেজি বর্ণমালা সম্বন্ধে জানতে চাইলাম। A for Apple, B for Ball যেমনটা আমরা শিখেছিলাম এমনটাই শুনবো আশা করেছিলাম কিন্তু বাচ্চাটি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, “A ফল আপ্পেল, B ফল বাংলাদেশ(বাচ্চার উচ্চারণ)”।
আমি জিজ্ঞেস করলাম B ফর আর কি?
সে হুট করে আগেরটা না বলে বললো, ‘বঙ্গবন্ধু’।
আমি যারপরনাই পুলকিত হলাম এই ছোট্ট মুখে বাঙালির শ্রেষ্ঠ মানুষটার কথা শুনে। পরক্ষণে তীব্র কৌতুহল নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি বঙ্গবন্ধুকে চিনো?”
সে জড়তাহীনভাবে ভাঙাভাঙা শব্দে বললো, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”। অকস্মাৎ অদ্ভুত সুন্দর এক দখিনা হাওয়া এসে আমার শরীরে শিহরণ তুললো। শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গিয়ে সেই শিহরণের উপস্থিতির জানান দিলো। বাচ্চাটি টঙ থেকে নেমে দৌড়ে খেলার মাঠের দিকে চলে গেলো। আমি স্বপ্নালু চোখ তাকিয়ে থাকলাম ওর পথের দিকে। গ্রাম্য রাজনীতির অসুস্থ ধারার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এক পরিবর্তন যে আসন্ন তা কিছুটা অনুধাবন করবার চেষ্টা করে নিজে নিজেই আনন্দ অনুভব করলাম।
এই এতো এতো পরিবর্তন। ইতিবাচকতা। উৎকর্ষতা। আমার গল্পের প্রধান চরিত্র প্রিয় গ্রামটির বর্তমান রূপকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। এই উৎকর্ষতা, এই ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোতে কার অবদান সবচয়ে বেশি বলতে পারেন?
-আমাদের রাষ্ট্রের, আমাদের বর্তমান সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ও কর্মের।
ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম যেমনটা বলেছিলেন,
“উৎকর্ষতা একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়।“
তাঁর কথার সুর ধরেই বলতে চাই, আমার গ্রামের এই ইতিবাচক পরিবর্তন, এই অভূতপূর্ব উৎকর্ষতা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। একটি চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বিগত দশ বছরের ব্যবধানে গ্রামটি আজ এই অবস্থায় উপনিত হয়েছে। আর প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল বর্তমান সরকারকে তাঁর কৃতিত্ব দেওয়াতে কার্পণ্য করা কি উচিত হবে?
সরকার সরকারের জায়গাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় এগিয়ে নিচ্ছেন দেশকে। এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদেরকে।
আমি আমার গ্রামকে কেন্দ্রকরে ঘটে যাওয়া অনেক অনেক ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্যে থেকে কিছু সংখ্যক আপনাদের সামনে হাজির করবার চেষ্টা করেছি মাত্র। বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টাহেতু দৃষ্ট এই ইতিবাচক পরিবর্তনের সাথে আমাদেরও দায়িত্ব নিজ নিজ জায়গা থেকে আমাদের কাজগুলোকে আরো সুন্দর করা। ইতিবাচক পরিবর্তনে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখা। কবিগুরুর একটা কথা দিয়ে আজকের লেখার ইতি টানবো।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
“If a community wants the state to perform some of its jobs it will surely become idle and inefficient.”
“যদি কোন সম্প্রদায় চায় যে সরকার তাদের কিছু কার্য সম্পাদন করুক, তাহলে নিশ্চিতভাবে তারা অলস এবং অকর্মন্য হয়ে পড়বে।”
আমরা কেউ অলস-অকর্মন্য হয়ে পড়তে চাই না। আমরা চাই আমাদের কাজের মধ্য দিয়েই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ইতিবাচক পরিবর্তনের জোয়ার বয়ে যাক। ইতিবাচকতার একান্ত স্পর্শে দেশ উন্নয়নের হিমালয়চূড়ায় অবতীর্ণ করুক। প্রতিটি বাঙালির হৃদয় হিমালয়সম উচ্চতায় আরোহন করে দৃপ্তকণ্ঠে বলে উঠুক,
জয় বাংলা।
প্রিয় গ্রামের গর্বিত মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আমি বাঙালির হৃদয়ের স্পন্দনে চির জাগরুক ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি শুনতে চাই!
– এমরান হোসেন
পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক
ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।